প্রশ্নঃ দার্শনিক হিউমের কার্যকারণ মতবাদ ব্যাখ্যা ও পরীক্ষা করা।

অথবা, হিউমের কার্যকারণ মতবাদ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ণন কর।

ভূমিকাঃ একজন অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক হিসাবেই হিউম অধিক পরিচিত। কার্যকারণ সম্পর্কে হিউমের মতবাদ দর্শনে ব্যাপক আলােড়ন সৃষ্টি করেছে। একটি শক্তি হিসেবে কারণ কার্য উৎপাদন করে। এমন মতবাদকে হিউম যুক্তির সাহায্যে অস্বীকার করেন। সাধারণ লােকের ধারণা হলাে- ‘কারণ’ একটি শক্তি যা কার্যকে উৎপন্ন করে থাকে। তাদের মতে, কারণ ও কার্যের সম্পর্ক অনিবার্য। কিন্তু হিউমের মতে, কার্য ও কারণের মধ্যে কোনাে গভীর সম্পর্ক নেই।

হিউমের কার্যকারণ মতবাদঃ হিউমের কার্যকারণ মতবাদ ব্যাখ্যা করার আগে আমাদের এ কথা জানা উচিত যে কার্যকারণ মতবাদ কী? তাই কার্যকারণ মতবাদ সম্পর্কে নিম্নে আলােচনা করা হলাে-

কার্যকারণ মতবাদঃ যে মতবাদ অনুসারে কার্য ও কারণের মধ্যে অনিবার্য সম্পর্ক বর্তমান তাকে কার্যকারণ মতবাদ বলে। সাধারণ অর্থে যার দ্বারা কোনাে ঘটনা ঘটে তাকে এবং যে ঘটনাটি ঘটে তাকে কার্য বলে। জগত প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। সাধারণ মানুষ সর্বদা কেন এবং কীভাবে এই পরিবর্তন ঘটে তার সদুত্তর পাওয়ার জন্য উৎসুক হয়ে ওঠে। লৌকিক দৃষ্টিতে কারণ হলাে এমন কিছু যা পরিবর্তন, গতি বা ক্রিয়ার জন্য দায়ী। এজন্য কারণের মধ্যে এমন একটি শক্তি রয়েছে যার ফলে কার্য উৎপন্ন হয়। কার্যকারণ মতবাদের মূল কথা হচ্ছে, প্রতিটি ঘটনারই একটি কারণ আছে দার্শনিক জন লকসহ অনেকে কার্যকারণের লৌকিক মতবাদের সমর্থক। তাদের মতে, কারণ হলাে কার্য উৎপাদনের শক্তি মাত্র। অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক হিউম, কার্যকারণ তত্ত্বের লৌকিক মতবাদের তীব্র সমালােচনা করেন। তার মতে, কার্য ও কারণের মধ্যে কোনাে অনিবার্য সম্পর্ক নেই। নিম্নে হিউমের কার্যকারণ মতবাদ ব্যাখ্যা করা হলাে-

(১) কারণ ও কার্য দুটি স্বতন্ত্র বা আলাদা ঘটনাঃ হিউমের মতে, সংবেদন এবং ধারণাই জ্ঞান লাভের একমাত্র উপায়। প্রত্যেক্ষণের সাহায্যে আমরা কোনাে শক্তির সংবেদন লাভ করি না। তিনি প্রথমে অভিজ্ঞতালব্ধ যুক্তির সাহায্যে কারণ ও কার্যের অনিবার্যতা অস্বীকার করেন। তার মতে, অভিজ্ঞতা পূর্ব যুক্তির সাহায্যে কারণ ও কার্যের অনিবার্যতা সম্বন্ধে জ্ঞান পাওয়া যেত যদি দু’টি বিষয় এক হতাে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, দু’টি বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা। অভিজ্ঞতা ছাড়া শুধু বিশ্লেষণ দ্বারা কার্যকে কারণের মধ্যে পাওয়া যায় না।

