প্রশ্নঃ ‘একীভূতকরণ বনাম বিখত্তিকরণ নীতি’- বিশ্লেষণ কর। 

একীভূতকরণ বনাম বিখত্তিকরণ নীতি (Integration Vs Disintegration): সংগঠনের বিভিন্ন শাখার একীভূতকরণ বা একত্রীকরণ বা সংযুক্তিকরণ বা সংঘবদ্ধকরণের বিষয়টি আধুনিককালে সুষ্ঠু, সফল ও কল্যাণকর প্রশাসনের ক্ষেত্রে গুরুত্ব লাভ করেছে। লোক প্রশাসনের ক্ষেত্রে একত্রীকরণের অর্থ হলো, এক বা একাধিক সংগঠনকে প্রত্যক্ষভাবে দেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার অধীনে ন্যস্ত করে এগুলোকে দেশের অবশিষ্ট প্রশাসনিক কাঠামোর সাথে সংযুক্ত করা। সংবদ্ধকরণ বা একীভূত করার নীতি বলতে মূলত বোঝান হয় স্বতন্ত্র নিয়ন্ত্রক কমিশন ( Independent Regulatory Commissions) বা জনগণ দ্বারা নির্বাচিত প্রশাসনিক সংস্থা বা কর্মকর্তাগণের স্বতন্ত্র মর্যাদার বিলোপ সাধন করা। সুতরাং একীভূত বা সংবদ্ধ প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সকল নির্বাহী কর্তৃত্বই (Executive Authority) আইন বা সংবিধানের মাধ্যমে কোন একক ব্যক্তির উপর অর্থাৎ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার উপর অর্পণ করা হয় এবং সেই প্রশাসনিক ব্যবস্থার সকল অংশকেই সাধারণ ও চূড়ান্তভাবে দেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার অধীনে এনে তাদেরকে পরস্পর সংযুক্ত করা হয়। এরূপ ব্যবস্থায় প্রধান নির্বাহী-কর্তার কর্তৃত্ব সংগঠনের বিভিন্ন স্তরের ভিতর দিয়ে সকল স্তরেই অব্যাহতভাবে প্রবাহিত হয়।

তবে আধুনিক বিশ্বে কোন রাষ্ট্রেই এমন কোন প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেই, যা সম্পূর্ণরূপে একীভূত। বর্তমান বিশ্বরাষ্ট্রের দিকে তাকালে দেখা যায় সেখানে সকল প্রকার প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে কোন একটি বিশেষ প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের অধীন। বাংলাদেশের সংবিধানেও এমন ধরনের কর্তৃপক্ষ বা এজেন্সির বিধান রয়েছে, যেগুলো নির্বাহী বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত। যেমনঃ বাংলাদেশ কর্ম কমিশন, নির্বাচন কমিশন প্রভৃতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন ব্যবস্থায়ও অনেক স্বতন্ত্র সংস্থার অস্তিত্ব রয়েছে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান সমগ্র নির্বাহী কর্তৃত্ব প্রেসিডেন্টের হাতে ন্যস্ত করে প্রশাসনিক একতা বিধানের চেষ্টা করেছে, তথাপি মার্কিন প্রেসিডেন্ট কোন একীভূত প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তেমন সহায়তা লাভ করতে পারেন নি। যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন ধরনের স্বতন্ত্র সংস্থা রয়েছে, যেমনঃ নিয়ন্ত্রক বা রেগুলেটরি কমিশন (Regulatory Commission), সরকারি কর্পোরেশন (Government Corporation), পেশাগত সার্ভিস এজেন্সি (Professional Service Agencies) প্রভৃতি। একীভূত প্রশাসন ব্যবস্থা হচ্ছে দেশের প্রধান শাসকের অভিন্ন চূড়ান্ত কর্তৃত্বাধীনে সংবদ্ধ খণ্ডগুলোর সমাহার। এরূপ ব্যবস্থায় কর্তৃত্বের ধারা প্রধান শাসকের কাছ থেকে শুরু করে সমগ্র ব্যবস্থার সকল অংশে এমনভাবে পরিব্যপ্ত হয় যে প্রশাসনের কোথাও কোন অসংবদ্ধ প্রান্ত থাকতে পারে না।

একীভূতকরণ বা সংযুক্তিকরণ নীতির সাথে সংশ্লিষ্ট উপাদানগুলো হচ্ছেঃ (ক) পদসোপানভিত্তিক কর্তৃত্ব; (খ) কার্যভিত্তিক কর্মবণ্টন; (গ) উপদেষ্টা ও নির্দেশমূলক কর্মের মধ্যে পার্থক্য; (ঘ) সহায়ক উপদেষ্টামূলক কাজ এবং (ঙ) গৃহরক্ষণাবেক্ষণ কার্যের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ। একত্রীকরণ ও কেন্দ্রীকরণ একই অর্থ বহন করে না। একত্রীকরণ বলতে বুঝায়, যখন কোন প্রশাসনিক একক পরিচালনার জন্য প্রশাসনের সামগ্রিক কর্তৃত্ব একজন ব্যক্তি বা একটি সংস্থাকে ন্যস্ত করা হয়। এরূপ প্রশাসনিক একক একটি নগর প্রশাসন, অঙ্গরাষ্ট্র এবং জাতীয় পর্যায়ে সংগঠিত হতে পারে। এ কারণে এরূপ ব্যবস্থাকে এক-স্তরীয় সরকার (Single Level of Government) বলা যায়। কিন্তু কেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থা সরকারের দ্বিস্তরীয় সম্পর্ককে বোঝায়। এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় বা জাতীয় সরকার কর্তৃক প্রাদেশিক ও স্থানীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণকে বোঝায়।

