প্রশ্নঃ খনার বচন বলতে কী বুঝ?

উত্তরঃ পৃথিবীর প্রত্যেক দেশ ও জাতির রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন লোকসাহিত্য। লোকসাহিত্য ব্যক্তি বিশেষের একক প্রচেষ্টার ফসল নয়। বিভিন্ন দেশের লোকসাহিত্যের প্রকৃতি বিভিন্ন। লোকসাহিত্য নির্ভর করে প্রত্যেক দেশ-জাতির পেশা/বৃত্তিকে শিক্ষা-সংস্কৃতিকে কেন্দ্ৰ করেই। অর্থাৎ দেশের মানুষের চালচলন, রীতিনীতি, কর্ম, উৎপাদন ব্যবস্থা ইত্যাদির উপর নির্ভর করে গড়ে উঠে লোকসাহিত্য। 

খনার বচন লোকসাহিত্যের উপাদান। খনার বচন মূলত গঠনের দিক থেকে ছড়ার মত। খনার বচনের কিছু কিছু রাবণের নামেও পরিচিত। আসলে খনা বা রাবণ এর কেউই এগুলোর রচয়িতা নয়। কৃষিপ্রধান বাংলায় বিভিন্ন ফসল উৎপন্নের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, ভাল-মন্দ, সুলক্ষণ-দুর্লক্ষণ নিয়ে ছড়া আকারে খনার বচনগুলো সৃষ্টি হয়েছে এবং লোকপরম্পরায় তা চলে আসছে। 

খনার বচনের সাহিত্যিক মূল্য তেমন নেই, তবে এতে সমাজের একটি বিশেষ ছবি পাওয়া যায়। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে খনার বচনের গুরুত্ব অত্যন্ত প্রবল। এগুলোতে বাস্তবরসের ও জ্যোতিষভাবের লক্ষণ থাকায় আমাদের সমাজের একটি বিশেষ দিকের আলোকপাত করায় এগুলোর মূল্য অনস্বীকার্য। দীর্ঘদিনের বাস্তব অভিজ্ঞতার ফলে এগুলো সৃষ্ট বলে এগুলোর মধ্যে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ছাপ রয়েছে। এগুলো এক ধরনের বিজ্ঞানও বটে। কেননা খনার বচনগুলো দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল। যেমনঃ

কলা রুয়ে না কাট পাত

তাতেই কাপড় তাতেই ভাত।

অর্থাৎ, কলাগাছ রোপণ করে যদি পাতা কাটা না হয়, তাতে প্রচুর কলা জন্মে। কিন্তু পাতা কাটলে কলা ফলে না ৷

যদি বর্ষে মাঘের শেষ

ধন্য রাজার পুণ্য দেশ।

অর্থাৎ, মাঘ মাষের শেষে যদি বৃষ্টি হয় তবে দেশে ভাল ফসল হয় এবং দেশ ফসলে সমৃদ্ধ হয়৷

হাতে বিশে করি ফাঁক। 

আম-কাঁঠাল পুঁতে রাখ। 

গাছাগাছি ঘন সবে না।

ফল তাতে ফলবে না।

অর্থাৎ, আম বা কাঁঠাল চারা একটা থেকে অন্যটা বেশ ফাঁকে লাগাতে হয়। ঘন গাছের পিঠে গাছ থাকলে আম-কাঁঠাল গাছে ভাল ফল ধরে না। মূলত খনার বচন কৃষিজীবী মানুষের চাষবাসের নির্দেশক।

প্রশ্নঃ সেকশুভোদয়ার পরিচয় দাও৷

উত্তরঃ বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ। প্রাচীন যুগের একমাত্র সাহিত্যিক নিদর্শন চর্যাপদ। চর্যার ভাষা বাংলা। প্রাচীন যুগে অর্থাৎ ৬৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চর্যাপদের মত অন্য কোন গ্রন্থ না পাওয়া গেলেও বেশ কিছু নিদর্শনের পরিচয় মেলে। সেসব নিদর্শনের মধ্যে ‘সেকশুভোদয়া’ অন্যতম। এ সময়ের বাংলা ভাষা অবিমিশ্র নয়। প্রাকৃত ভাষা থেকে অপভ্রংশের স্তর পেরিয়ে আসামী, উড়িয়া, ভোজপুরিয়া এরূপ বহু প্রাচ্য ভাষার সংমিশ্রণে ‘সেকশুভোদয়া’ রচিত বলে ভাষাবিদদের ধারণা। ‘সেকশুভোদয়া’ লক্ষ্মণসেনের সভাকবি হলায়ুধ মিশ্রের রচনা। এ গ্রন্থের প্রথম দিকে কয়েকটি বাংলা গান ও চর্যার উল্লেখ আছে। এর কোনটি মাহাত্মা গান কোনটি বা প্রেমমূলক। সেকশুভোদয়া মূলত প্রাচীন যুগের কিছু সংগীতের সমষ্টি। সেকশুভোদয়াকে অনেকে প্রাচীন নয় বলে মনে করেন।

প্রশ্নঃ মনসামঙ্গল কী?

