প্রশ্নঃ সেন্ট অগাস্টিনের শান্তি তত্ত্বটি আলােচনা কর।

অথবা, সেন্ট অগাস্টিনের শান্তি নীতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা কর

ভূমিকাঃ মধ্যযুগীয় রাষ্ট্র দর্শনে সেন্ট অগাস্টিন একটি বিশিষ্ট নাম। গ্রীক রােমান সভ্যতা ও খ্রিষ্টীয় সভ্যতার সন্ধিস্থলে দাড়িয়ে সেন্ট অগাস্টিন এই পৃথিবীর মানুষের জন্য নিয়ে এসেছিলেন শান্তির বার্তা। তিনি ৩৫৪ খ্রীষ্টাব্দে উত্তর আফ্রিকার ট্যাগাস্টি নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রদর্শনের জ্ঞান চর্চায় নিমগ্ন ছিলেন। তার রচনাবলীর মধ্যে ‘De Civitate Die’ গ্রন্থ হচ্ছে সর্বাধিক উল্লেখযােগ্য। তিনি যেসকল রাজনৈতিক তত্ত্ব দাঁড় করেন তন্মধ্যে ন্যায় বিচার তত্ত্বটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অগাস্টিনের শান্তিনীতি তত্ত্বঃ তার ন্যায় বিচার তত্ত্বটি মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রদর্শনে বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে। তিনি ন্যায়বিচারের ন্যায় শান্তিনীতিরও ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সাধারণত যুদ্ধের অনুপস্থিতিকে তিনি শান্তি বলে অভিহিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “শত্রু ছাড়া যেমন যুদ্ধ হয় না তেমনি সৌভ্রাতৃমূলক বা মিলনের অংশীদার ছাড়া শান্তি হয় না। সৌভ্রাতৃত্ব বা মিলনের ঐকতানই হলাে শান্তি। অগাস্টিন শান্তির ইতিবাচক সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তার মতে, খ্রিষ্টধর্ম প্রবর্তিত হওয়ার পূর্বে যে সকল রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছিল সেগুলাে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। কেননা বিশ্ব শান্তির জন্যে বিশ্ব রাষ্ট্রের প্রয়ােজন। তার মতে প্রাকৃতিক আইনের মাধ্যমে সকল মানুষ ও জীবজন্তু এই ইতিবাচক শান্তির অন্বেষণেই লিপ্ত থাকে।

অগাস্টিনের শান্তি তত্ত্বের বিভিন্ন দিকসমূহঃ সেন্ট অগাস্টিন মধ্যযুগের অশান্ত সময়ে শান্তিনীতি প্রচারের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। তার শান্তিনীতিকে বিশ্লেষণ করলে নিম্নোক্ত দিকসমূহস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

(১) ঐকতানঃ ঐকতান সেন্ট অগাস্টিনের শান্তি তত্ত্বের প্রথম ও প্রধান দিক। তার এই ঐকতান বিধাতার সকল সদস্যের অভিন্ন প্রেমের বিশ্বজনিত নীতি হতে উৎসাহিত। এ প্রসঙ্গে M.B. Foster বলেন, যে ব্যবস্থায় সকল মানুষ অভিন্ন ঈশ্বর প্রেমের বন্ধনসূত্রে পরস্পর সক্রিয়ভাবে ঐক্যবদ্ধ, সেটিই হচ্ছে অগাস্টিনের বিশ্বশান্তি। তার মতে ঐক্যবদ্ধতা ছাড়া সমাজে শান্তি বিরাজ করতে পারে না।

(২) দৈব রাষ্ট্রঃ সেন্ট অগাস্টিন তার শান্তিনীতি ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে দৈব রাষ্ট্রের আশ্রয় নিয়েছেন। সাথে সাথে তিনি বিশ্বজনীন রাষ্ট্রের দিকেও দৃষ্টি দিয়েছেন। তিনি বলেন, বিভিন্ন পার্থিব রাষ্ট্রে যে শান্তি বিরাজ করে তা আঞ্চলিক বা খন্ড শান্তি। তার মতে বিশ্বজনীন পার্থিব রাষ্ট্র ছাড়া শুধু যে সত্যিকার ন্যায় বিচার সম্ভবপর নয় তা নয়, এই রাষ্ট্র ছাড়াও সত্যিকার শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভবপর। তা হলাে দৈব রাষ্ট্রে।

(৩) বিশ্ব শান্তিঃ বিশ্বজনীন শান্তি মধ্যযুগীয় দার্শনিক অগাস্টিনের শান্তি নীতিতে লক্ষ্য করা যায়। তার মধ্যে প্রকৃতিগত পার্থক্যের কারণে পার্থিব রাষ্ট্রে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভবপর নয়। কারণ এই রাষ্ট্র একান্তভাবে আত্মস্বার্থের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এবং ক্ষমতা লাভই এর মূল লক্ষ্য। বিশ্বজনীন শান্তি কেবলমাত্র বিশ্বজনীন রাষ্ট্রেই সম্ভব। কারণ এই রাষ্ট্রে বিশ্বের সকল মানুষ অভিন্ন এক ব্যবস্থার শরিক। এই রাষ্ট্রের সদস্যগণ নিজেদেরকে যেমন ভালােবাসে অন্যদেরকে ঠিক ততটুকু ভালােবাসে। আর এরূপ ভালােবাসার মধ্য দিয়ে বিশ্বজনীন শান্তি প্রতিষ্ঠা পেতে পারে।

