প্রশ্নঃ “সামাজিকবিজ্ঞান একমাত্র বিজ্ঞান যা সবচেয়ে বেশি পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করে, কিন্তু ফলাফল শূন্য বিজ্ঞান” (হেনরী পঁয়কর) উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।

অথবা, সামাজিকবিজ্ঞান গবেষণায় কোন একক পদ্ধতি ব্যবহার করে কী কোনাে অভীষ্ট লক্ষ্যার্জন সম্ভবপর? তােমার মতামত ব্যক্ত কর।

অথবা, সমাজবিজ্ঞান হলাে পদ্ধতি বাহুল্য কিন্তু ফলাফল শূন্য একটি বিজ্ঞান- উক্তিটির যথার্থতা যাচাই কর।

ভূমিকাঃ প্রত্যেক বিজ্ঞানই সাধারণত বিষয়ভিত্তিক। তাই সামাজিকবিজ্ঞান হিসেবে সমাজবিজ্ঞানেরও একটি নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু রয়েছে, যে বিষয়বস্তুকে অবলম্বন করে সমাজবিজ্ঞান তার সামগ্রিক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। সমাজবিজ্ঞানীরা এ নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুকে বিশ্লেষণ করার জন্য নিজস্ব পদ্ধতি ও কৌশল অবলম্বন করে তাদের গবেষণা পরিচালনা করত। তাই সমাজবিজ্ঞানে পদ্ধতি ও কৌশল অত্যাবশকীয়। কিন্তু কোনাে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিগত একক প্রক্রিয়া সমাজবিজ্ঞানীদের জানা নেই বা তার ব্যবহারও তারা করেন না। বিভিন্ন সময় গবেষণা বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি করে পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। তাই ফরাসি অংক শাস্ত্রবিদ হেনরি পঁয়কর বলেছেন যে, ‘সমাজবিজ্ঞান হলাে পদ্ধতিবহুল কিন্তু ফলাফল শূন্য বিজ্ঞান।”

সমাজবিজ্ঞানে ব্যবহারিত পদ্ধতিসমূহঃ প্রত্যেক বিজ্ঞানই তাদের বিষয়বস্তুর নিরিখে গবেষণা পরিচালনা করে ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকে। যেমনঃ প্রাকৃতিক বিজ্ঞানসমূহ কোনাে ঘটনার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তার ওপর ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকে। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানে যেসকল পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় তার মাধ্যমে সঠিক ও সুনির্দিষ্ট ফলাফল প্রদান করা সম্ভব নয়। তবে বর্তমান সময়ে কার্যকরী পদ্ধতি ব্যবহার করার মাধ্যমে সমাজবিজ্ঞানও সঠিকভাবে তাদের ফলাফল বা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারছে। পদ্ধতিগুলাে নিয়ে আলােচনা করা হলাে-

(১) ঐতিহাসিক পদ্ধতিঃ ঐতিহাসিক পদ্ধতিতে অতীত সমাজের ঘটনা, সামাজিক প্রক্রিয়া, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির ধারাবাহিক বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে। যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বর্তমান সমাজের পটভূমি, প্রকৃতি এবং ভূমিকা সম্পর্কে জ্ঞান অনুসন্ধান। এই পদ্ধতিতে প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থ, পত্র-পত্রিকা, গবেষণা রিপাের্ট, সরকারি দলিল প্রভৃতির সাহায্য নিতে হয়।

(২) নমুনা জরিপ পদ্ধতিঃ একটি এলাকা বা দেশের সমগ্র জনসংখ্যা সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানী গবেষণার জন্য ঐ এলাকা বা দেশের জনসংখ্যার একটি প্রতিনিধিত্বকারী অংশকে নমুনা হিসেবে বেছে নিয়ে গবেষণা করেন। এই নমুনা জরিপ পদ্ধতিতে গবেষণায় সময় ও শ্রম কম লাগে।

(৩) পরীক্ষণ পদ্ধতিঃ একটি সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাধীনে দুই বা ততােধিক সামাজিক ঘটনা বা প্রপঞ্চের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় করার পদ্ধতিকে পরীক্ষণ পদ্ধতি বলা হয়। এর তিনটি স্তর রয়েছে- (১) প্রকল্প প্রণয়ন, (২) প্রকল্প পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং (৩) সামান্যীকরণ।

(৪) তুলনামুলক পদ্ধতিঃ একটি সমাজের ব্যক্তি, গােষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান তথা গােটা সমাজ অন্য সমাজ থেকে কতটা ভিন্নধর্মী বা সহধর্মী তা জানার জন্য তুলনামূলক পদ্ধতির আশ্রয় নেয়া হয়।

(৫) ঘটনা জরিপ পদ্ধতিঃ এ পদ্ধতিতে এক বা একাধিক ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে একটি সাধারণ সত্রে আসার চেষ্টা করা হয়। এ পদ্ধতিতে গবেষক একটি সম্প্রদায়, গ্রাম বা কোনাে পেশাভিত্তিক শ্রেণির জীবনযাত্রা প্রণালি সম্পর্কে অনুসন্ধান চালান।

(৬) দার্শনিক পদ্ধতিঃ এ পদ্ধতিতে গবেষক কোনাে ব্যক্তি, সমাজ বা বিষয়কে বিশেষভাবে অনুধাবন করে বিচার-বিশ্লেষণের ভিত্তিতে গবেষণা করেন।

