অথবা, টমাস একুইনাস কীভাবে প্রাকৃতিক আইনকে ব্যাখ্যা করেছেন? আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ মধ্যযুগীয় বর্বরতা ও পােপ রাজার ক্ষমতাগত দ্বন্দ্ব যখন মধ্যযুগকে এক স্থবির অন্ধকারের গভীর অমানিশায় প্রােথিত করে ঠিক তখনই আলাের মশাল হাতে নিয়ে আবির্ভূত হন প্রগতিশীল দার্শনিক টমাস একুইনাস। তিনি ১২২৭ খ্রীষ্টাব্দে মতান্তরে ১২২৫ খৃষ্টাব্দে নেপলস শহরের উপকণ্ঠে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি অনেকটা স্বাধীনচেতা ব্যক্তি ছিলেন। তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাষ্ট্রদর্শনে জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন ছিলেন। রাষ্ট্রদর্শনের বিভিন্ন শাখায় তার কৃতিত্বের স্বীকৃতি পাওয়া যায়। তার প্রণীত আইন তত্ত্বটি বিশেষভাবে প্রণিধানযােগ্য। তার প্রাকৃতিক আইন তার আইন তত্ত্বটির একটি বিশেষ স্তর।

প্রাকৃতিক আইনঃ টমাস একুইনাস প্রাকৃতিক আইনের ওপর তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন। একুইনাসের মতে, মানুষের সহজাত প্রবণতা ও ন্যায়বােধের ধারণা হতে প্রাকৃতিক আইনে উদ্ভব ঘটে। তিনি আবারও বলেন, সৃষ্ট বস্তুতে স্বর্গীয় যুক্তির প্রতিফলনই প্রাকৃতিক আইন। এই আইন মানুষের অন্তরে যেমন অংকিত হয়েছে, তেমনি হয়েছে প্রত্যেকটি সৃষ্ট প্রাণী ও পদার্থের মধ্যে। শাশ্বত প্রজ্ঞার যে অংশটুকু স্রষ্টা দুই শ্রেণী-জীবজন্তু ও জড়বস্তুর নিকট প্রকাশ করেন, তাকেই বলা হয় প্রাকৃতিক আইন।

প্রাকৃতিক আইনের প্রয়ােগ পদ্ধতিঃ টমাস একুইনাস প্রাকৃতিক আইনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এর প্রয়ােগ পদ্ধতির ওপর গুরুত্ব প্রদান করেছেন। তার মতে যুক্তিবাদী ও অযুক্তিবাদী ভেদে প্রাকৃতিক আইনের প্রয়ােগ পদ্ধতি দু’রকম। যুক্তিবাদী প্রাণী বা মানুষের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলাে যে, সে যুক্তির সাহায্যে ভালাে-মন্দ ও ন্যায় অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। তার ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক আইন স্বতঃস্ফূর্তভাবে ক্রিয়াশীল নয়। পক্ষান্তরে, অযুক্তিবাদী প্রাণী বা জড়বস্তুর ক্ষেত্রে এরূপ ইচ্ছা বা অনিচ্ছার কোনাে সুযােগ নেই। তাদের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক আইন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ক্রিয়াশীল। তাদের অন্যরকম আকর্ষণ করার কোনাে সুযােগ নেই।

প্রাকৃতিক আইনের বিভিন্ন দিকঃ মানবিক আইনের ন্যায় টমাস একুইনাসের প্রাকৃতিক আইনেরও বিভিন্ন দিক রয়েছে। তার প্রাকৃতিক আইনকে বিশ্লেষণ করলে নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

(১) যুক্তির প্রতিফলনঃ যুক্তির প্রতিফলন প্রাকৃতিক আইনের একটি বিশেষ দিক। এই বিশ্বে চিরন্তন আইনের যেটুকু প্রতিফলন ঘটেছে তাই মূলত প্রাকৃতিক আইন। এর প্রতিফলন ঘটেছে প্রত্যেকটি সৃষ্ট জীব ও বস্তুর প্রবৃত্তি প্রবণতায়, যার ফলে তারা আপন-আপন মঙ্গল কামনা করে অমঙ্গল থেকে মুক্তি পেতে চায়। যুক্তিবাদী প্রাণীরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় প্রয়াসী হয় এবং প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে যতটুকু সার্থকজীবন সম্ভবপর তা পাইতে চায়।

(২) নিয়ন্ত্রণঃ টমাস একুইনাসের প্রাকৃতিক আইনকে বিশ্লেষণ করলে নিয়ন্ত্রণ প্রত্যয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে গ্রীক রাষ্ট্রদার্শনিক বলেন, মানুষের যুক্তিবাদ একটি সহজাত প্রবণতা। টমাস একুইনাস আরও একধাপ এগিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রত্যেক সৃষ্ট বস্তু ও প্রাণী চিরন্তন আইনের নিয়ন্ত্রণাধীন। যেখানে অন্যান্য বস্তু বা প্রাণীর প্রবণতায় তার প্রকাশ সেখানে মানুষ এর প্রভাবেও অন্যান্যের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে।