বিযুক্তিকরণ বা বিখণ্ডিকরণ নীতিতে নির্বাহী ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব সংবিধানের অথবা সংসদীয় আইনের মাধ্যমে কয়েকটি সংস্থা বা কয়েকজন ব্যক্তির উপর অর্পণ করা হয়। এরূপ ব্যবস্থায় প্রশাসনে বেশ কিছু সংখ্যক অসংবদ্ধ প্রান্ত বা শাখা থেকে যায়। এ সকল শাখাগুলো স্বাধীন সংস্থাপন ও প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত কর্মকর্তা হিসেবে অবস্থান করে। এ ব্যবস্থা বা নীতিতে প্রধান শাসকের কাছ থেকে কর্তৃত্বের ধারা নেমে এসে এক পর্যায়ে থেমে যায় এবং পরবর্তীতে ভেঙ্গে ভেঙ্গে অগ্রসর হতে থাকে। বর্তমানে প্রশাসনের ভূমিকা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরূপ ভূমিকা বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার মধ্যে অখণ্ডতা রক্ষার চাহিদাও জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। ক্রমবর্ধমান কাজ ও দায়িত্বের ভারে আধুনিক সরকারের প্রশাসন যন্ত্র আজ ভারাক্রান্ত । এর ফলে প্রশাসন যন্ত্র অসংলগ্ন এবং নিয়ন্ত্রণ ছিন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

তবে বর্তমান বিশ্বের কোন রাষ্ট্রেই সম্ভবত এমন কোন প্রশাসনিক ব্যবস্থা দৃষ্টিগোচর হবে না যা সম্পূর্ণরূপে একীভূত বা সম্পূর্ণরূপে বিখণ্ডিত। কিন্তু প্রশাসন ব্যবস্থার সংহত বা অসংহত অবস্থার মাত্রাভেদ লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ প্রশাসনের কোথাও পুরোপুরি সংহত অবস্থা বিদ্যমান আবার কোথাও আংশিকভাবে বিদ্যমান। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ফ্রান্স ও জার্মানির প্রশাসন ব্যবস্থা প্রধানত একীভূতকরণ বা সংযুক্তিকরণের পর্যায়ভুক্ত। ভারতে ত্রি-স্তরীয় সরকার বিদ্যমান। যেমনঃ

কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক ও স্থানীয় সরকার। প্রাদেশিক ও স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা অনেকাংশে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত।

অন্যদিকে বিযুক্তিকরণ বা অসংঘবদ্ধ ব্যবস্থার প্রকৃষ্ট উদাহরণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঁচ ধরনের স্বতন্ত্র সংস্থা রয়েছে। যেমনঃ (ক) নিয়ামক কমিশন, (খ) সরকারি করপোরেশন, (গ) পেশাগত চাকরি সংস্থা (এরূপ সংস্থা শিক্ষা ও সমাজ কর্মকে বুঝায়), (ঘ) আন্তরাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নির্বাচিত কর্মচারী— যেমন ট্রেজারার ও এটর্নি জেনারেল এবং (ঙ) হিসাবরক্ষক। নয়টি বৃহদাকার নিয়ামক কমিশনের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর ক্ষমতা যথেষ্ট পরিমাণে সীমিত করা হয়েছে। এরূপ সংস্থাগুলো “কর্তাবিহীন” এবং সরকারের চতুর্থ সংস্থা বলে পরিচিত। এ ছাড়াও অনেক সংস্থা রয়েছে, যেগুলো বহুলাংশে স্বায়ত্তশাসিত। যেমনঃ টেনিসি ভেলী।

বিযুক্তিকরণ বা বিখণ্ডিকরণ মতবাদের সমর্থকদের মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বতন্ত্র সংস্থাগুলোকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণে আনা হলে প্রেসিডেন্ট স্বৈরাচারী প্রশাসকে পরিণত হবেন। এতে গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বিঘ্নিত হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন ব্যবস্থা যদিও বিযুক্তিকরণ প্রকৃতির, তথাপি সেখানে যেসব প্রশাসনিক সংগঠন রয়েছে তা অভ্যন্তরীণ দিক থেকে কেন্দ্রীভূত। প্রশাসনে কর্মরত ব্যক্তি ও বিশেষজ্ঞগণ একীভূত বা সংবদ্ধ প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে সমর্থন দান করেন। প্রশাসনের সংগঠনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একীভূত বা সংবদ্ধ পদ্ধতি পরিলক্ষিত হয়। তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অসংবদ্ধ বা স্বতন্ত্র সংগঠন প্রয়োজন হয়।

