প্রশ্নঃ মুহাম্মদ ঘুরী কে ছিলেন? মুহাম্মদ ঘুরীর চরিত্র ও কৃতিত্ব আলােচনা কর।

উপস্থাপনাঃ মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষের ইতিহাসে মুয়েজুদ্দিন মুহাম্মদ ঘুরীর অবদান যুগান্তকারী ও সুদূরপ্রসারী ঘটনা। গজনী বংশের ধ্বংসাবশেষের ওপর তিনি ঘর রাজ্য স্থাপন করে ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে অমর হয়ে আছেন।

মুহাম্মদ ঘুরীর পরিচয়ঃ মুহাম্মদ ঘুরী ছিলেন হিরাত ও কাবুলের মধ্যে অবস্থিত পার্বত্য অঞ্চল ঘুর রাজ্যের অধিপতি গিয়াসউদ্দিন মুহম্মদের ভাই। ১১৭৩ খ্রিস্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন মুহাম্মদ গজনী রাজ্য দখল করে মুহাম্মদ ঘুরীকে এর শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। পরে কাবুলও তিনি জয় করে সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। গজনীর সিংহাসনে আরােহণ করে মুহাম্মদ ঘুরী ‘মুইজউদ্দিন’ উপাধি ধারণ করেন। ইতিহাসে তিনি মুইজউদ্দিন মুহাম্মদ বিন সাম বা মুহাম্মদ ঘুরী নামে পরিচিত। ভাই গিয়াসউদ্দিনের মৃত্যুর পর তিনি ঘুর ও গজনী রাজ্যের অধিপতি হন।

মুহাম্মদ ঘুরীর চরিত্রঃ

১. ন্যায়পরায়ণ সুলতানঃ ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, মুহাম্মদ ঘুরী। ছিলেন অত্যন্ত অপ্রতিদ্বন্দ্বী ন্যায়পরায়ণ সুলতান। তিনি ন্যায়নীতি ও ন্যায়নিষ্ঠার সাথে তার রাজ্যের প্রতিটি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। শক্ৰমিত্র কেউ তার ন্যায়বিচার হতে বঞ্চিত হতাে না।

২. দয়ালু সুলতানঃ মুহাম্মদ ঘুরী ছিলেন দাতা ও দয়ালু শাসক। এজন্য প্রজারা সর্বদা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে তার নাম স্মরণ করত। প্রতিটি অনুচরের প্রতি তার স্নেহ ছিল পিতৃতুল্য।

৩. বিশ্বস্তঃ মুহাম্মদ ঘুরীর সততা ও বিশ্বস্ততা ইতিহাস পাঠকদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গিয়াসউদ্দিন ঘুরীর প্রতি তিনি যে সততা ও বিশ্বস্ততার পরিচয় দেন, ইতিহাসে তার নজির বিরল।

৪. উদ্যমী ও আত্মবিশ্বাসীঃ তিনি ছিলেন উদ্যমী ও আত্মবিশ্বাসী। সাহসিকতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, আত্মবিশ্বাস ও বিপদে ধৈর্যধারণ তার জীবনে সাফল্যের পথ প্রশস্ত করেছিল। জীবনে তিনি বেশ কয়েকটি যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন, কিন্তু পরাজয়ের গ্লানি তাকে কর্তব্যচ্যুত করতে পারেনি।

৫. তাকওয়াবান শাসকঃ মুহাম্মদ ঘুরী সব সময় আল্লাহর ওপর পূর্ণ নির্ভর করতেন। তিনি আল্লাহপ্রেমিক ছিলেন এবং আল্লাহর অনুগ্রহে পূর্ণ বিশ্বাস করতেন। ঐতিহাসিক ফিরিশতা তাকে প্রজাহিতৈষী, সত্যনিষ্ঠ ও তাকওয়াবান শাসক বলে আখ্যা দিয়েছেন।

