প্রশ্নঃ ‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসের আলােকে আরেফ আলীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ কর।

অথবা, “চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র আরেফ আলী নিঃসন্দেহে ঔপন্যাসিকের

আধুনিক জীবনবােধ ও বিশ্বাস-নিয়ন্ত্রিত।”- উক্তিটির যথার্থতা বিচার কর।

অথবা, “যুবক শিক্ষক চরিত্রকে ঔপন্যাসিক আধুনিক জীবন-ভাবনার অনুসারী করে তুলেছেন এবং এর ফলে চরিত্রে লেখকের আত্ম প্রক্ষেপ ঘটেছে।”- এ সম্পর্কে তােমার মতামত দাও।

উত্তরঃ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর (১৯২২-১৯৭১) ‘চাদের অমাবস্যা’ (১৯৬৪) উপন্যাসের ঘটনার মূল কেন্দ্রে রয়েছে মাত্র তিনটি চরিত্র। আরেফ আলী, কাদের ও দাদাসাহেব। দাদাসাহেব ও তথাকথিত দরবেশ কাদেরদের বড়বাড়ির ধর্মীয় পরিবেশের মুখােমুখি দাঁড় করানাে হয়েছে যুক্তিবাদী যুবক শিক্ষক আরেফ আলীকে। নিজের মনােলােকে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও কাঁটা হেঁড়া করে সে ধর্ম ও বিত্তবানের স্বরূপ উদঘাটনে এক দৃঢ় ভূমিকা নেয়। তিনটি মুখ্য চরিত্রের মধ্যে আরেফ আলী ও কাদের উপন্যাসের সমস্ত ঘটনার নিয়ন্ত্রক। দাদাসাহেব চরিত্রটি সে তুলনায় কিছুটা গুরুত্বহীন।

‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসটি আগাগােড়াই আরেফের জাগ্রত বিবেকের রক্তাক্ত পথ অতিক্রমণের নিপুণ অন্তর্বিশ্লেষণ। ওয়ালীউল্লাহ উপন্যাসের ত্রয়ী নায়ক মজিদ, মুহাম্মদ মুস্তফা ও আরেফ আলীর মধ্যে নিঃসন্দেহে এই সংবেদনশীল, স্বাপ্নিক ও মুখচোরা যুবক শিক্ষকই সবচেয়ে গভীর মানবদরদী। আত্মকেন্দ্রিকতার ঊর্ধ্বে ওঠা এই চরিত্রটি সবচেয়ে বেশি সামাজিক অঙ্গীকারবদ্ধ ও দায়িদ্ববােধসম্পন্ন হয়ে উঠেছে।

‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসে আরেফের সামান্য পরিচয় জানা যায়, সে গ্রামের মাইনর স্কুলের শিক্ষক। স্কুলের ন্যাড়া প্রাঙ্গণের মতাে তার জীবনও অনেকটা পত্র পল্লব পুষ্পহীন। রসশূন্য স্বাস্থ্য তার বয়স বাইশ-তেইশ কি তার শীর্ণ মুখে ও অনুজ্জ্বল চোয়ালে বয়েসী ভাব। কয়েক বছর আগে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রভাবে সে দাড়ি রেখেছিল কিন্তু এখন সে দাড়ি নেই, তবে থুতনির নিচে উলঙ্গভাবে এখনাে আছে। রসশূন্য স্বাস্থের জন্য তার চোখ কঠিন মনে হলেও লক্ষ করে দেখলে সে চোখে সরলতা, সময়ে সময়ে অসহায়তার নজরে পড়ে। সামান্য ছাতাপড়া জীর্ণ সবুজ আলােয়ান আধময়লা সাদা পায়জামা ধুলায় আবৃত, অপেক্ষাকৃত নতুন পাম্প সু’র বিবর্ণ মােড়কে সে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছে। তবে কখনাে তার মধ্যে যে উদ্ধতভাব ও দম্ভ দেখা যায়, তা শিক্ষকতাজনিত অহঙ্কারের কারণে।

