প্রশ্নঃ সংগঠনের আনুষ্ঠানিক ও আধুনিক মতবাদের মধ্যে পার্থক্য দেখাও।
ভূমিকাঃ সংগঠনের সনাতন বা ক্লাসিক্যাল মতবাদটি আনুষ্ঠানিক সংগঠনের কাঠামোগত দিক নিয়ে আলোচনা করে। এ মতবাদ অনুসারে সংগঠন হচ্ছে কোন আনুষ্ঠানিক পরিকল্পনা কাঠামো, যা কতকগুলো সুস্পষ্ট নীতি বা সূত্রের মাধ্যমে গড়ে উঠে। এর অভ্যন্তরে বিভিন্ন এককের মধ্যে এমন এক প্রকার পারস্পরিক সম্পর্ক থাকে যা সরকার ব্যবস্থার আইন দ্বারা ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা সরাসরি উপর থেকে নিচ পর্যন্ত প্রবাহিত হয়। আর অন্য দিকে সংগঠনের সনাতন ও নয়া সনাতন মতবাদের বিকল্প হেসেবেই আধুনিক মতবাদের আবির্ভাব ঘটে। এ তত্ত্বের মূলকথা হলো কোন সংগঠনকে গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করা দরকার। তাই সংগঠনের এ মতবাদকে ‘ব্যবস্থা মতবাদ’ বলা হয়। এটি সংগঠনের কর্মচারীদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও ক্রিয়াকলাপের এক ব্যবস্থা যা সর্বদাই স্থিতিশীল। এ মতবাদ অনুসারে সংগঠন বা সংস্থাতে কর্মরত কর্মচারীদের সুসংহত করতে আগ্রহী। এটি অনুযায়ী কর্মচারীদের মেশিনরূপে না ভেবে মানুষরূপে ভাবা হয়৷

সংগঠনের আনুষ্ঠানিক ও আধুনিক মতবাদের মধ্যে পার্থক্য (Distinuish Between Formal and Modern Theory of Organization): নিম্নে সংগঠনের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক -এ উভয় মতবাদের মধ্যকার পার্থক্য উল্লেখ করা হলোঃ

১। আনুষ্ঠানিক মতবাদ অনুযায়ী সংগঠনের কাঠামো হচ্ছে একটি স্থবির প্রক্রিয়া। কিন্তু আধুনিক তত্ত্ব নির্দিষ্ট কাঠামোর আওতায় এর বিভিন্ন উপাদানের মধ্যকার ক্রিয়াকলাপভিত্তিক একটি গতিশীল প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয় ৷

২। আনুষ্ঠানিক মতবাদ অনুযায়ী ব্যক্তিকে বিবেচনা করা হয় ‘Economic man’ হিসেবে । এটি অনুযায়ী শ্রমিকের মজুরি বাড়লেই তাদের দক্ষতা ও কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু আধুনিক মতবাদ অনুযায়ী ব্যক্তির কর্মদক্ষতা ও দক্ষতার দ্বারা সংগঠণ যা প্রদান করে এর প্রতিদানস্বরূপ সে স্বীকৃতি ও পারস্পরিক নিরাপত্তা লাভ করে।

৩। আনুষ্ঠানিক মতবাদ সংগঠনের একটি বিশেষ দিক নিয়ে আলোচনা করে। আধুনিক তত্ত্ব সেখানে সংগঠনের সকল উপাদানকে একই সাথে বিবেচনায় রাখতে প্রয়াসী হয়।

৪। আনুষ্ঠানিক মতবাদ সংগঠনের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বিভিন্ন অংশের মধ্যে যুক্তিসঙ্গত ও কার্যকর সম্পর্ক স্থাপনে প্রয়াসী হয়। অপরদিকে সংগঠনের আধুনিক মতবাদ সংগঠনের কাঠামোর ব্যক্তিদের আচরণগত আদর্শ এবং মূল্যবোধের উপর বেশি গুরুত্ব দেয়।

৫। আনুষ্ঠানিক মতবাদ ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের উপর নির্ভর করে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়। অপরদিকে, আধুনিক সংগঠন তত্ত্ব ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের মধ্যে সমন্বয় এবং আদর্শ ও মূল্যবোধের উপর নির্ভর করে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়।

