প্রশ্নঃ মানব সভ্যতায় নব্য প্রস্তর যুগের অবদান আলােচনা কর।

অথবা, সভ্যতার বিকাশে নব্য প্রস্তর যুগের ভুমিকা কী?

ভূমিকাঃ আধুনিক সভ্য জগৎ একদিন বা এক বছরে সৃষ্টি হয়নি। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আধুনিক সভ্য জগতের অভ্যুদয় হয়েছে। প্রত্নতত্ত্ববিদগণ বিভিন্ন গবেষণা চালিয়ে বিভিন্ন যুগের নিদর্শন আবিষ্কার করেছেন। খনন কাজ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রত্নতাত্ত্বিকগণ প্রাগৈতিহাসিক কালকে কতিপয় সুনির্দিষ্ট যুগে বিভক্ত করেছেন। এগুলাে প্রাচীন প্রস্তর যুগ, নব্য প্রস্তর যুগ, ব্রোঞ্জ যুগ এবং লৌহ যুগ। প্রত্নতত্ত্ববিদগণ প্রাগৈতিহাসিক যুগের সংস্কৃতির কথা বলতে গিয়ে মানুষ সে সময় যেসব পাথরের অস্ত্র ব্যবহার করেছে তার বর্ণনা করেন।

মানব সভ্যতায় নব্য প্রস্তর যুগের ভূমিকাঃ নব্য প্রস্তর যুগে উত্তরণে প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষের ক্রমােন্নতি ঘটে। মানুষের উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ এক ধাপ এগিয়ে যায়। তাই মানব সভ্যতার বিকাশে এ যুগের আবদান অপরিসীম।

(১) মাটির পাত্র তৈরীঃ মাটির পাত্র তৈরী এ যুগের উল্লেখযােগ্য অবদান। এ সময় মানুষ মাটির সাহায্যে পাত্র তৈরী করতে শেখে। ফলে রান্না বান্নায় নতুন নতুন পদ্ধতির উদ্ভব ঘটে। তাছাড়া এ যুগে মাটির পাত্রে পানি রাখা থেকে শুরু করে অন্যান্য অতি প্রয়ােজনীয় দ্রব্য রাখা শুরু হয়। সভ্যতার অগ্রযাত্রায় এ যুগের মানুষ এক ধাপ এগিয়ে যায়।

(২) শিকারের যন্ত্র আবিষ্কারঃ যদিও পুরাতন পাথরের যুগেই মানুষ বিভিন্ন প্রকারের শিকারের যন্ত্র আবিষ্কার করেছিল, কিন্তু সেগুলাে ছিল খুবই ভােতা ও অনুন্নত। নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ তীর ধনুক এবং নানা ধরনের হাতল যুক্ত কুঠার আবিষ্কার করে। এ যুগের হাতিয়ারগুলাে ছিল পুরাতন প্রস্তর যুগের তুলনায় খুবই উন্নত।

(৩) কৃষির আবিষ্কারঃ কৃষির আবিষ্কার নিঃসন্দেহে মানব সভ্যতার এক মহা আবিষ্কার। আর তা নব্য প্রস্তর এ যুগেরই শ্রেষ্ঠ অবদান। জীবিকা নির্বাহের জন্য মানুষ যখন হন্যে হয়ে ঘুরতাে, মনের জালা নিবারণের জন্য যখন মানুষের একমাত্র অবলম্বন ছিল বন্য ফলমূল ও পশুপাখি, তখন কৃষির আবিষ্কার তাদের জীবনে স্বর্গীয় সুখ এনে দেয়।

(৪) সময়ের হিসাব নির্মাণঃ নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ শুধু পাথরের যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেই শান্ত হয় নি। এ সময়ে তারা শিকার ও কৃষিকাজের প্রয়ােজনে সময়ের হিসাবও রাখতে শিখলাে। প্রথমেই তারা হিসাবের সুবিধার্থে জ্যোৎস্না রাতের হিসাব শুরু করলাে। অতঃপর চাঁদে গতির হিসাবও রাখতে শুরু করার সাথে সাথে ঋতু পরিবর্তনের হিসাব করতে শেখে।

(৫) চাকার গাড়ির উদ্ভাবনঃ চাকাওয়ালা গাড়ির আবিষ্কার নব্য প্রস্তর যুগের অবদানগুলাের মধ্যে অন্যতম। এ অভিনব আবিষ্কার মানব সভ্যতাকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। নব্য প্রস্তর যুগের এ সংযােজন মানুষের যােগাযােগ ব্যবস্থায় চুড়ান্ত সাফল্য বয়ে আনে।