৬. ধৈর্যশীল শাসকঃ সচ্চরিত্র ও উচ্চ আদর্শের অধিকারী মুহাম্মদ ঘুরী জয়লাভের আনন্দে যেমন আত্মহারা হতেন না, তেমনি পরাজয়েও নিরুৎসাহিত বা বিচলিত হতেন না। তাই ধৈর্য সহকারে তিনি সকল প্রকার বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতেন।

৭. উদার ধর্মমতে বিশ্বাসীঃ মুহাম্মদ ঘুরী ছিলেন বীর যােদ্ধা, ধর্মভীরু এবং উদার ধর্মমতে বিশ্বাসী। তাই বলে গোড়া ছিলেন না। হিন্দুদের প্রতি তিনি অহেতুক বিদ্বেষ পােষণ করতেন না। তার সৈন্যদলে অনেক হিন্দুও ছিল।

৮. শিল্পানুরাগীঃ ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, মুহাম্মদ ঘুরী ছিলেন শিল্পানুরাগী। তার রাজত্বকালে ভারতবর্ষে প্রথম ইসলামী স্থাপত্যশিল্পের শুভ সূচনা হয় এবং হিন্দু মুসলিম স্থাপত্য রীতির সমন্বয়ে গড়ে উঠে বহু স্থাপত্য নিদর্শন।

৯. সাহিত্যানুরাগীঃ মুহাম্মদ ঘুরী শুধু একজন যােদ্ধা এবং শাসকই ছিলেন না; বরং তিনি ছিলেন একজন সাহিত্যানুরাগী এবং বিদ্যোৎসাহী শাসক। বহু বিখ্যাত কবি সাহিত্যিক তার রাজদরবারে সমাদৃত হতেন। তাদের মধ্যে ফখরুদ্দীন রাযী, ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ, কবি নিযামী অন্যতম।

১০. প্রজাকল্যাণকামীঃ মুহাম্মদ ঘুরী প্রজাদের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ ও প্রজাবৎসল শাসক ছিলেন। সাম্রাজ্যের সকল শ্রেণির প্রজার প্রতি তিনি ছিলেন সহানুভূতিশীল ও স্নেহপ্রবণ। প্রজাদের কল্যাণই ছিল তার একমাত্র কাম্য।

১১. ক্রীতদাসদের প্রতি সদয় ব্যবহারঃ ড, হাবিবুল্লাহ বলেন, মুহাম্মদ ঘরী ছিলেন নিঃসন্তান। তাই তিনি তার ক্রীতদাসদের নিজের সন্তান মনে করতেন। তার ছিল শত শত ক্রীতদাস সন্তান। তিনি বলতেন, এ ক্রীতদাসরাই ভারতে আমার যশ খ্যাতি অক্ষুন্ন রাখবে। পরবর্তীতে এ ক্রীতদাসরাই তার বিজিত অঞ্চলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে।

মুহাম্মদ ঘুরীর কৃতিত্বঃ

১. রাজ্য বিজেতাঃ রাজ্য বিজেতা হিসেবে মুহাম্মদ ঘুরী ভারতে অমরত্ব লাভ করেছেন। তিনি ১১৭৫ খ্রিস্টাব্দে মুলতান, ১১৭৬ খ্রিস্টাব্দে উচ এবং ১১৭৯ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাব অধিকার করেন। ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথ্বিরাজকে পরাজিত করেন।

২. সামরিক প্রতিভাঃ ব্যক্তিগতভাবে মুহাম্মদ ঘুরী ছিলেন একজন কালােত্তীর্ণ সামরিক প্রতিভাবান সেনাপতি এবং দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক। তাই তার যুদ্ধনীতিও ছিল অত্যন্ত উন্নত। তিনি যথাযথ উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী একটি দুর্ধর্ষ ও সুসজ্জিত বাহিনী তৈরি করেন। সুতরাং বলা যায়, তিনি একজন সুদক্ষ সমরবিদ ছিলেন।

৩. দক্ষ রাজনীতিবিদঃ ঘুরী একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ছিলেন। ঐতিহাসিকগণ তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও কূটনৈতিক প্রতিভার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ইশ্বরী প্রসাদের মতে, ঘুরী ছিলেন প্রকৃত বিজেতা ও বিজিত অঞ্চলে স্থায়ী রাজনৈতিক কাঠামাে গঠনকর্তা।