পার্শ্ববর্তী চাদপরা গ্রামে যুবক শিক্ষক আরেফ আলীর বাড়ি। বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান আরেফ আলী কষ্টে-সৃষ্টে নিকটস্থ জেলা শহর থেকে আইএ পাস করেছে। আরাে পড়ার ইচ্ছে থাকলেও দারিদ্র্যের কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। গ্রামের বড়বাড়ির আশ্রিত সে। পরানে ও পরানুগ্রহেই আপাতত তার জীবন অতিবাহিত হলেও জীবনের প্রতি আজো তার অপার বিস্ময়বােধ ও কৌতূহল রয়েছে। ক্লাসঘরের পরিস্থিতিতে দাদাসাহেব ও কাদের মিঞার সঙ্গে মৃদু ব্যাক্যালাপে এবং টিচারস কমনরুমে দু’একটা সাদামাঠা কথাবার্তায় এবং মায়ের হাতে বেতন তুলে দিতে পারার সুখময় অনুভূতির বর্ণনা ছাড়া সামাজিক জীবনের প্রেক্ষাপটে তার চরিত্রের বিকাশ তেমন লক্ষ করা যায় না। নিস্তব্ধ রাতে জোৎস্নার মায়া আজো তাকে অভিভূত করে। তার মনে হয়, নীরব প্রকৃতিও কথা বলে এবং এ সময় মনপ্রাণ দিয়ে শুনতে চাইলে “অশ্রোতব্যও শ্রোত” হয়।

আরেফ এক জ্যোৎস্না রাতে দরবেশ নামে কথিত কাদেরকে চলনশীল দেখে কৌতূহলী হয়ে তাকে অনুসরণ করে। কিন্তু চাঁদের আলাের মােহিনী মায়ার প্রভাবে দ্রুতগামী কাদেরকে সে হারিয়ে ফেলে। হঠাৎ একটি বাঁশঝাড়ে কারাে আর্তচিৎকার এবং কারাে দ্রুত সরে যাওয়ার শব্দে সে এগিয়ে যায়। ভীত সন্ত্রস্ত আরেফ আলী বাঁশঝাড়ে গিয়ে দেখে “জন্তু জানােয়ার, সাপখােপ বা মাটালী ইদুর নয়, কোনাে পলাতক দুষ্ট ছাত্রও নয়, বাঁশঝাড়ের মধ্যে আলাে আঁধার। সে আলাে আধারের মধ্যে একটি যুবতী নারীর মৃতদেহ। অর্ধ-উলঙ্গ দেহ, পায়ের কাছে এক ঝলক চাদের আলাে।”

সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। আরেফ আলী জীবনে “জ্যান্ত মুরগি-মুখে হাল্কা তামাটে রঙের শেয়াল দেখেছে, বুনন বেড়ালের রক্তাক্ত মুখ দেখেছে, মানুষের দুঃখ-কষ্ট মহামারী হাহাকার দেখেছে কিন্তু কখমাে বিজন রাতে বাঁশঝাড়ের মধ্যে যুবতী নারীর মৃতদেহ দেখে নাই। হত্যাকারী দেখে নাই।” এ অভাবিত অভিজ্ঞতার পর আরেফ আলীর মানস পরিবর্তনের যাত্রা শুরু হয়। প্রচণ্ড মানসিক আঘাতে তার চিন্তা-চেতনা ক্রমশ এক বিচিত্র গােলক ধাধায় প্রবেশ করে। এক অস্বাভাবিক ঘােরের মধ্যে তার সমস্ত চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে যায়। আর তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সে দিশেহারা হয়ে দিগ্বিদিক ছুটে বেড়াতে থাকে। এক সময় ঘাের কাটলে সে বাস্তব ও লৌকিক জগতে ফিরে আসে। কিন্তু তার মাথা থেকে সহজে সরে যায় সেই কুহেলী ও চন্দ্রিমা। এরই মধ্যে শুরু হয় তার আত্মঅন্বেষা। বহির্জাগতিক কাজগুলাে সে প্রথামাফিক করে চলে কিন্তু ভেতরে ভেতরে বয়ে চলে অতি সূক্ষ্ম ও অবাস্তব এক অন্তস্রোত।

