প্রশ্নঃ জাতীয়তাবাদ কী আন্তর্জাতিকতার পরিপন্থী- আলােচনা কর।

অথবা, জাতীয়তাবাদ কী আন্তর্জাতিকতার বিরােধী- আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ আধুনিক সভ্যতার এ যুগে বিশ্বের মানুষ পরস্পর কাছাকাছি হয়ে আসছে। পৃথিবীর এক কোণের কোনাে ঘটনা অল্প সময়ের মধ্যে অন্যত্র পৌঁছে যাচ্ছে এবং তার প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। মানুষের চিন্তা-চেতনা আজ শুধু নিজ রাষ্ট্রে সীমাবদ্ধ নেই। এভাবে বিশ্বের সব দেশের নাগরিকই আজ বিশ্ব নাগরিকে পরিণত হয়েছে। তাই জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিকতাবাদও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছে।

জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞাঃ একই ভৌগােলিক সীমানায় বসবাসরত সমগ্র জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবােধের ওপর অন্যকোনাে ভৌগােলিক সীমারেখায় অবস্থিত মানুষের আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনমতকে ঐক্যবদ্ধ করে সংগ্রাম পরিচালনা করার মানসিকতা হলাে জাতীয়তাবাদ। অর্থাৎ যখন কোনাে জনসমষ্টির মধ্যে ভাষাগত ঐক্য, সাংস্কৃতিক ঐক্য, জীবনধারণগত ঐক্য দেখা দেয় তখন তাদের মধ্যে জাতীয়তাবােধের সৃষ্টি হয়।

আন্তর্জাতিকতাবাদের সংজ্ঞাঃ বর্তমানে প্রতিটি জাতিরাষ্ট্রই অর্থনৈতিক রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরস্পরের ওপর অধিক মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় কোনাে জাতির একক ইচ্ছার অবাধ প্রকাশ অভিপ্রেত নয়। মানবজাতির ঐক্য ও বিশ্বভ্রাতৃত্ব হলাে আন্তর্জাতিকতার মূল কথা। জাতীয়তাবাদের ন্যায় আন্তর্জাতিকও হলাে একটি মানসিক অনুভূতি। এই অনুভূতির জন্য ব্যক্তির মনে তার নিজ রাষ্ট্রের নাগরিকতার সঙ্গে সঙ্গে সারা বিশ্বের নাগরিকতার ধারণাও জন্মায়। ব্যক্তির নাগরিকতার ধারণা তার জাতীয় রাষ্ট্রের সংকীর্ণ সীমানা অতিক্রম করে বিশ্বব্যাপী হয়। ব্যক্তি নিজেকে বিশ্বের একজন নাগরিক হিসেবে ভাবতে থাকে।

জাতীয়তাবাদ কী আন্তর্জাতিকতার পরিপন্থীঃ অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মতপ্রকাশ করেছেন যে, জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকবাদের পরিপন্থি। উগ্র জাতীয়তাবাদ বিশ্বশান্তি ও সুষ্ঠু মানসিক বিকাশের পরিপন্থি। বিভিন্ন কারণে জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিপন্থী। নিম্নে প্রধান প্রধান কারণগুলি আলােচনা করা হলাে-

(১) বিশ্বশান্তির প্রতি হুমকিঃ উগ্র জাতীয়তাবাদ বিশ্বশান্তির প্রতি এক বিরাট হুমকি। উগ্র জাতীয়তাবাদীরা শুধু শক্তি প্রয়ােগ ও নিজ শক্তি অর্জনের নীতিতে বিশ্বাসী। অন্যের স্বার্থ ও শান্তি উগ্র জাতীয়তাবাদীরা বিবেচনায় আনে না, ফলে বিশ্বশান্তি হুমকির সম্মুখীন হয়।

(২) জাতিবিদ্বেষ সৃষ্টিঃ উগ্র জাতীয়তাবাদ জাতিতে জাতিতে সম্প্রীতির বদলে বিদ্বেষ সৃষ্টি করে। জাতীয়তাবাদ নিজ জাতির প্রতি গর্ব, দাম্ভিকতা সৃষ্টি করে এবং অন্য জাতির প্রতি হিংসা-বিদ্বেষের মানসিকতা সৃষ্টি করে। ফলে জাতিতে-জাতিতে বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়।

(৩) দুর্বলের ওপর আক্রমণঃ উগ্র জাতীয়তাবাদীরা দুর্বল বা দুর্বল জাতির ওপর আক্রমণ চালাতে মােটেও কুণ্ঠাবােধ করে না। তারা বিভিন্ন দুর্বল জাতিকে শােষণ করে। বর্তমান বিশ্বের দিকেই তাকলে আমরা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ দেখতে পাব। যেমন-সাম্প্রতিককালের ইরাক সংকট। তা ছাড়া ফিলিস্তিনের কথা বলা যায়।