৪. দক্ষ সংগঠকঃ মুহাম্মদ ঘুরী ছিলেন অপরিসীম সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকারী। বিজিত অঞ্চলসমূহে মুসলিম শাসনের স্থায়িত্ব বিধানের জন্য তিনি একটি সুষ্ঠু ও ন্যায়সঙ্গত প্রশাসনিক কাঠামাে গড়ে তােলেন। ফলে বাংলা ও বিহার বিজয় এবং পরবর্তীকালে সমগ্র ভারতে মুসলিম সাম্রাজ্য কায়েম সম্ভব হয়েছিল।

৫. দূরদর্শী শাসকঃ ড. এ. বি. এম. হাবিবুল্লাহ বলেন, মুহাম্মদ ঘুরী ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী শাসক। তিনি স্থানীয় রাজ রাজড়াদের দুর্বলতার সুযােগ গ্রহণ করে ভারতে মুসলিম সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন এবং স্বীয় দূরদর্শিতার মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন।

৬. স্থায়ী মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠাঃ মুহাম্মদ ঘুরীর রাজ্য জয়ের উদ্দেশ্য ছিল স্থায়ী মুসলিম শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। তিনি রাজ্য জয় করার সাথে সাথে সেখানে দক্ষ শাসক নিয়ােগ করেন। তার এ প্রচেষ্টার প্রধান সহযােগী ছিলেন জগদ্বিখ্যাত সেনাপতি কুতুবুদ্দিন আইবেক। কুতুবুদ্দিন তার অসাধারণ সামরিক নৈপুণ্য দ্বারা ভারতে মুসলিম সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব সুনিশ্চিত করেন। ড. হাবিবুল্লাহ বলেন- In his scheme of empire building Muizuddin’s Indian conquests appeared to have a secondary importance.

৭. শিল্প সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষকঃ অধিকাংশ সময় যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকলেও তিনি শিল্প সাহিত্যচর্চায় কম-বেশি পৃষ্ঠপােষকতা করেছেন। দার্শনিক, পণ্ডিত ও সাহিত্যিকদের তিনি সমাদর করতেন। পণ্ডিত ফখরুদ্দিন রাযী, সাহিত্যিক মুবারক শাহ, কবি নিযামী প্রমুখ তার রাজসভা অলঙ্কত করেছিলেন। তিনি দিল্লীতে ‘কুওয়াতুল ইসলাম’ ও আজমীরে ‘আড়াই দিন কা ঝােপড়া’ মসজিদ নির্মাণ করেন।

৮. শাসক ও ব্যক্তি হিসেবে ঘুরীঃ বহুমুখী প্রাতভার অধিকারী ঘুরী ছিলেন একাধারে দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক, বাস্তবধর্মী রাজনীতিবিদ, প্রজাহিতৈষী শাসক, নির্ভীক যোদ্ধা, অধ্যাবসায়, ভাবাবেগ বিজিত মানুষ। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী এ মহান শাসক ধম-বর্ণ, নির্বিশেষে সকল শেণির প্রজাবর্গকে প্রতিপালন করতেন সন্তানতম স্নেহ দিয়ে। ঐতিহাসিক ফিরিশতা তাকে আল্লাহভীরু সত্যনিষ্ঠ ও জনকল্যাণকামী সম্রাট বলে অভিহিত করেন।

উপসংহারঃ মুহাম্মদ ঘুরী শুধু বিজেতা হিসেবেই নয়; বরং শ্রেষ্ঠ শাসক, সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা এবং দক্ষ রাজনীতিবিদ হিসেবেও ভারতের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তিনি ভারতের ইতিহাসে মহান ব্যক্তিত্ব ও অনুপম চরিত্রের অধিকারী শাসক ছিলেন। এজন্য তাকে অপরাজেয় বিজেতা হিসেবেও অভিহিত করা হয়। তাই ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন- His military career is a record of a series of unbroken success.

Rate this post