উত্তরঃ আনুমানিক খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী হতে আরম্ভ করে অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি ভারতচন্দ্রের কাল পর্যন্ত বঙ্গ সাহিত্যে যে একশ্রেণীর ধর্মবিষয়ক আখ্যানকাব্য প্রচলিত ছিল যা মঙ্গলকাব্য নামে পরিচিত। মঙ্গলকাব্যের কাহিনী বাংলার সামাজিক অবস্থা হতে উদ্ভূত হলেও, কালক্রমে তা হিন্দু সমাজের অনুশীলনের বিষয় হওয়ার ফলে তাদের উপর পুরানগুলোর প্রভাব পড়েছে। প্রত্যেক মঙ্গলকাব্যের নায়ক স্বর্গভ্রষ্ট দেবশিশু। বাঙালি ভোগবাদী কিন্তু কর্মকুষ্ট, তাই দৈবশক্তি ও তুতাকের উপর তাদের অগাধ বিশ্বাস। তাই মনসা, শীতলা, শনি প্রভৃতি অরি দেবতার পূজা দিয়ে যেমন পার্থিব অকল্যাণ এড়াতে চেয়েছে, তেমনি লক্ষ্মী, চণ্ডী, ধর্মঠাকুর, সত্যনারায়ণ প্রভৃতির সেবায় সুখশান্তি ও ঐশ্বর্যের আশ্বাস লাভ করেছে। তাই বাংলা সাহিত্যে নানা ধরনের মঙ্গলকাব্যের দেখা পাই মনসামঙ্গল, শীতলামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল প্রভৃতি।

সাপের হাত হতে রক্ষা পেতে এ বাংলার মানুষেরা মনসা দেবীর পূজা করে এ থেকেই মনসামঙ্গল কাব্যের উৎপত্তি। আর্য সমাজ থেকে স্ত্রী দেবতার পূজার প্রচলন আৰ্য সমাজের প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশে এবং দাক্ষিণাত্যে মনসা খুবই জনপ্রিয় ছিল। মনসামঙ্গল কাব্য মূলত পূর্ব বাংলার দান। মনসামঙ্গল প্রধানত দেব ও মানবের সংগ্রামের কাহিনী। মনসামঙ্গল কাব্যের প্রধান কবি হলেন-

নারায়ণ দেব, বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপলাই, ষষ্ঠিবর দত্ত, কানাহরি দত্ত। তাছাড়া বিপ্লব দাস, দ্বিজ বংশীদাস, কেতকাদাস, ক্ষেমানন্দ প্রভৃতি অপ্রধান কবির নামও পাওয়া যায়। দ্রোহের ও সংগ্রামের ইতিকথা। দেব-মানববের সংগ্রামে মানুষ পরাজিত হয়েছে বটে, কিন্তু বৃদ্ধি পেয়েছে মানবকিতার মর্যাদা, মহিমান্বিত হয়েছে মনুষ্যত্ব। চাঁদ বেহুলার বিদ্রোহে ও দৃঢ়সংকল্পে এদেশের মানুষের মনে আত্মশক্তির ও আত্মমর্যাদার চেতনা জাগে।

প্রশ্নঃ গোরক্ষবিজয় কী? আলোচনা কর।

উত্তরঃ বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে নাথ ধর্মের কাহিনী অবলম্বনে রচিত আখ্যায়িকা কাব্য নাথ সাহিত্য নামে পরিচিত। নাথ ধর্মাবলম্বীরা শিবের উপাসক। নাথ সাহিত্যে নাথ ধর্মের চার স্তম্ভ মীননাথ, হাড়িপা, কাহ্নপা ও গোরক্ষনাথের জীবনকাহিনী বর্ণিত হয়েছে। গোরক্ষবিজয়ে গোরক্ষনাথের আলেখ্য বর্ণিত হয়েছে।