(৭) পর্যবেক্ষণ পদ্ধতিঃ সমাজ গবেষণায় মৌলিক তথ্য সংগ্রহ কৌশল হিসেবে পর্যবেক্ষণ বিশেষভাবে পরিচিত। বলা হয়ে থাকে যে, সমাজ গবেষণা পর্যবেক্ষণ থেকে শুরু করে পর্যবেক্ষণে এসেই পরিণতি লাভ করে। বস্তুত সামাজিক বিজ্ঞানের উন্মেষ ও বিকাশে পর্যবেক্ষণই প্রধান ভূমিকা পালনকারী কৌশল।

(৮) পরিসংখ্যান কৌশলঃ সমাজের বিভিন্ন অবস্থা ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানী তথ্য সংগ্রহ করেন এবং তাদের সহজবােধ্য করে সংখ্যায় প্রকাশ করার ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি প্রয়ােগ করেন।

(৯) জীবতাত্ত্বিক পদ্ধতিঃ সমাজ বিবর্তনশীল, তাই সমাজবিজ্ঞানীরা প্রয়ােজনে পরিবর্তন ও বিবর্তনশীল অবস্থা বিশ্লেষণের প্রয়ােজন পড়ে। পরিবর্তন ও বিবর্তন সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেয়ার জন্য জীবতাত্ত্বিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

(১০) প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ পদ্ধতিঃ সমাজবিজ্ঞানী কোনাে সমাজ বা গ্রাম সম্পর্কে গবেষণা করার জন্য সশরীরে সেখানে অবস্থান করে সম্পূর্ণ পরিস্থিতি নিজের আয়ত্তে এনে গবেষণা করেন।

(১১) মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতিঃ সমাজের মানুষের আচরণ, মনােভাব, জনমত, দলবদ্ধ লােকের মানসিক অবস্থা প্রভৃতি বিশ্লেষণের জন্য মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি প্রয়ােগ করা হয়।

(১২) নৃতাত্ত্বিক পদ্ধতিঃ মানুষের সংস্কৃতি, ভাষাতত্ত্ব, জাতিতত্ত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে জানার জন্য প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে নৃতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে সমাজ গবেষণা করা হয়।

(১৩) পরিমাপক পদ্ধতিঃ কোনাে দেশের সমাজজীবনে মানুষের কাজের পরিস্থিতি, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নির্ধারণ করার জন্য পরিমাপক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।

(১৪) কার্যক্রমগত পদ্ধতিঃ সমাজের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। তবে সব কার্যক্রমকেই আদর্শ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না। তাই সমাজে আদর্শ কার্যক্রমের ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য সমাজবিজ্ঞানীরা এ পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন।

(১৫) সামাজিক জরিপ পদ্ধতিঃ এ পদ্ধতিতে কাঙ্ক্ষিত তথ্যসমূহ নিয়মতান্ত্রিক ভাবে সংগ্রহ করা হয়। গবেষকগণ পূর্বেই কোন তথ্যগুলাে এবং উপকরণগুলাে সংগ্রহ করবেন তা ঠিক করে রাখেন। অতঃপর প্রাপ্ত তথ্যসমূহ লিপিবদ্ধ করার জন্য গবেষণা ইত্যাদি ব্যবহার করেন। এই পদ্ধতির দ্বারা সমাজের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুঁজি, শ্রম, উৎপাদন, বণ্টন ইত্যাদি সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে জানা যায়।

(১৬) ঘটনা বিশ্লেষণ পদ্ধতিঃ কোনাে স্টাডি হলাে সামাজিক এককের জীবনধারা উদঘাটন ও বিশ্লেষণের একটি পদ্ধতি, যা কোনাে একক ব্যক্তি, একটি পরিবার, প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক দল অথবা একটি গােটা সমষ্টি হতে পারে। এই পদ্ধতিতে অনেকগুলাে ঘটনাকে অধ্যয়ন করা হয় এবং তা থেকে একটি সাধারণ সিদ্ধান্ত আসার চেষ্টা করা হয়।

(১৭) বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতিঃ সমাজবিজ্ঞানীগণ সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন সমস্যার কারণ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে এ পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন। প্রথমে এই সকল সমস্যার কারণগুলাে খুঁজে বের করতে হবে। অতঃপর এর সমাধানের পথ দেখতে হবে। তাই সমাজবিজ্ঞানীগণ সমস্যা সমাধানকল্পে এ সকল সমস্যার বিশ্লেষণ করার জন্য এ পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, ওপরে বর্ণিত পদ্ধতিগুলাে সাধারণত সমাজবিজ্ঞানে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তাহলে সহজেই অনুমান করা যায় যে সমাজবিজ্ঞানে অনেক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কারণ সমাজ একটি জটিল ও পরিবর্তনশীল প্রত্যয়। তারপরও সমাজ গবেষণার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগুলােকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না। মূলত গবেষণার ফলাফল সম্পর্কিত সন্দেহ থেকেই হেনরি জড়িত পঁয়কর এই উক্তিটি করেছেন। সামাজিক বিশ্লেষণে হেনরি পঁয়কর-এর উক্তিটির যৌক্তিকতা পাওয়া যায়। সমাজজীবনের নানাবিধ ঘটনা বিশ্লেষণে কোন পদ্ধতি সবচেয়ে বেশি গ্রহণযােগ্য তাও সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়।

Rate this post