প্রথম রাতে বাঁশঝাড়ে যুবতী নারীর মৃতদেহ দেখে উদ্ৰান্ত যুবক শিক্ষক বনে জঙ্গলে ছুটোছুেটি করলেও ক্রমেই সে স্থিত হয়ে আসার চেষ্টা করে। পরদিন শ্রেণিকক্ষে তার ব্যবহার সকলকে বিস্মিত করে। নিজের এই অস্বাভাবিকতা সে নিজেও বুঝতে পারে। সে উপলব্ধি করে, তার স্বাভাবিক জীবন ক্রমশ যেন গুলিয়ে যায়। চিন্তার অপ্রতিরােধ্য বিস্তৃতিকে জয় করার জন্য সে সচেষ্ট হয় কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতা তাকে ব্রিত করে তােলে। “স্কুলে ও বাড়িতে তার বহির্জাগতিক অভিনয় চলে, তার মধ্যে তার মানস-রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হতে থাকে এক দ্বন্দ্ব-প্রতিদ্বন্দ্বে সংযুক্ত নাট্য।”

হঠাৎ সে অনুভব করে, বাঁশঝাড়ে কাদেরকে দেখে সে পালিয়েছিল হত্যাকাণ্ডটির সঙ্গে তার জড়িত থাকার সম্ভাবনায়। মনে মনে সে সাময়িক স্বস্তি পায় এই ভেবে “সে দৃশ্যটির সঙ্গে কোনাে পাপ-নৃশংসতা জড়িত, সে পাপ নৃশংসতা তাকে স্পর্শ করতে পারে না।” বাঁশঝাড়ের ঘটনাটির সে কেবল দর্শকমাত্র। কিন্তু কাদের তার ঘরে এসে মৃতদেহটি নদীতে নিক্ষেপ করার ব্যাপারে তাকে যখন নিয়ে যায় তখন সে যন্ত্রচালিতের মতাে কাদেরকে অনুসরণ করে। তার মন এ কাজে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থাকে। এরপর থেকে আরেফের সঙ্গে, নিজের সঙ্গে তার নিরন্তর লড়াই শুরু হয়।

পরদিন স্টিমারে সারেং কর্তৃক মৃতদেহটি আবিষ্কারের খবর জানার পর তার চেতনায় পুনরায় শুরু হয় তুমুল আলােড়ন। সহকর্মীদের বিচিত্র মন্তব্য এবং তাদের বিরূপ ও সংস্কারাবদ্ধ মানসিকতা আরেফের মনকে ঘৃণায় ভরিয়ে তােলে। সে চেষ্টা করে হত্যাদৃশ্যটিকে ভুলে যেতে। সে ভাবে, নিহত নারীটিকে সে চেনে না। ঘটনাটিকে সে নিছক একটি দুর্ঘটনা হিসেবে উড়িয়ে দিতে চায়। সে জানে, হত্যাকাণ্ডটির কথা প্রকাশ করলে কাদেরের শাস্তি অনিবার্য। আর তাতে আরেফও হারাবে বড়বাড়ির নিশ্চিত আশ্রয়। তদুপরি একটি অপচয়িত জীবনের জন্য আরেকটি জীবনের অপচয় ঘটানাে কতটুকু সঙ্গত তা ভেবেও সে বেদনাদীর্ণ হয়। ফলে সে নানাভাবে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে থাকে। সে মনে মনে কাদেরের মধ্যে একজন প্রেমিক পুরুষ কল্পনা করে তাকে ক্ষমাও করে ফেলে। কিন্তু কাদেরের নির্মম স্বীকারােক্তি তার মানসে পুনরায় তুমুল আলােড়ন তােলে।