গোরক্ষবিজয়ে নাথ সম্প্রদায়ের সর্বজনমান্য, যতিশ্রেষ্ঠ গোরক্ষনাথের অদ্ভুত মহিমা বর্ণিত হয়েছে। কামক্রোধ বিজয়ী সাত্ত্বিক পুরুষ গোরক্ষনাথ কীভাবে তার পথভ্রষ্ট গুরুকে নারীদের কবল থেকে উদ্ধার করলেন-এ কাব্যের মূল কাহিনীতে তারই পরিচয় আছে। আদিপুরুষ নিরঞ্জনের মুখ থেকে শিব, নাভি থেকে মীননাথ, হাড় থেকে হাড়িপা, কান থেকে কাহ্নপা এবং জটা থেকে গোরক্ষনাথের জন্ম। আদি পুরুষের সর্বশরীর থেকে জন্ম হল গৌরীর, তার বিয়ে হল শিবের সাথে। মীননাথ ও হাড়িপা শিবের শিষ্য হল। গোরক্ষনাথ মীননাথকে গুরু বলে বরণ করল, কাহ্নপা হল হাড়িপার শিষ্য। শিব গৌরীকে মন্ত্র দীক্ষা দিচ্ছে— মীননাথ মাছ হয়ে তা গোপনে দেখে ফেলে অভিশপ্ত হল। তাছাড়া গৌরী তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য মোহনীয় রূপ ধারণ করল, গোরক্ষ তাকে মাতৃরূপে দেখল, অন্যদের মধ্যে কামভাব জাগ্রত হল। গোরক্ষনাথকে আরও পরীক্ষা করা হল। সেসব পরীক্ষায় উন্নীত হয়ে তিনি সিদ্ধি লাভ করলেন। ওদিকে তার গুরু মীননাথ অভিশপ্ত হয়ে নারী ভোগে মত্ত ছিল, তাকে শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করে।

নাথ সাহিত্যের দুটি ভাগ। একভাগে সিদ্ধাদের কথা এবং গোরক্ষনাথ কর্তৃক মীননাথকে নারীমোহ থেকে উদ্ধার, অপর ভাগে রয়েছে রানী ময়নামতী ও তার পুত্র গোপীচন্দ্রের কথা ৷ নাথ সাহিত্যে উল্লিখিত প্রথম ভাগই গোরক্ষবিজয়। এ পর্যন্ত মীননাথের ও গোরক্ষনাথের কাহিনী নিয়ে যে সব কাব্য সম্পাদিত হয়েছে তা হচ্ছে-

(১) আব্দুল করীম সাহিত্যবিশারদ সম্পাদিত শেখ ফয়জুল্লার ‘গোরক্ষবিজয়’। 

(২) ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালী সম্পাদিত শ্যামদাস সেনের ‘মীনচেতন’।

(৩) ড. পঞ্চানন মণ্ডল সম্পাদিত কবির ভীম সেনের ‘গোর্খবিজয়’।

কাহিনীটি কিন্তু নানাদিক থেকে উল্লেখযোগ্য। এতে একদিকে সন্ন্যাসী গোরক্ষনাথের মায়া- মোহবর্জিত নিস্পৃহ বৈরাগী মন এবং কর্তব্যকর্মে অবিচল নিষ্ঠা চমৎকার ফুটে উঠেছে, আর একদিকে মীননাথের সাংসারিক মায়ামুগ্ধ বিড়ম্বিত চরিত্রটিও সুপরিকল্পিত হয়েছে। দেহের উপর আত্মার জয় ঘোষণা করা এই সকল নাথপন্থী যোগী কবিদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সেই আদর্শটি, গোরক্ষবিজয় মীনচেতনে যা ব্যাখ্যাত হয়েছে। কেউ কেউ এর মধ্যে উচ্চতম কাব্যধর্ম লক্ষ্য করে একে মহাকাব্য বলতে দ্বিধা করেন নি। এর কাহিনী ও চরিত্র উল্লেখযোগ্য বটে, উপযুক্ত কবির হাতে পড়লে মহাকাব্যের মর্যাদা লাভ করতে পারত। কিন্তু স্বল্প শিক্ষিত কবিদের মূল উদ্দেশ্য ছিল এই কথা বুঝানো যে, আত্মার মুক্তি ও মোক্ষ নিজের সাধনায় সম্ভব। সেদিক দিয়ে গোরক্ষবিজয় মধ্যযুগের মূল্যবান সৃষ্টি।

Rate this post