প্রশ্নঃ ‘সমাজবিজ্ঞান একটি মূল্যবােধ নিরপেক্ষ বিজ্ঞান’ উক্তিটির যথার্থতা বিশ্লেষণ কর।

অথবা, সমাজবিজ্ঞান কী মূল্যবােধ নিরপেক্ষ বিজ্ঞান? তােমার উত্তরের স্বপক্ষে যুক্তি দাও।

ভূমিকাঃ পাশ্চাত্যে শিল্পবিপ্লব পরবর্তী দ্রুত পরিবর্তনশীল এক জটিল অথচ বৈপ্লবিক সমাজ প্রেক্ষাপটে ১৮৩৯ সালে সমাজবিজ্ঞানের যাত্রা শুরু হয়। সমকালীন সমাজের বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালােচনার দাবি নিয়ে সমাজবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সমাজবিজ্ঞান গােটা সমাজকে উপজীব্য বিষয় হিসেবে ধারণ করে আসছে। সমাজের ছােট-বড় সর্বদিক তথা রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক জীবজগত ও পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা, মানুষ সবকিছুই এর প্রতিপাদ্য বিষয়।

সমাজবিজ্ঞান মূল্যবােধনিরপেক্ষ বিজ্ঞানঃ সমাজবিজ্ঞান মূল্যবােধ নিরপেক্ষ বিজ্ঞান কিনা এই উক্তিটি ব্যখ্যা করার প্রারম্ভে আমাদের জানতে হবে মূল্যবোধ নিরপেক্ষ বিজ্ঞান বলতে কী বুঝায়। যখন কোনাে বিষয় নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ করা যায় এবং বিশ্লেষণ থেকে প্রাপ্ত তথ্য সম্পর্কে ভালাে-মন্দ, উচিত-অনুচিত কোনাে প্রকার মন্তব্য করা হয় না তখন তাকে মূল্যবােধ নিরপেক্ষ বিজ্ঞান বলা হয়।

সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞার আলােকে নিরপেক্ষতাঃ সমাজবিজ্ঞান মূল্যবােধ নিরপেক্ষ কিনা এর যথার্থতা বিচার করার জন্য এর সংজ্ঞা নিয়ে আলােচনা করতে হবে।

সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার, অগাস্ট কোঁৎ, স্পেন্সার প্রমুখ সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞায় সামাজিক সম্পর্কের ওপর জোর দিয়েছেন। ম্যাকাইভারের মতে, সমাজবিজ্ঞানই একমাত্র বিজ্ঞান যা সমাজ ও সামাজিক সম্পর্ক সম্বন্ধে পাঠ করে।

সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের জগতে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। তিনি সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে সামাজিক কার্যাবলির ওপর জোর দিয়েছেন। তার মতে, ‘সমাজবিজ্ঞান এমন একটি বিজ্ঞান যাতে Social action বা সামাজিক কার্যাবলির বিশ্লেষণের মাধ্যমে এর কার্যকারণ সম্বন্ধে আমরা ধারণা করতে সক্ষম হই।’

সমাজবিজ্ঞানীর নিরপেক্ষতাঃ এখন প্রশ্ন হলো একজন সমাজবিজ্ঞানী কোনাে সমাজ বা সামাজিক প্রপঞ্চ নিয়ে আলােচনা বা গবেষণা করতে গিয়ে কতটুকু নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পেরেছেন। অনেক সমাজবিজ্ঞানী মন্তব্য করেছেন যে, ‘Sociology is an objective science’ অর্থাৎ Scientific পদ্ধতিতে কোনাে সামাজিক ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করাকে বলা হয় Objective Science.’।

ম্যাক্স ওয়েবারঃ ম্যাক্স ওয়েবার বলেন, সমাজবিজ্ঞানের কোনাে শিক্ষক যখন ক্লাশ করাবেন, তখন তিনি তার নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করতে পারবেন না। তিনি (শিক্ষক) শুধু পারবেন তার সব অভিজ্ঞতা বা জ্ঞানকে আলােচনা করতে। আর এ জন্যই বলা হয়, ‘Sociology is a value free science. It cannot make any value judgement.’|