৬। আনুষ্ঠানিক মতবাদ অনুযায়ী ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জোর-জবরদস্তি ও বাধ্যকরণের মাধ্যমে, অধস্তন কর্মচারীদের আদেশ প্রদানের মাধ্যমে ক্ষমতার ব্যবহার করে। অপরদিকে আধুনিক মতবাদ জোর-জবরদস্তি ও অধস্তনদের বাধ্যকরণের স্থলে নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অধস্তন কর্তৃপক্ষের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে।

৭। আনুষ্ঠানিক তত্ত্বের ভিত্তি হলো কর্ম সম্পাদনের প্রকৃতি ও পরিধি এবং উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তি ও সম্পদের যথার্থ ব্যবহার। অপরপক্ষে আধুনিক মতবাদ সংগঠন ও কর্মচারীদের মধ্যে সুসম্পর্কের উপর জোর দেয়। এর উদ্দেশ্য কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তোলা।

৮। আনুষ্ঠানিক সংগঠন তত্ত্ব মানুষের মনুষ্যত্বকে অস্বীকার করে। এটা মানুষকে মেশিনরূপে কল্পনা করে। কিন্তু আধুনিক মতবাদে মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখা হয়। এখানে মানুষে মানুষে কোন পার্থক্য দেখা হয় না।

৯। আনুষ্ঠানিক তত্ত্বটি বর্ণনামূলক নয়। এটা সংকীর্ণ ও সাদাসিধে। এটি সংগঠনের আনুষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ। অপরদিকে সংগঠনের আধুনিক মতবাদ বর্ণনামূলক। এটা এমন একটি ব্যবস্থা যা ব্যক্তি, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক কাঠামো, মর্যাদা, ভূমিকা, পদ্ধতি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে।

১০। আনুষ্ঠানিক মতবাদে সংগঠনে কর্মরত কর্মচারীদের যন্ত্ররূপে গণ্য করা হয়। অপরদিকে আধুনিক মতবাদে সংগঠনে কর্মরত মানুষকে মানুষ মনে করা হয় এবং সকল মানুষকে সমান মর্যাদা দেয়া হয়৷

১১। আনুষ্ঠানিক মতবাদের অনুসারীদের মতে, প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের জন্যে প্রশাসনের কর্মচারীদের সংখ্যা সীমিত করা প্রয়োজন। অপরদিকে আধুনিক মতবাদে যুগের সাথে মিল রেখে চাহিদানুযায়ী প্রশাসনিক লোকবল নিয়োগ করা হয়।

১২। আনুষ্ঠানিক মতবাদ স্বয়ংসম্পূর্ণ মতবাদ নয়। অন্যদিকে আধুনিক মতবাদ ক্লাসিক্যাল ও নিউ ক্লাসিক্যাল মতবাদের সংমিশ্রিত রূপ।

১৩। আনুষ্ঠানিক মতবাদ অনুযায়ী সংগঠন হচ্ছে ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণ কার্যের বিভক্তিকরণ ও কর্ম বিভাজনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। পদসোপান নীতি অনুযায়ী সংগঠন একটি যুক্তিভিত্তিক কর্ম ব্যবস্থাপনা। অপরদিকে আধুনিক সংগঠন তত্ত্ব অনুযায়ী সংগঠন পরস্পর নির্ভরশীল উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত একটি ব্যবস্থা।

১৪। আনুষ্ঠানিক মতবাদে শ্রমবিভাজনকে কেন্দ্র করে অন্যান্য উপাদানের বিকাশ ঘটে। অন্যদিকে আধুনিক মতবাদে কর্মচারীদের প্রেরণা ও কার্যের সমন্বয়কে কেন্দ্র করে অন্যান্য উপাদানের বিকাশ ঘটে।

উপসংহারঃ উপরোক্ত পার্থক্যসমূহ সংগঠনের আনুষ্ঠানিক ও আধুনিক মতবাদের মধ্যে এক বিরাট ব্যবধানের সৃষ্টি করেছে। বলা বাহুল্য, উভয় মতবাদ দু’টি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন। 

Rate this post