প্রশ্ন: চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি? চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রণয়নের পটভূমি আলোচনা কর।

ভূমিকাঃ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ কর্তৃক ১৭৯৩ সালে অনুমোদিত হয়। সরকার তার রাজস্ব আদায় নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এটি অনুমোদন করে। এতে মূলত : জমিদারদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া সাময়িক ভাবে সরকার লাভবান হলেও দীর্ঘস্থায়ী চিন্তা করলে সরকারের জন্য এটি ছিল ক্ষতিকর।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (Permanent settlement) কিঃ ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ ১৭৬৫ সালে দিল্লীর মোগল সম্রাট শাহ আলমের নিকট থেকে বার্ষিক মাত্র ২৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার রাজস্ব আদায় করার অধিকারী হয়। ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র উদ্দেশ্য ছিল এ দেশ থেকে মুনাফা লুন্ঠন করা। অতঃপর তারা ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থাকে স্থায়ী করার জন্য বিত্তবানদের মধ্যে ‘একশালা’, ‘পাঁচশালা’ ‘দশশালা’ বন্দোবস্ত করে। কিন্তু এতে তারা ব্যর্থ হয়। তখন তৎকালীন গভর্ণর জেনারেল লর্ড কর্ণওয়ালিস ভূমি রাজস্ব বিষয়ে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র নিকট নতুন এক ব্যবস্থার প্রস্তাব করেন। উক্ত প্রস্তাবটি ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ কর্তৃক ১৭৯৩ সালে অনুমোদিত হয়। এটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামে পরিচিত।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রণয়নের পটভূমিঃ নিম্নে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রণয়নের পটভূমি আলোচনা করা হলো-

ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন আমলে ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীর কোন স্থান ছিল না। তার পূর্বে হিন্দু শাসন আমলেও এই ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীর কোন স্থান ছিল না। তৎকালীন সময় সরকার গ্রামের মাতব্বরের সহায়তায় সরাসরি কৃষকদের সাথে যোগাযোগ রাখতো। অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ছিল।

যেমনঃ (এক) কোন কোন হিন্দু রাজা তাদের এলাকা স্বাধীনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন। তারা শুধু বাৎসরি কর প্রদান করতো। (দুই) কোন কোন সরকারি কর্মচারিকে নগদ টাকা বেতন না দিয়ে বিভিন্ন এলাকার রাজস্ব আদায়ের অনুমতি দিতেন। (তিন) কোন কোন ক্ষেত্রে গ্রামের মাতব্বরের উপর নির্ভর না করে সরকারি কর্মচারি সরাসরি কৃষকদের নিকট থেকে রাজস্ব আদায় করে কেন্দ্রীয় কোষাগারে জমা করতেন ইত্যাদি।

‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ দিল্লীর মোগল সম্রাট শাহ আলমের নিকট থেকে বার্ষিক মাত্র ২৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার রাজস্ব আদায় করার অধিকারী হয়। ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র উদ্দেশ্য ছিল এ দেশ থেকে মুনাফা লুণ্ঠন করা।

অল্প দিনেই শুরু হয় লুটতরাজ ও ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জন। কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন অনিয়ম ও সমস্যার কারণে কৃষকগণ দারুণ সংকটে পড়ে যায়। একদিকে খরা ও দুর্ভিক্ষ অন্যদিকে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র লুটতরাজ। সবমিলিয়ে শুরু হয় বাংলা ১১৭৬ সালের মনন্তর। যা ‘ছিয়াত্তরের মনন্তর’ নামে আজও বেশ পরিচিত।

অতঃপর তারা ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থাকে স্থায়ী করার জন্য বিত্তবানদের মধ্যে ‘একশালা’, ‘পাঁচশালা’, ‘দশশালা’ বন্দোবস্ত করে। কিন্তু এতে তারা ব্যর্থ হয়। তখন তৎকালীন গভর্ণর জেনারেল লর্ড কর্ণওয়ালিস ভূমি রাজস্ব বিষয়ে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র নিকট নতুন এক ব্যবস্থার প্রস্তাব করেন। উক্ত প্রস্তাবটি ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ কর্তৃক ১৭৯৩ সালে অনুমোদিত হয়। এটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামে পরিচিত।

এই ব্যবস্থার মাধ্যমে বিত্তবানদেরকে নির্দিষ্ট এলাকার ভূমি চিরদিনের জন্য মালিকানা স্বত্ব দেয়া হয়। বিনিময়ে বছরে নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব কোম্পানিতে জমা দিতে হবে।

এভাবে রাজস্ব প্রদান করতে থাকলে ভবিষ্যতে জমির মূল্য যতই বৃদ্ধি হোক না কেন উক্ত এলাকা বংশপরম্পরায় তাদেরই মালিকানায় থাকবে।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বৈশিষ্ট্যঃ নিম্নে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো-

(১) জমিদারী খণ্ডিতকরণ : চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বৃহৎ জমিদারীগুলিকে খণ্ড খণ্ড করে। যার ফলে সামাজিক বিপ্লব ঘটতে শুরু করে।

(২) জমিদারী হস্তান্তর : চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিত্তবানদের মধ্যে বাৎসরিক নির্দিষ্ট রাজস্বের বিনিময়ে জমিদারী হস্তান্তর করে। বংশানুক্রমে এই জমিদারী তারা হস্তান্তর করতে পারেন।

(৩) ভূ-সম্পত্তি বিক্রি বা দান : প্রচলিত আইনের বিরোধী না হলে জমিদারীর কোন ভূ-সম্পত্তি দান বা বিক্রির বিধান চালু হয়।

(৪) কৃষিতে উন্নয়ন : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে জমিদারগণ তাদের স্ব স্ব সম্পত্তির কৃষি উন্নয়নের একক সুবিধা পায়। যারফলে কৃষিতে উন্নতি হতে থাকে।

(৫) সরকারি খাজনা স্থায়ীকরণ : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে সরকারি রাজস্ব নিশ্চিত ও স্থায়ী করা হয়। অর্থাৎ জমিদারকে রাজস্ব অবশ্যই দিতে হবে। অন্যথা তার জমিদারীর একটি অংশ বিক্রি করে সরকার রাজস্ব আদায় করবে।

(৬) প্রজাদের অনিশ্চিত স্বার্থ : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে জমিদারদের স্বার্থ নিশ্চিত ও স্থায়ী হলেও প্রজাদের স্বার্থ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

(৭) জমিদারীর মালিকানা প্রদান : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে সরকার বিত্তবানদেরকে জমিদারীর মালিকানা প্রদান করেন।

(৮) জমিদারদের ব্যক্তিগত অধিকার রক্ষা : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে জমিদারগণ ব্যক্তিগত অধিকার ভোগ করতে পারতেন। যেমনঃ ফল, মাছ, বনজসম্পদ, কাঠ, খনিজসম্পদ, গো-চারণ ইত্যাদি ভোগ করার অধিকার লাভ করেন।

উপসংহারঃ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দীর্ঘস্থায়ী ভাবে সরকারের যেমন ক্ষতি তেমন জমিদারদের জন্যও ক্ষতির কারণ ছিল। যেমনঃ বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষ, মহামারি যা-ই হোক না কেন নির্দিষ্ট রাজস্ব দিতেই হবে। এই সকল অজুতাতে রাজস্ব মওকূফ বা লাঘবের আবেদন করা যাবে না। কোন জমিদার তার রাজস্ব দিতে না পারলে তার জমিদারীর একটি অংশ বিক্রি করে সরকার রাজস্ব আদায় করবে।

1/5 - (1 vote)