অগাস্ট কোঁৎঃ অগাস্ট কোঁৎ সমাজবিজ্ঞানের স্বরূপ বর্ণনা করতে গিয়ে দু’টি শব্দ ব্যবহার করেন। যথাঃ Social statics (সামাজিক স্থিতিশীলতা) এবং Social Dynamics (সামাজিক গতিশীলতা)। সামাজিক গতিশীলতা ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বলতে তিনি বারবার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির পারস্পরিক সম্পর্ককে বুঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু কোনাে ধরনের সমাজের জন্য কিরকম স্থিতিশীলতা দরকার তা বর্ণনা করেননি। আর সামাজিক গতিশীলতা বলতে তিনি কালের চক্রে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তনকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু কোন সমাজের জন্য কি ধরনের সামাজিক প্রতিষ্ঠান প্রযােজ্য তা তিনি মন্তব্য করেননি। কোনাে সমাজ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে যিনি যা পেয়েছেন, তা হুবহু বর্ণনা করেছেন।

সমাজবিজ্ঞানী কিংসলে ডেভিসঃ সমাজবিজ্ঞানী কিংসলে ডেভিস তার ‘Human Society’ গ্রন্থে বলেন, সমাজবিজ্ঞানকে স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে সমাজতাত্ত্বিক আলােচনাকে মূল্যমান নিরপেক্ষ রাখার চেষ্টা করা হয়। কারণ কোনাে বিষয় বিজ্ঞানের মর্যাদা পেতে হলে তার মৌলিক গবেষণাগুলাে যৌক্তিক ও মূল্যবােধ নিরপেক্ষ হতে হয়। সমকালীন সমাজতাত্ত্বিক গবেষণাগুলাে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, গবেষকগণ বস্তুনিষ্ঠভাবে এবং পক্ষপাতমুক্ত হয়ে এবং মূল্যবোধ উপেক্ষা করে প্রকৃত ঘটনা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে ব্রত হয়েছেন। সমাজবিজ্ঞানীদের এ ধরনের প্রচেষ্টা সমাজবিজ্ঞানকে মূল্যবােধ নিরপেক্ষ বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠায় অনেক সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।

মূলবােধ নিরপেক্ষতা সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণাঃ উপযুক্ত আলােচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে তাত্ত্বিকগণের কেউ কেউ সমাজবিজ্ঞানকে মূল্যমান নিরপেক্ষ বিজ্ঞান হিসেবে উল্লেখ করলেও অনেকে আবার এ সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। যেমনঃ

(১) সমাজের প্রচলিত বিধিনিষেধগুলাে কতকগুলাে মৌল মূল্যবােধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সমাজবিজ্ঞানী যেহেতু সমাজেরই একজন তাই শত চেষ্টার পরও তাদের পক্ষে এগুলাে উপেক্ষা করা সম্ভবপর হয় না। অতএব সমাজবিজ্ঞান মূল্যবােধ নিরপেক্ষ বিজ্ঞান এটি সঠিক ধারণা নয়।

(২) সমাজে বসবাস করতে গিয়ে মানুষ জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে, যেভাবেই কোনাে কিছু অর্জন করে তা অবশ্যই কোনাে না কোনভাবে মূল্যবােধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সুতরাং সমাজতাত্ত্বিক আলােচনা মূল্যবােধ নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা সম্ভবপর নয়।

(৩) সমাজের সদস্য হিসেবে গবেষক নিজেও কোনাে না কোনাে মূল্যবােধকে বিশ্বাস করে। এমতাবস্থায় তার পক্ষে নিরপেক্ষ বক্তব্য উপস্থাপন দুরূহ হয়ে পড়ে। ফলে দেখা যায়, কোনাে সংবেদনশীল ইস্যু নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে নিজের মূল্যবােধ সম্পর্কযুক্ত ফলাফল প্রকাশ করে। অতএব সমাজবিজ্ঞানের মূল্যবােধ নিরপেক্ষতা একটি অলীক কল্পনা।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সমাজের একজন মানুষ হিসেবে সমাজবিজ্ঞানীরা সমাজ গবেষণা করতে গিয়ে – কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে হয়তাে নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না। কিন্তু তাই বলে সমাজবিজ্ঞান মূল্যবােধ নিরপেক্ষ বিজ্ঞান নয় একথা বলা চলে না। সমাজবিজ্ঞানীগণ ভালাে-মন্দ বিচার পরিহার করে বস্তুনিষ্ঠভাবে সমাজকে বিশ্লেষণ করেন। আর এ কারণেই সমাজবিজ্ঞানী স্যামুয়েল কোনিগ বলেছেন, “সমাজবিজ্ঞান একটি মূল্যবােধ নিরপেক্ষ বিজ্ঞান।”

Rate this post