(৪) বিশ্ব নিরাপত্তা বিনষ্টঃ জাতীয়তাবাদ বিশ্ব নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটায়। উগ্র জাতীয়তাবাদী ধারণার ফলে জাতিতে জাতিতে সমর সজ্জার প্রতিযােগিতা ও যুদ্ধপ্রস্তুতি বৃদ্ধি পায়, ফলে বিশ্ব নিরাপত্তা বিনষ্ট হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে উগ্রজাতীয়তাবাদী জার্মানি, ইটালি, জাপান এভাবে বিশ্বশান্তি ও সৌভ্রাতৃত্ব ধ্বংস করে ফেলেছিল।

(৫) সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি হুমকিঃ উগ্র জাতীয়তাবাদ সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি মারাত্মক হুমকি। সমরাস্ত্র প্রতিযােগিতা ও বিভিন্ন জাতির মধ্যে যুদ্ধপ্রস্তুতির ফলে যেকেনাে সময় মানবসভ্যতা ও সংস্কৃতি ধ্বংস হতে পারে। কেননা উগ্র জাতীয়তাবাদ ভৌগােলিক সীমারেখাকে সীমিত করে বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণের পথ রুদ্ধ করে দেয়।

(৬) সাম্রাজ্যবাদে পরিণতঃ উগ্র জাতীয়তাবাদ ক্রমে ক্রমে সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হয়। নিজ জাতির শ্রেষ্ঠত্ব ও গর্ব বৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্রের শক্তি ও কর্তৃত্ব বাড়ানাে হয়। অধ্যাপক লাস্কি বলেন, ক্ষমতা যখন বেড়ে যায় জাতীয়তাবাদ তখন সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হয়।

(৭) ঔপনিবেশিকতাবাদে পরিণতঃ উগ্র জাতীয়তাবাদের ফলে শিল্পায়িত ধনী রাষ্ট্রসমূহ নিজেদের শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহ ও শিল্পায়িত দ্রব্যসামগ্রী বাজারজাত করার জন্য অনুন্নত দেশগুলােতে উপনিবেশ স্থাপন করে। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

(৮) শক্তি হ্রাসের হাতিয়ারঃ জাতিয়তাবাদ শক্তিহ্রাসের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। কোনাে বহত্তর জাতির শক্তি হ্রাস করার জন্য তাদের মধ্যে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জনগােষ্ঠীর মধ্যে জাতীয়তাবােধের ধারণা দেওয়া হলে, তাদের মধ্যে একতা বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যাতে তাদের শক্তি হ্রাস পায়।

(৯) শােষণের মূলমন্ত্রঃ জাতীয়তাবাদের ধারণা শােষণের মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করে। যেমন ব্রিটিশ সরকার তার ভাগ কর, শাসন কর, নীতি মূলত জাতীয়তাবাদের ধারণা দিয়ে শােষণের পথ উন্মুক্ত করা। তাই জাতীয়তাবাদকে শােষণের মূলমন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।

(১০) অন্যায়-অবিচারের উৎসঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী Hayes বলেন, উগ্র জাতীয়তাবাদ অন্যায়-অমঙ্গলের উৎসস্থল। রবীন্দ্রনাথ বলেন, জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতার শত্রু। জাতীয়তাবাদের এ উগ্র, হিংস্র ও বীভৎস প্রকাশ গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা ও মানবিক চেতনার পরিপন্থি।

(১১) সংকীর্ণতার জন্ম দেয়ঃ উগ্র জাতীয়তাবাদ সংকীর্ণতার ও সংকীর্ণ মানসিকতার জন্ম দেয়। ফলে মানুষের মৌলিক ও মানবিক গুণের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। কেননা জাতীয়তাবাদের অন্ধ আবেগ ও উন্মাদনার ফলে দেশ ও জাতির সবকিছু এক বাঁধাধরা নির্দিষ্ট পথে পরিচালিত হয়।

(১২) সন্দেহ ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টিঃ বর্তমানে উগ্র জাতীয়তাবাদ এমন একটি পরিবেশের সৃষ্টি করেছে, যার ফলে সন্দেহ ও দ্বন্দ্ব লেগেই আছে। প্রতিটি জাতীয় রাষ্ট্র অপর প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে। এ ধরনের সন্দেহ জ্বালাময় পরিবেশ শান্তি ও উন্নতির পরিপন্থী।

(১৩) যুদ্ধঃ উগ্র জাতীয়তাবাদ ও যুদ্ধ একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আদর্শভ্রষ্ট জাতীয়তাবাদ আপন শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে গিয়ে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। তখন জাতিতে-জাতিতে সংঘর্ষ শুরু হয়। বিগত দু’টি বিশ্বযুদ্ধে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, শুধুমাত্র উগ্র জাতীয়তাবাদই আন্তর্জাতিকতার পরিপন্থী। জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতার পরিপন্থী হতে পারে না। জাতীয়তাবাদ মানুষের প্রতি মানুষের ভ্রাতৃত্ব ও ভালােবাসার জন্ম দেয়। মানুষকে নিজেদের সম্পর্কে সচেতন করে তােলে। প্রকৃত জাতীয়তাবাদ বিশ্বশান্তি ও সভ্যতার প্রতি হুমকি নয়। শুধু উগ্র জাতীয়তাবাদই আন্তর্জাতিকতার পরিপন্থী।

Rate this post