প্রশ্নঃ সমাজজীবনে প্রভাব বিস্তারকারী উপাদানসমূহ কী কী? সমাজ জীবন কীভাবে কৃৎকৌশল/সংস্কৃতির উপাদান দ্বারা প্রভাবিত হয়? উপযুক্ত উদাহরণসহ ব্যাখ্যা কর।

অথবা, সমাজ জীবনে প্রভাব বিস্তারকারি মৌল উপাদানগুলাের মধ্যে কৃৎকৌশল বা উৎপাদন কৌশলের প্রভাব আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ সমাজজীবন কিছু মৌল উপাদান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। এই মৌল উপাদান দ্বারাই মূলত সমাজজীবন পরিচালিত হয়ে থাকে। তবে সমাজজীবন একদিকে যেমন ভৌগােলিক দিক দিয়ে প্রভাবিত হয় তেমনি কখনাে বংশগতি বা জৈবিক উপাদান দ্বারাও প্রভাবিত হতে পারে। তবে সমাজজীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সংস্কৃতি বা কৃৎকৌশল। তাহলে দেখা যাচ্ছে, কিছু মৌলিক উপাদান সমাজজীবনকে সঠিক পথনির্দেশনা যেমন দান করে তেমনি সমাজকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ব্যক্তিগত জীবনের ওপর সংস্কৃতির প্রভাবঃ মানুষের সামাজিক জীবনে যে উপাদানগুলাে প্রভাব বিস্তার করে তার মধ্যে সংস্কৃতি অন্যতম। তবে সংস্কৃতি হচ্ছে সামাজিক জীবনের একটি সক্রিয় উপাদান যা সমাজের সমগ্র বিষয়ের ওপরই প্রভাব বিস্তার করে থাকে। সমাজজীবনে সংস্কৃতির প্রভাব আমরা দু’টি ভাগে সাধারণত দেখে থাকি।

(ক) ব্যক্তিগত জীবনে সংস্কৃতির প্রভাবঃ সংস্কৃতি হলাে ব্যক্তির আচরণের সামষ্টিক রূপ। সাধারণ ব্যক্তি যে কর্ম করে তাই সংস্কৃতি। তাই সমাজের মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের ওপর সংস্কৃতির প্রভাব বিভিন্ন দিক থেকে হতে পারে। নিম্নে এগুলাে নিয়ে আলােচনা করা হলাে-

(১) আচরণের নির্দিষ্টতাঃ সংস্কৃতি সমাজস্থ মানুষের আচরণের নির্দিষ্টতা নিশ্চিত করে দেয়। ব্যক্তির স্বকীয় ইচ্ছার বহিপ্রকাশ সে ইচ্ছা করলেই করতে পারে না। সংস্কৃতি তার আচরণের মধ্যে কোন কাজটি করতে পারবে কোনটি পারবে না তা নির্দিষ্ট করে দেয়।

(২) ব্যক্তিকে সমাজের সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠাঃ সংস্কৃতি একজন ব্যক্তির সামনে তুলে ধরে একটি পরিপূর্ণ জীবন আদর্শ। ব্যক্তি পােশাক-পরিচ্ছদ থেকে শুরু করে সমাজজীবনের বিভিন্ন দিক সংস্কৃতির মাধ্যমেই গ্রহণ করে। ব্যক্তির আচার-আচরণ, সংস্কৃতিই নিয়ন্ত্রণ করে এবং ব্যক্তিকে পূর্ণ সামাজিক সদস্যরূপে প্রকাশ করে।

(খ) গােষ্ঠীগত জীবনে সংস্কৃতির প্রভাবঃ ব্যক্তির আচরণ যখন সীমারেখার মধ্যে থাকে না তখন ব্যক্তির আচরণ নিয়ে রচিত হয় গােষ্ঠীগত জীবন। গােষ্ঠীগত জীবনের বিভিন্ন দিক কীভাবে সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয় তা নিম্নে তুলে ধরা হলাে-

(১) মনমানসিকতার সৃষ্টিঃ যেকোনাে একটি সমাজের মানুষের মধ্যে সংস্কৃতি এক ধরনের সম্প্রদায়গত বােধের সষ্টি করে থাকে। এখানে উদাহরণ হিসেবে আমরা উপজাতীয় সংস্কৃতির কথা উল্লেখ করতে পারি।

(২) সামাজিক সংহতি রক্ষাঃ সমাজের মধ্যে শৃঙ্খলা ও সংহতি রক্ষায় সংস্কৃতি বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। পৃথিবীর যেকোনাে দেশের সমাজব্যবস্থায় সংস্কৃতির এ ভূমিকার গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিতর্কের ঊর্ধ্বে। এভাবে সংস্কৃতির প্রভাব গােষ্ঠিগত জীবনের অস্তিত্ব রক্ষা করে। ফলে গােষ্ঠিজীবনের অস্তিত্বের সাথে সংস্কৃতি বন্ধন রক্ষা করে, যা সংস্কৃতির প্রভাবেই ঘটে থাকে।