(২) কারণকে বিশ্লেষণ করেই কার্যের ধারণা পাওয়া যায় নাঃ হিউম তার কার্যকারণ মতবাদে বলেন, কারণের বিশ্লেষণপূর্বক কার্যের ধারণা পাওয়া সম্ভব নয়। বস্তুত কারণ ও কার্যের মধ্যে যদি কোনাে অনিবার্য সম্পর্ক থাকত, তাহলে কারণকে বিশ্লেষণ করলে কার্যের ধারণা পাওয়া যেত। কিন্তু খাদ্যকে যতই বিশ্লেষণ করা হােক না কেন তার মধ্যে ক্ষুধা নিবারণের শক্তি পাওয়া যায় না। অর্থাৎ খাদ্য ও ক্ষুধা নিবৃত্তির মধ্যে কোনাে অনিবার্য সম্পর্ক নেই। হিউমের মতে, ‘খাদ্য ক্ষুধা নিবৃত্তি করে না” এরূপ চিন্তা করা অযৌক্তিক নয়।

(৩) অভিজ্ঞতায় আমরা কার্যকারণের কোনাে অনিবার্য সম্বন্ধ পাই নাঃ কারণ ও কার্য দুটি আলাদা ঘটনা। উভয়ের মধ্যে যদি অনিবার্য সমন্বয়ের ধারণা করা হয়। তাহলে, কারণ ও কার্যকে স্বতন্ত্র্য ঘটনা বলা যাবে। কাজেই কারণ ও কার্যের মধ্যে কোনাে সম্পর্ক প্রমাণ করা যায় না। অভিজ্ঞতায় আমরা ঘটনার পারম্পর্য এবং সহাবস্থানের সম্বন্ধ পাই কিন্তু কোনাে অনিবার্য সম্পর্ক পাই না। ,

(৪) কার্যকারণের অনিবার্যতা ধারণা মানসিক অভ্যাসের ফলঃ দার্শনিক হিউম বলেন, অভিজ্ঞতা দ্বারা আমরা বিষপান এবং মৃত্যু পরপর ঘটতে দেখি। কিন্তু দু’টি ঘটনার মধ্যে কোনাে অনিবার্য সম্পর্ক প্রত্যক্ষ করি না। কাজেই বিষপানে ভবিষ্যতে মৃত্যু ঘটবে এ কথা নিশ্চিতরূপে বলা যাবে না বা আমরা বলতে পারি না। সুতরাং অভিজ্ঞতার সাহায্যে কার্যকারণ সম্বন্ধকে অনিবার্য সম্বন্ধরূপে প্রমান করা যায় না। হিউমের মতে, কার্যকারণের অনিবার্যতার ধারণা আসলে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আমাদের মানসিক অভ্যাসের ফল।

(৫) কার্যকারণ সম্পর্ক আসলে ঘটনার পূর্বাপর সম্পর্কঃ অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি যে, আগুনে হাত দিলেই হাত পুড়ে। “আগুনে হাত দেয়া” এবং “হাত পুড়ে যাওয়া” এ দুটি ঘটনা আমাদের মনে এমনভাবে সংযুক্ত হয়েছে যে, প্রথমটি দেখলেই আমরা দ্বিতীয়টির প্রত্যাশা করি। সুতরাং হিউমের মতে, কার্যকারণ সম্পর্ক ঘটনার পূর্বাপর সম্পর্কের একরূপতা ছাড়া কিছুই নয়। কারণ হলাে কার্যের নিয়ত অপরিবর্তিত পূর্ববর্তী ঘটনা এবং কার্য হলাে কারণের নিয়ত অপরিবর্তিত পরবর্তী ঘটনা। অভ্যাসপ্রসূত প্রত্যাশা থেকেই কার্যকারণের মধ্যে অনিবার্য সম্বন্ধের ধারণা জন্মায়। এটি আসলে আমাদের মনের সংস্কার ছাড়া অন্য কিছু নয়।