(৪) চার্চের প্রতি আনুগত্যঃ অগাস্টিন চার্চের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের মাধ্যমে তার শান্তিনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। তিনি মনে করেন যে, এই পৃথিবীতে চার্চই হলাে স্বর্গ রাজ্যের প্রতিনিধি। আর এ কারণে মানুষের চার্চকে মান্য করা উচিত যা শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। চার্চের মাধ্যমেই সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তিনি বলেন, চার্চ তথা রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের আনুগত্য থাকবে। কারণ রাষ্ট্র শান্তি-শৃংখলা ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য অপরিহার্য। তিনি বলেন রাষ্ট্রকে মান্য করার একমাত্র কারণ হল রাষ্ট্র শান্তি শৃংখলা ও সম্পত্তি রক্ষা করে।

(৫) খােদায়ী আইনঃ সেন্ট অগাস্টিনের মতে, রাষ্ট্রীয় কার্যাবলী খােদায়ী আইনের দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিত। রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের আনুগত্যবােধ এমন হওয়া প্রয়ােজন যা খােদার বিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। রাষ্ট্রের কোনাে আইন খােদায়ী আইনের বিরােধী হলে নাগরিকগণ সেই আইন মেনে চলবে না। খােদায়ী আইন মানতে তাদের আনুগত্য বেশী থাকবে। তার মতে, শান্তি সেই রাষ্ট্রে বিরাজ করতে পারে যেখানে জনগণ খােদায়ী আইনের বিধান মতে চলে। তিনি আরও বলেন যেখানে ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠিত হয় সেখানে স্বাভাবিকভাবেই শান্তি বিরাজ করে।

(৬) শান্তি প্রতিষ্ঠায় খ্রিষ্টধর্মের ভূমিকাঃ সেন্ট অগাস্টিন শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বলেন, খ্রিষ্টধর্ম প্রবর্তিত হওয়ার পূর্বে যেসব রাষ্ট্র জন্মলাভ করেছিল তারা শান্তি প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়নি। খ্রিষ্টধর্মের প্রবর্তনের পরই কেবল বিশ্বশান্তির পথ সুগম হয়েছে। কেননা খ্রিষ্টধর্ম প্রবর্তনের পূর্বে তারা নিজেদের এলাকায় শান্তি রক্ষায় সক্ষম হলেও নিজেদের মধ্যে মৈত্রীবন্ধন ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হয়নি।

সমালােচনাঃ প্রখ্যাত দার্শনিক সেন্ট অগাস্টিনের শান্তি তত্ত্বটি সমালােচনার বাইরে নয়। এই তত্ত্বটির সমালােচনা নিম্নে উল্লেখ করা হলাে।

(১) পার্থিব রাষ্ট্রের অবহেলাঃ সেন্ট অগাস্টিন পার্থিব রাষ্ট্রকে অবহেলা করেছেন। তার মতে প্রকৃত কারণে পার্থিব রাষ্ট্রে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভবপর নয়। পার্থিব রাষ্ট্রে বিরাজিত শান্তি বিশ্বশান্তি নয়।

(২) অনৈতিহাসিকঃ অগাস্টিনের শান্তি তত্ত্বের সন্ধান ইতিহাসে পাওয়া যায় না। তিনি যে বিশ্বশান্তির কথা বলেছেন খৃষ্টপূর্ব যুগের কোনাে প্যাগান রাষ্ট্রে সে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সুতরাং তার এ তত্ত্বটি অনেকটা অনৈতিহাসিকতা দোষে দুষ্ট।

(৩) প্রকৃতির বেশী গুরুত্বঃ অগাস্টিন শুধু প্রকৃতির মধ্যে শান্তির অন্বেষণ করেছেন। তিনি প্রকৃতিকে একমাত্র শান্তির উৎস বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু প্রকৃতি ছাড়াও শান্তি সম্ভবপর তা তিনি চিন্তাও করেননি।

(৪) কল্পনাপ্রসূতঃ তিনি দৈব রাষ্ট্রে যে শান্তি স্থাপনের প্রয়াস চালিয়েছেন তা কল্পনাপ্রসূত। তিনি বিশ্ব শান্তির জন্য যে দৈব রাষ্ট্রের কথা বলেছেন তা আমাদের আয়ত্তের বাইরে। এ রাষ্ট্রকে শুধুমাত্র কল্পনা করা সম্ভবপর।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সেন্ট অগাস্টিনের শান্তি তত্ত্বটি সমালােচিত হওয়া সত্ত্বেও এটি তৎকালীন অশান্ত যুগে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে। মধ্য যুগ ছিল মূলত ন্যায়শাস্ত্র ও ধর্মতত্ত্বের গহ্বরে বন্দী। তিনি শান্তিনীতির ক্ষেত্রে যে স্রোতধারা প্রবাহিত করেছেন তা পরবর্তীতে বিভিন্ন দার্শনিক তাদের ন্যায়তত্ত্বের ভিত্তি রূপে গ্রহণ করেছেন।

Rate this post