(৩) রাজনৈতিক দক্ষতা এবং গণতান্ত্রিক নিষ্ঠাচারের জন্মঃ একটি জাতি কতটুকু রাজনৈতিকভাবে দক্ষ ও গণতান্ত্রিক নিষ্ঠাচার তা নির্ভর করে থাকে ঐ জাতির ঐতিহ্যগতভাবে রাজনৈতিক সচেতনতার ওপরে। সমাজজীবনে প্রভাবকারী যে উপাদানগুলাে রয়েছে তার মধ্যে সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে থাকে।

সমাজজীবনে বংশগতি/জৈবিক উপাদানের প্রভাবঃ সমাজজীবনের ওপর যে চারটি মৌল উপাদান গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে তন্মধ্যে বংশগতি/জৈবিক উপাদান অন্যতম। নিচে সমাজজীবনের ওপর এর প্রভাব আলােচনা করা হলাে-

(১) বুদ্ধিমত্তা বিকাশেঃ একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বুদ্ধিমত্তা (I.Q) উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিদের সন্তান সন্ততি অপেক্ষা অশিক্ষিত ব্যক্তিদের সন্তান-সন্ততিদের অনেক বেশি। সুতরাং এটা প্রমাণিত হয় যে, বংশগতি বুদ্ধিমত্তা নিরূপণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

(২) সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায়ঃ সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায়ও বংশগতি বিশেষ ভূমিকা রাখে। আদিম সমাজের সামাজিক স্তরবিন্যাসে রক্ত, বংশ এবং জৈবিক নির্বাচন- এগুলাের মাধ্যমে সামাজিক মর্যাদা নিরূপিত হতাে। যেমনঃ গ্রিস ও রােমের অভিজাত ও দাস, পেট্টিসিয়ান ও প্লেবিয়ান ইত্যাদি শ্রেণির মূলে ছিল রক্ত ও বংশগত বিভিন্নতা।

(৩) সামাজিক অবস্থান নির্ধারণেঃ সামাজিক শ্রেণি ও অবস্থান নির্ধারণের ক্ষেত্রে বংশগতির প্রভাব প্ল্যাটো, এরিস্টটলের আলােচনায় পরিলক্ষিত হয়। তাদের বক্তব্য হলাে- প্রজ্ঞা, বল, শক্তি এবং লােভ-লালসা মানুষের মধ্যে জন্মগতভাবে অসমভাবে বন্টিত হয়। ফলে সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। যেমনঃ প্রজ্ঞাবান, বলবান এবং সাধারণ কৃষক। এরিস্টটলের মতে, জন্মগতভাবেই কেউ মনিব, কেউ দাসরূপে প্রকাশিত হয়।

(৪) সামাজিক স্তর বিন্যাসেঃ বংশগতি সামাজিক স্তরায়ণে বিশেষ প্রভাব রাখে। সাধারণত রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থায় বংশ মর্যাদাকেই প্রাধান্য দিয়ে সমাজকে স্তরায়িত করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, হিন্দু সম্প্রদায়ের জাতবর্ণ প্রথা ও সামাজিক শ্রেণি ও স্তরবিন্যাসকে দাঁড় করানাে যায়।

(৫) উত্তরাধিকার রক্ষায়ঃ বংশগতি সমাজে স্থায়ী সংগঠনের উত্তরাধিকার রক্ষায় সুবিশাল ভূমিকা রাখে। জনুগ্রহণকারি যেকোনাে শিশু উত্তরাধিকার সূত্রে পিতামাতার দৈহিক গঠন প্রকৃতি ও মানবীয় গুণাবলি অর্জন করে এবং তা ঐ পূর্ণতাপ্রাপ্ত শিশুর মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মেও ধারণ করে। সুতরাং বংশগতি সামাজিক জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়।

(৬) রাজনীতি চর্চায়ঃ রাজনীতিক ক্ষেত্রেও বংশগতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদাহরণস্বরূপ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলাের বাদশাহী শাসনব্যবস্থা এবং বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্রতম দেশগুলাের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বংশগতি বা বংশগত প্রভাব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

পরিশেষঃ সামগ্রিক আলােচনার শেষে যে বিষয়টি পরিস্ফুট হয়ে ওঠে তা হলাে সমাজজীবনে প্রভাব বিস্তারকারি উপাদানগুলাের মধ্যে কৃৎকৌশল/সংস্কৃতি বা বংশগতির প্রভাব বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সমাজজীবনের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে তাই উপযুক্ত উপাদান দুটির ভূমিকা বা প্রভাব বেশ ভালােভাবেই পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। অন্যভাবে বলতে গেলে সমাজের মানুষ পরিবেশকে আঁকড়ে ধরে বসবাস করার জন্য এবং সংস্কৃতি, উৎপাদন কৌশল এবং বংশগতি সে সমাজে জীবনের পূর্ণতা দান করে থাকে।

Rate this post