সমালােচনাঃ হিউমের কার্যকারণ মতটি তীব্রভাবে দার্শনিকগণ সমালােচনা করেছেন। নিম্নে তা প্রদত্ত হলাে-

প্রথমতঃ হিউম কারণকে কার্যের অপরিবর্তনীয় পূর্ববর্তী ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন। এ মতবাদ স্বীকার করে নিলে দিনকে রাতের কারণ এবং রাতকে দিনের কারণ বলে মেনে নিতে হয়। কিন্তু আমরা জানি, এদের কোনােটিই কোনােটির কারণ নয়। উভয়ই অপর একটি শর্তের অধীন এবং একই কারণের সহ-কার্য। বস্তুত কারণ শুধু অপরিবর্তনীয় পূর্ববর্তী ঘটনাই নয়। শর্তহীন পূর্ববর্তী ঘটনাও বটে। “কারণ” অন্য কোনাে শর্তের অধীন না হয়েই কার্য উৎপাদন করে। কাজেই কারণ ও কার্যের মধ্যে যে অনিবার্য সম্পর্ক আছে একথা অনস্বীকার্য।

দ্বিতীয়তঃ হিউম একজন অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক। তার মতে, যা অভিজ্ঞতায় পাওয়া যায় না তা সত্য নয়। কাজেই তিনি কার্যকারণের অনিবার্য ধারণাকেও অভিজ্ঞতায় পেতে চেয়েছেন। কিন্তু অনিবার্য ধারণাসমূহ হলাে অভিজ্ঞতাপূর্ব ধারণা, অভিজ্ঞতায় এগুলাে পাওয়া যায় না। কাজেই কারণের ধারণাকে অভিজ্ঞতায় খোজা বােকামীরই নামান্তর।

তৃতীয়তঃ হিসাব মত মেনে নিলে আরােহ অনুমান, বিজ্ঞানসম্মত ভবিষ্যদ্বাণী বা গণনাকার্য অর্থহীন হয়ে পড়ে। বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তসমূহ প্রকৃতির নিয়মানুবর্তিতা নিয়ম এবং কার্যকারণ নিয়মের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং নিশ্চিত। কিন্তু হিউমের মত মেনে নিলে এগুলােকে আর নিশ্চিত বলা যাবে না, সম্ভাব্য বলতে হবে। এ অর্থে হিউমের মত অগ্রহণযােগ্য।

চতুর্থতঃ হিউম কার্যকারণ নিয়মকে ঘটনার পারম্পর্য বলে ব্যাখ্যা করেছেন। দুটি ঘটনার মধ্যে পারস্পার্য সম্পর্ক দেখা গেলই তাদের মধ্যে কার্যকারণ সম্বন্ধ আছে এ কথা বলা যাবে না। যেমন বিদ্যুতের চমক বজ্রধ্বনির মধ্যে কোনাে কার্যকারণ সম্পর্ক নেই যদিও তাদের মধ্যে পারম্পর্য বিদ্যমান রয়েছে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, হিউম কার্যকারণ সম্পর্ককে ঘটনার পূর্বাপর সম্পর্ক বলেছেন। তার মতে, কার্য ও কারাণের মধ্যে কোনাে কোনাে অনিবার্য সম্পর্ক নেই। আসলে কার্যকারণ সম্বন্ধ কেবল পূর্বাপর সম্পর্ক নয়, এ হলাে অনিবার্য সম্পর্ক। তাভিজ্ঞতাবাদী মিল নিজেও একথা স্বীকার করে নিয়েছেন। অনিবার্য সম্পর্কের ধারণা অভিজ্ঞতাপূর্ব, অভিজ্ঞতালব্ধ নয়। সুতরাং হিউমের কার্যকারণ মতবাদটি যদিও গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু একেবারে ত্রুটিমুক্ত নয়।

Rate this post