(৩) বিশ্ব চরাচর বিভাজনঃ টমাস একুইনাস বিশ্বচরাচরের বিভাজন করেছেন। তার মতে, বিশ্ব চরাচর প্রধানত দু’ভাগে বিভক্ত। ১. যুক্তিবাদী প্রাণী অর্থাৎ মানব জাতি, ২, অযুক্তিবাদী প্রাণী যা প্রাণহীন জড়বস্তু নিয়ে গঠিত। যুক্তিবাদী প্রাণী ও অযুক্তিবাদী বস্তুর ওপর প্রাকৃতিক আইনের প্রয়ােগ বেশী লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ যুক্তিবাদী ও অযুক্তিবাদী প্রাণী ও বস্তু প্রাকৃতিক আইনের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

(৪) ঐশ্বরিক আইনের সহায়কঃ প্রাকৃতিক আইন ঐশ্বরিক আইনের সহায়ক। প্রাকৃতিক আইনের ব্যাখ্যায় লক্ষ্য করা যায় তার এই ঐশ্বরিক আইনের সঙ্গে সাধারণভাবে সঙ্গতিপূর্ণ। মূলত মানুষের জ্ঞান সীমিত বলে সে সঠিকভাবে প্রাকৃতিক আইনের সমুদয় বিধান উপলব্ধি করতে অক্ষম হওয়ায় তা ঐশ্বরিক আইনের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভবপর। সুতরাং ঐশ্বরিক আইন অনেকটা প্রাকৃতিক আইন থেকে উৎসারিত।

(৫) বুদ্ধিমত্তাঃ মধ্যযুগীয় দার্শনিক টমাস একুইনাস তার প্রাকৃতিক আইনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মানুষের বুদ্ধিমত্তার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তার মতে, প্রাকৃতিক আইনের প্রভাবে মানুষ সমাজে বাস করতে চায়, আপন জীবন রক্ষায় প্রয়াসী হয়, সন্তান উৎপাদন এবং তাদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করে। এর মূলে রয়েছে মানুষের বুদ্ধিমত্তা। মানুষ বিবেকবান প্রাণী হিসেবে স্বর্গীয় পরিকল্পনায় অংশ নেয়।

সমালােচনাঃ টমাস একুইনাসের প্রাকৃতিক আইনের ত্রুটিকে উপেক্ষা করা যায় না। সমালােচকগণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এই ক্রটিসমূহ তুলে ধরেছেন যা নিম্নরূপ-

(১) মানব জ্ঞান সীমিতঃ টমাস একুইনাস তার প্রাকৃতিক আইনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মানুষকে সীমিত পরিধিতে বিচার করেছেন। তিনি বলেন, মানুষের জ্ঞান সীমিত বলে সে সঠিকভাবে প্রাকৃতিক আইনের বিধান উপলব্ধি করতে পারে না।

(২) অপরিবর্তিতঃ প্রাকৃতিক আইন অপরিবর্তনীয়তা দোষে দুষ্টু। প্রাকৃতিক আইন একটি শাশ্বত বিধান। এটি কালের পরিবর্তনের সাথে সঙ্গতি রাখতে পারেনি। ফলে তার প্রয়ােগের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা দেখা দেয়।

(৩) অবৈজ্ঞানিকঃ সমালােচকের মতে, টমাস একুইনাসের প্রাকৃতিক আইন অবৈজ্ঞানিক। বর্তমান বৈজ্ঞানিক যুগে প্রাকৃতিক আইনের বিধি বিধান অনেকটা অবৈজ্ঞানিক। এটি মূলত কতিপয় শাশ্বত বিধানের সমষ্টি।oooo

(৪) অবমূল্যায়নঃ তিনি মানব জাতিকে অবমূল্যায়ন করেছেন। তার মতে, মানুষের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক আইন স্বতঃস্ফূর্তভাবে ক্রিয়াশীল নয় কিন্তু জড়বস্তুর ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক আইন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ক্রিয়াশীল। এক্ষেত্রে তিনি অনেকটা সমালােচনার সম্মুখীন হয়েছেন।

পরিশেষঃ বহুবিধ সমালােচনা থাকা সত্ত্বেও পরিশেষে বলা যায় যে, টমাস একুইনাস প্রাকৃতিক আইনের মৌলভিত্তি রচনা করেছেন। পরবর্তীকালে অন্যান্য দার্শনিকগণ তাদের আইন ব্যাখ্যায় এর সাহায্য নিয়েছেন। আর এ কারণে P.G. Das-এর ভাষায় বলা যায় যে, ‘St Thomas’s Conception of Natural Law is right significant which Greek Philosophers regared as their basic principles.’

Rate this post