প্রশাসনিক সংগঠনের একত্রীকরণ ও বিযুক্তিকরণ পদ্ধতির মধ্যে একত্রীকরণ বা সংবদ্ধকরণ ব্যবস্থার সুবিধা ও গুণাগুণ তুলনামূলকভাবে অধিক। এ মতবাদের সমর্থকদের মতে সংবদ্ধ অবস্থায় সমন্বয় বৃদ্ধি পায়, অপরপক্ষে অসংবদ্ধ অবস্থায় নৈরাজ্য ও সংঘাত বৃদ্ধি পায়। সুসমন্বয় ব্যতীত সরকারি ব্যবস্থাপনার সাফল্য কল্পনা করা হাস্যকর। স্বতন্ত্র ও স্বাধীন সত্তার প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ বিশেষ চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী ও কায়েমি স্বার্থবাদীদের কুক্ষিগত হয়। এরা সংগঠনকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে। ফলে জনস্বার্থ সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত হয়। সংবিধানে স্বীকৃত আইনানুগ কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্বাধীনে সংগঠনগুলোকে একীভূত বা সংবদ্ধ করা হলে ছোট কর্তাদের প্রভাব ও নেপথ্যে থেকে তাদের অনিয়মতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ থেকে সংগঠনগুলো মুক্ত থাকবে। ফলে সৎ ও সুষ্ঠু প্রশাসনের জন্ম হবে।

আবার সংযুক্তিকরণ ও বিযুক্তিকরণ উভয় ধরনের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সমস্যার উদ্ভব ঘটে। এসব সমস্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন ব্যবস্থায় পরিলক্ষিত হয়। ভারতের বেলায়ও তা পরিলক্ষিত হয়। ভারতে সরকারি কর্ম কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয় এবং পেশাভিত্তিক সংস্থাকে স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়েছে। ভারতীয় প্রশাসনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, সেখানে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় কায়েমি স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য একটি বিশেষ গোষ্ঠী ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। সংস্থায় কারেন ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যাতে এরূপ স্বার্থের ক্রীড়নকে পরিণত না হয় সে জন্য সরকার তার নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির জন্য বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধনের প্রস্তাব করেন। সরকারের এ উদ্যোগ ছিল সংবদ্ধকরণের উদ্যোগ। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসনের দোহাই দিয়ে সরকারি উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিল।

তবে সংবদ্ধকরণ বা একীভূতকরণ ব্যবস্থার কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ অসুবিধাও রয়েছে। ডব্লিউ. এফ. উইলোবি (W. F. Willoughby) এ সম্পর্কে যে অভিমত ব্যক্ত করে বলেছেন, “সংবদ্ধ ব্যবস্থা সরকারের বহুবিধ কর্মনিয়ত শাখাকে একটি অত্যন্ত সমন্বিত ও একীভূত প্রশাসন যন্ত্রে সম্বন্ধযুক্ত করে। এ ব্যবস্থা শীর্ষস্থানীয় প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণের কার্যকর পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করে। এটা প্রশাসনিক কর্তৃত্ব দায়িত্বের সুনির্দিষ্ট খাত নির্দিষ্টকৃত করে। সংগঠন, কল কারখানা, সরঞ্জাম, কর্মীমণ্ডলী ও কার্যক্রমের পুনরাবৃত্তি বা দ্বিত্বতা আপনাআপনিভাবে রোধ না হলেও এটা রোধ করার ভিত্তি যোগায়। সাধারণ কর্ম তৎপরতার ক্ষেত্রে নিয়োজিত সার্ভিসগুলোর মধ্যে কার্যকরী সমসাময়িক সম্পর্ক গড়ে তোলে যা অন্য কোনভাবে পাওয়া যায় না। এখতিয়ারের পুরাবৃত্তি অথবা দ্বন্দ্ব এড়ানোর পন্থা ও সুযোগ যোগায় এ ব্যবস্থা। সকল প্রশাসনিক ও পদ্ধতি মানসম্মতকরণের সুযোগ সৃষ্টি করে এ ব্যবস্থা। পণ্যের ক্রয়, গুদামজাত ও সরবরাহ করা, কর্মচারী নিয়োগ ও পরিচালনা, হিসাব রক্ষণ, পাঠাগার, গবেষণাগার, নীলনকশা কক্ষ পরিচালনার মতো সাধারণ কায়-কারবার এ ব্যবস্থা কেন্দ্রীভূত হয় এবং পরিবেশে এ ব্যবস্থা যথাযথভাবে সংগঠিত ও পরিচালিত বাজেট পদ্ধতির অপরিহার্য ভিত্তি যোগায়।”

Rate this post