প্রশ্নঃ ইলা মিত্র কীভাবে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে?

উত্তরঃ সেলিনা হােসেনের ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’ উপন্যাসে ইলা মিত্রের ধরা পড়ার দৃশ্য বর্ণিত হয়েছে; আসলে তারা পথ ভুল করে সােজাসুজি সেনাবাহিনী-পুলিশের সীমানার মধ্যে ঢুকে পড়ার কারণে ইলা মিত্র ধরা পড়ে।

ইলা মিত্রের স্বামী রমেন মিত্র কেবল জমিদার তনয় নয়, নাচোল অঞ্চলে গড়ে ওঠা কৃষক আন্দোলনের প্রথম সারির রাজনৈতিক সংগঠক ও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। প্রথম দিকে রমেন মিত্রের রাজনৈতিক ক্ষেত্র ছিল সাঁওতাল পল্পি সেখান থেকে ধীরে ধীরে তাকে আমরা বিভিন্ন অঞ্চলে দেখতে পাই। রমেনের কর্মতৎপরতায় সাঁওতাল যুবক মাতলা সর্দার, হরেক অনেকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। অন্যদিকে নিছক গৃহবধূ হিসেবে জমিদার বাড়িতে ইলা মিত্রের আগমন হয়নি, তিনি এসেছেন স্বামীর উপযুক্ত সঙ্গী ও সহযােদ্ধা হিসেবে মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন ও শােষণমুক্তির সংগ্রামে অংশ নিতে। কেবল মেয়েদের স্কুল পরিচালনা নয় একই সঙ্গে ইলা মিত্র যুক্ত হন কৃষক সভা ও কমিউনিস্ট পার্টির কাজে। পুলিশি তৎপরতার মুখে আত্মগােপনে থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে থাকেন। ক্রমে ক্রমে ইলা মিত্র হয়ে ওঠেন সবার রানিমা। পুলিশের দমন নীতি চরম পর্যায়ে পৌছালে ইলা মিত্র প্রীতিলতার মতাে আত্মত্যাগের মন্ত্রে উজ্জীবিত হন। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরােয়ানা জারি হয়। অভিযান চলে তাকে জীবিত কিংবা মৃত ধরার জন্য। কিন্তু ইলা মিত্র সংগ্রামে থাকেন অবিচল। অসম শক্তি নিয়ে তৎকালীন পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকারের সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যান তিনি। চার পুলিশের খুনের পর সাধারণ চাষিদের উপর পাকিস্তানি পুলিশ শুরু করে নারকীয় অত্যাচার। চারজন পুলিশ নিহত হলে ইলা এবং রমেনের উপস্থিতি বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।

পুলিশ হত্যা এবং তেভাগা আন্দোলনে সংগঠনের ভূমিকা পালন করায় জন্য ইলা মিত্র এবং রমেন মিত্রের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরােয়ানা জারি হয়। অন্যদিকে রাজশাহী থেকে সীতাংশু মিত্র খবর পাঠায় কাজ করার সুবিধার্থে পার্টির সদস্যদের আত্মগােপন করে থাকতে। সেদিন আর তাদের কিছু করার ছিল না। আত্মগােপনকারী রমেন মিত্রের সঙ্গে স্বজন বিয়ােগব্যথায় কাতর লােকেরা পথ হাঁটতে লাগল। এদিকে রমেন মিত্রের চিন্তা, ইলা মিত্র ধরা পড়েনি তাে? অন্যদিকে ইলা মিত্রকে ঘিরে যে চারশাে স্বেচ্ছাসেবক, তাদের মনেও একই চিন্তা। খুব শিগগির রানিমাকে সীমান্ত পেরিয়ে পালাতে হবে, কারণ মুসলিম লীগ যে সাম্প্রদায়িক বিষ মানুষের মনে ঢােকাতে শুরু করেছে, তার শুরু দেখা গেলেও শেষ কোথায় তা একেবারেই অজানা, পরিষ্কার সাওতাল ভাষা বলতে পারা ইলা মিত্র সীমান্ত পেরিয়ে যাবার জন্য সাঁওতাল মেয়ের ছদ্মবেশই ধারণ করলেন অবশেষে। কিন্তু এত চেষ্টার পরও শুধু চন্দ্রালােকিত রাতে পথ ভুল করার ফলে ঘটনাচক্রে রােহনপুর স্টেশনে পাকিস্তানি পুলিশের হাতে তিনি ধরা পড়েন। ছদ্মবেশী ইলার পরিচয় পুলিশের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল যে এ নারী সাঁওতাল মেয়ে নয়- ওর চোখ বলে ও সাঁওতাল রমণী নয়। পুলিশ স্পষ্ট বুঝতে পারে ছদ্মবেশের আড়ালে অন্য কেউ লুকিয়ে আছে। লেখক ইলা মিত্রের ধরা পড়ার কাহিনিটি বর্ণনা দিয়েছে এভাবে-

“স্টেশনের কাছাকাছি পৌছুতেই রক্তশূন্য হয়ে যায় ইলার চেহারা। এ কোথায় এসেছি? এরা কারা? সামনে সেনাবাহিনীর ছাউনি, খাকি পােশক পর রাইফেলধারী বাহিনী টহল দিচ্ছে। পথ ভুল করে ওরা শত্রুর ঘাঁটিতে এসে উঠছে, এখন আর পিছু হটার উপায় নেই।… সশস্ত্রবাহিনীর মধ্যে কানাকানি, ফিসফিস, ওরা কিছু একটা অনুমান করেছে, ভিড়ের মধ্যে বসে থেকে সেটা আঁচ করতে পারে ইলা, ওর ভেতরে কম্পন।… অফিসার এগিয়ে এসে হাত ধরে টেনে ওঠায় ইলাকে। চুলের মুঠি ধরতেই খোঁপা খুলে ছড়িয়ে যায় চুল। ভিড়ের একপাশে এসে দাঁড়ার অফিসার।.. তুমি ইলা মিত্র! ঠিকই বুঝেছি, তুমি ডাইন, যে হত্যার আগুন জ্বালিয়ে নরক বানিয়েছ।”

এরপর ইলা মিত্রের ওপর চালানাে হয় নৃশংস অত্যাচার। কিন্তু মধ্যযুগীয় সে বর্বরতা হার মানে ইলা মিত্রের মানসিক দৃঢ়তার কাছে। ইলার ওপর বুটের লাথি, ঘুষি, বেত্রাঘাত আর চাবুকের ঝড় বয়ে যায়- তবু সে নিজ মুখে কোনাে কিছু বলেনি।

Rate this post