(৬) সুতা ও সুতার তৈরী বস্ত্র আবিষ্কারঃ আঁশ থেকে সুতা তৈরী এবং সুতার সাহায্যে পােশাক তৈরী ও ব্যবহার নব্য প্রস্তর যুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এ সময় মানুষ পশমের তৈরী পােশাকের প্রচলন করে। এ যুগে মুক্ত তুলা থেকে তৈরী বস্ত্রের ব্যবহার শুধু মানুষের শীত নিবারণ করেইনি বরং তা উলঙ্গ থাকায় অভ্যস্ত মানুষকে সভ্য বানিয়েছে।

(৭) জলপথের উন্নতিঃ জলপথের যােগাযােগ ব্যবস্থায় অনন্য অবদানের ক্ষেত্রে নব্য প্রস্তর যুগের আরেকটি নব্য সংযােজন হলাে পালওয়ালা নৌকার আবিষ্কার। এ আবিষ্কারের পূর্বে মানুষ তক্তা জোড়া দিয়ে নৌকা তৈরী করতাে। এযুগে জলপথের মাধ্যমে যােগাযােগ মাধ্যম তথা বিশেষ ব্যবস্থা তৈরী হওয়ায় সামাজিক জীবনে যােগাযােগের ক্ষেত্রে পরিবর্তনের দেখা মেলে।

(৮) সম্পতির ধারণা লাভঃ এ যুগের মানুষের মধ্যে কোনাে সম্পত্তির ধারণা ছিল না। তারা যা দিয়ে শিকার করতাে সেটিই ছিল তাদের সম্পত্তি। কিন্তু নব্য প্রস্তর যুগের উত্তরণের ফলে মানুষের মধ্যে সম্পত্তির ধারণা জন্মে। যার ফলশ্রুতি হিসেবে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব হিসেবে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব হয়।

(৯) চিকিৎসা ব্যবস্থাঃ এ যুগের মানুষ বিশ্বাস করতাে যে, সম্পদে তাদের প্রভাবে মানুষের বিভিন্ন রােগ হয়। আর এ ধরনের ব্যাধি থেকে মুক্তির জন্য তারা যাদু বিদ্যার সাহায্য নিত। নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ দ্রুত রােগ সারানাের জন্য বিভিন্ন ধরনের গাছ পালা, গুল্ম, লতা-পাতা ও বিভিন্ন গুল্মের ব্যবহার করতাে।

(১০) ভাষার উদ্ভবঃ এ যুগের মানুষ সর্বপ্রথম ভাষার সাহায্যে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করতাে। তারা ঈশারা বা ইঙ্গিতের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করতাে। এ যুগের মানুষের ভাষা যেমন ছিল তার সঠিক ব্যখ্যা জানা না গেলেও তারা যে চিত্রাঙ্কন পদ্ধতি আয়ত্ত করেছিল তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

(১১) বিনিময়ের মাধ্যমঃ এ যুগের মানুষেরা একই এলাকায় বসবাসরত মানুষের মধ্যে তাদের প্রয়ােজনীয় দ্রব্যটির আদান প্রদান করতাে। কৃষকের উদ্বৃত্ত ফসল, পশু-পলকদের সরবরাহ কৃত মাংস, দুধ, চামড়া, তাতীদের কাপড়, কুমারের মাটির হাড়ি, জেলেদের মাছ প্রভৃতি বিনিময়ের মাধ্যমে পরস্পরের অভাব মেটাত।

(১২) অলংকার নির্মাণঃ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নব্য প্রস্তুর যুগের মানুষ অত্যন্ত সৌন্দর্য প্রিয় ছিল। ছেলে মেয়ে, নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই অলংকার পরতাে। অবসর সময়ে তারা সাজসজ্জা করতাে। তারা সকলে শরীরে উল্কি ব্যবহার করতাে। মেয়েরা গলায়, হাতে, পায়ে পুঁথির মালা পরতাে। মূলত এ যুগের অলংকার সৌন্দর্য প্রিয় মানুষের অভিরুচিরই বহিঃপ্রকাশ।

পরিশেষঃ পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, এ যুগের ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ। যা মানব সভতায় বিশেষ সময় হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। প্রস্তর যুগের বিভিন্ন দিকগুলাে নানা দিক দিয়ে সমৃদ্ধ হয়ে আছে। সভ্যতার ইতিহাসে তাদের বিভিন্ন উৎকর্ষতা এ যুগকে গৌরবােজ্জ্বল করে রেখেছে। তাদের সংস্কৃতি ও জীবন যাত্রায় বিভিন্ন দিক থাকলেও ভাষার উদ্ভব, বিনিময়ের মাধ্যম কৃষিক্ষেত্র তৈরী ও অলংকার ব্যবস্থার ক্ষেত্রগুলাে সবদিক থেকে এগিয়ে ছিল।

Rate this post