প্রশ্নঃ গোরক্ষবিজয় কী? আলোচনা কর।


উত্তরঃ বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে নাথ ধর্মের কাহিনী অবলম্বনে রচিত আখ্যায়িকা কাব্য নাথ সাহিত্য নামে পরিচিত। নাথ ধর্মাবলম্বীরা শিবের উপাসক। নাথ সাহিত্যে নাথ ধর্মের চার স্তম্ভ মীননাথ, হাড়িপা, কাহ্নপা ও গোরক্ষনাথের জীবনকাহিনী বর্ণিত হয়েছে। গোরক্ষবিজয়ে গোরক্ষনাথের আলেখ্য বর্ণিত হয়েছে।

গোরক্ষবিজয়ে নাথ সম্প্রদায়ের সর্বজনমান্য, যতিশ্রেষ্ঠ গোরক্ষনাথের অদ্ভুত মহিমা বর্ণিত হয়েছে। কামক্রোধ বিজয়ী সাত্ত্বিক পুরুষ গোরক্ষনাথ কীভাবে তার পথভ্রষ্ট গুরুকে নারীদের কবল থেকে উদ্ধার করলেন-এ কাব্যের মূল কাহিনীতে তারই পরিচয় আছে। আদিপুরুষ নিরঞ্জনের মুখ থেকে শিব, নাভি থেকে মীননাথ, হাড় থেকে হাড়িপা, কান থেকে কাহ্নপা এবং জটা থেকে গোরক্ষনাথের জন্ম। আদি পুরুষের সর্বশরীর থেকে জন্ম হল গৌরীর, তার বিয়ে হল শিবের সাথে। মীননাথ ও হাড়িপা শিবের শিষ্য হল। গোরক্ষনাথ মীননাথকে গুরু বলে বরণ করল, কাহ্নপা হল হাড়িপার শিষ্য। শিব গৌরীকে মন্ত্র দীক্ষা দিচ্ছে— মীননাথ মাছ হয়ে তা গোপনে দেখে ফেলে অভিশপ্ত হল। তাছাড়া গৌরী তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য মোহনীয় রূপ ধারণ করল, গোরক্ষ তাকে মাতৃরূপে দেখল, অন্যদের মধ্যে কামভাব জাগ্রত হল। গোরক্ষনাথকে আরও পরীক্ষা করা হল। সেসব পরীক্ষায় উন্নীত হয়ে তিনি সিদ্ধি লাভ করলেন। ওদিকে তার গুরু মীননাথ অভিশপ্ত হয়ে নারী ভোগে মত্ত ছিল, তাকে শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করে।

নাথ সাহিত্যের দুটি ভাগ। একভাগে সিদ্ধাদের কথা এবং গোরক্ষনাথ কর্তৃক মীননাথকে নারীমোহ থেকে উদ্ধার, অপর ভাগে রয়েছে রানী ময়নামতী ও তার পুত্র গোপীচন্দ্রের কথা ৷ নাথ সাহিত্যে উল্লিখিত প্রথম ভাগই গোরক্ষবিজয়। এ পর্যন্ত মীননাথের ও গোরক্ষনাথের কাহিনী নিয়ে যে সব কাব্য সম্পাদিত হয়েছে তা হচ্ছে-


(১) আব্দুল করীম সাহিত্যবিশারদ সম্পাদিত শেখ ফয়জুল্লার ‘গোরক্ষবিজয়’। 

(২) ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালী সম্পাদিত শ্যামদাস সেনের ‘মীনচেতন’।

(৩) ড. পঞ্চানন মণ্ডল সম্পাদিত কবির ভীম সেনের ‘গোর্খবিজয়’।

কাহিনীটি কিন্তু নানাদিক থেকে উল্লেখযোগ্য। এতে একদিকে সন্ন্যাসী গোরক্ষনাথের মায়া- মোহবর্জিত নিস্পৃহ বৈরাগী মন এবং কর্তব্যকর্মে অবিচল নিষ্ঠা চমৎকার ফুটে উঠেছে, আর একদিকে মীননাথের সাংসারিক মায়ামুগ্ধ বিড়ম্বিত চরিত্রটিও সুপরিকল্পিত হয়েছে। দেহের উপর আত্মার জয় ঘোষণা করা এই সকল নাথপন্থী যোগী কবিদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সেই আদর্শটি, গোরক্ষবিজয় মীনচেতনে যা ব্যাখ্যাত হয়েছে। কেউ কেউ এর মধ্যে উচ্চতম কাব্যধর্ম লক্ষ্য করে একে মহাকাব্য বলতে দ্বিধা করেন নি। এর কাহিনী ও চরিত্র উল্লেখযোগ্য বটে, উপযুক্ত কবির হাতে পড়লে মহাকাব্যের মর্যাদা লাভ করতে পারত। কিন্তু স্বল্প শিক্ষিত কবিদের মূল উদ্দেশ্য ছিল এই কথা বুঝানো যে, আত্মার মুক্তি ও মোক্ষ নিজের সাধনায় সম্ভব। সেদিক দিয়ে গোরক্ষবিজয় মধ্যযুগের মূল্যবান সৃষ্টি।


প্রশ্নঃ মর্সিয়া সাহিত্য কী?


উত্তরঃ মর্সিয়া শব্দের অর্থ শোক বা আহাজারি। মর্সিয়া কাব্য বা সাহিত্য মূলত শোককাব্য। শোকের উৎস যুদ্ধক্ষেত্র। কারবালা যুদ্ধের কাব্যই ষোল-সতের শতক থেকে বাংলার মুসলিম সমাজে জনপ্রিয় হতে থাকে। কারণ, কারবালার যুদ্ধ হোসেনের সাথে এজিদের। আলীর পুত্র হাসান-হোসেনের অনুসারীরা শিয়া হিসেবে পরিচিত। চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে দাক্ষিণাত্যের শিয়াদের ও ইরানী শিয়াদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল, সে সূত্রেই ষোল শতক থেকেই শিয়াদের শোকের কাহিনী বাংলায় গুরুত্ব পায়।

তাছাড়া মুসলমান মাত্রেই হযরত মুহম্মদ (স) এর সঙ্গে জড়িত। তারই দৌহিত্র হাসান- হোসেনের প্রতি সে কারণেই আমাদের সহানুভূতি। আর এ জন্যই বাংলায় শোককাব্য তথা কারবালার বেদনাসিক্ত কাহিনী আমাদের কাছে আদরণীয়।

মর্সিয়া সাহিত্য বলতে প্রধানত কারবালার কাহিনী, তথা হযরত আলী (রা) এর পুত্র, হযরত মুহম্মদ (স) এর দৌহিত্রের যে শোচনীয় ও বেদনার্ত পরাজয়, যা আমাদেরকে শোক সাগরে ভাসায় তাকেই বুঝায়। এ সাহিত্যে নায়ক বিজয়গৌরবহীন এবং পরাজিত ও পাশবিকভাবে নিষ্ঠুরের হাতে মৃত্যুবরণ করে বলেই এ সাহিত্যের রস হয়ে উঠে করুণ। শোকের বা কান্নার আধার বলেই এ বিলাপ প্রধান সাহিত্যের নাম মর্সিয়া বা শোক সাহিত্য।


এ কাব্য বেদনার বলেই আমাদের কাছে নন্দনীয় নয়। এ কাব্যের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় মানুষের কিছু সহজাত প্রবৃত্তি। যেমন— অন্যায়ের প্রতিবাদে জীবনপণ; জীবন দেব কিন্তু ইজ্জত দেব না; জানের চেয়ে মান বড়, তার চেয়ে বড় স্বাধীনতা। হোসেন অত্যাচারী এজিদের অনুগত থাকলে স্বচ্ছন্দে জীবন কাটাতে পারতেন, কিন্তু তা তিনি করেন নি। জীবনের বিনিময়ে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় মানুষ যুগে যুগে ন্যায়ের পক্ষেই বেদনার্ত হয়ে উঠে। মর্সিয়া সাহিত্যে কারবালার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যারা লিখেছেনঃ

১. দৌলত উজির বাহরাম খানের- ইমাম বিজয়;


২. হায়াৎ মাহমুদ- কারবালা কাব্য;

৩. শেখ ফয়জুল্লাহ – যয়নবের চৌতিশা;

8. মুহম্মদ খান মক্তুল হোসেন কাব্য; 

৫. আব্দুল আলিম- হানিফার লড়াই; 

৬. নজর আলী- হানিফার কারবালা যাত্রা;

৭. আমান উল্লাহ- মোহাম্মদ হানিফার লড়াই ; 

৮. নসরুল্লাহ খন্দকার- কারবালা কাহিনী।

‘কারবালা’ শব্দটি উচ্চারিত হলেই মুসলমানের সামনে এক বেদনার্ত শোকগাঁথার চিত্র ভেসে উঠে, যা নিয়ে মধ্যযুগের মর্সিয়া সাহিত্য রচিত। আজও তা নানাভাবে আমাদেরকে আন্দোলিত করে, করে শোকার্ত।
Rate this post