আরেফ আলী বুঝতে পারে, শ্রেণি-বিভক্ত এ সমাজে অভিজাত পরিবারের সন্তান কাদেরের পক্ষে দরিদ্র মাঝির স্ত্রীকে ভালােবাসা অবান্তর ব্যাপার। মেয়েটি আসলে নিহত নারীটির প্রতি কাদেরের এই নির্মমতা ইন্দ্রিয় পরায়ণতা ও সহানুভূতিহীনতা আরেফকে তার কর্তব্যকর্ম সম্পর্কে সচেতন করে তােলে। কাদের তাকে নানারকম ভীতি প্রদর্শন করে। সে নিজেও জানে, সত্য ব্যাপারটি প্রতিষ্ঠিত করা তার পক্ষে কষ্টকর হবে। কিন্তু সে মনে করে, ঘটনাক্রমে এক অস্বস্তিকর কুৎসিত বাস্তবতার মুখােমুখি হয়ে সে এক কঠিন দায়িত্বভারে আক্রান্ত হয়েছে। ইচ্ছে করলেও এ থেকে সে পালিয়ে যেতে পারে না। তার মতে, মানুষের জীবন এত মূল্যহীন নয়। তাই নিজের সমূহ বিপদের সম্ভাবনার কথা জেনেই সে ঘটনাটি। দাদাসাহেব ও পুলিশকে জানায়। সত্য প্রকাশের দায়িত্বভার এমনই প্রবল যে, কোনাে ভয় কিংবা পরিণামভীতি আরেফ আলীকে তার কর্তব্য থেকে বিরত করতে পারেনি। যুবক শিক্ষক এতদিন দাদাসাহেবকে যা বলতে পারেনি সেই নির্মম, অপ্রিয় অথচ অনিবার্য সত্যই দ্বিধাহীনভাবে ও প্রত্যয়দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করেছে পনেরাে পরিচ্ছেদে কাদের মিঞা একটি মেয়েলােককে খুন করেছে।”

জীবনবােধের গভীরতা থেকে আরেফ আলী প্রত্যয় অর্জন করেছিল। সে প্রত্যয় গড়ে উঠেছিল মুক্তি ও আদর্শের মাযােগে। তাই সে নিরাপদ আশ্রয়, নিরাপদ জীবন পেছনে ফেলে সত্য প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, যে পুলিশ কাদেরের বিরুদ্ধে কোনে ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি, বরং উল্টো আরেফকেই গ্রেফতার করেছে। এমন একটা পরিস্থিতি ঘটতে পারে সে আশঙ্কা আরেফ আগেই করেছিল। সে এই ভেবে স্বস্তি পায় যে, “যুবতী নারীর মৃত্যুর জন্য সে-ই যদি অবশেষে শাস্তি পায়, তবে শাস্তিটা আসলে যার উদ্দেশ্যে যেখানে তা পৌছুবে।”

অতঃপর বড় বাড়ির দুবছরের নিরুপদ্রব জীবনের সব আকর্ষণ, সুখ স্বেচ্ছায় বিসর্জন দিয়ে যুবক শিক্ষক দুক্রোশ দূরে আদালতের সামনে যে থানা, সে-থানায় উপস্থিত হয়ে পুলিশ কর্মচারীর নিকট নির্ভীক, নির্ধিধ ও মীমাংসি চিত্তে কাদেরই করিম মাঝির বউয়ের হত্যাকারী বলে ঘােষণা করে।

এদিক থেকে ‘চাঁদের অমাবস্যা’, আরেফের বিদ্রোহের কাহিনি, প্রচলিত কায়েমি স্বার্থ, প্রথা অভিজাত্য ও ধ্যান ধারণার বিরুদ্ধে তার অনুচ্চ অথচ প্রত্যয়ী কণ্ঠের অনাস্থা এখানে ঘােষিত হয়েছে। ওয়ালীউল্লাহ এভাবেই নিতান্ত সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে বেছে নিয়ে একটি সাদামাটা, নিরীহ, ভীরু, দুর্বলচিত্তের মানুষকে সুগভীর জীবনবােধের প্রতীক করে তুলেছেন। উপন্যাসে আরেফ চরিত্র ও তার মানস ভাবনা সে অসরল ও অস্বভাবী পথে চলে, তার মূলে কিছুটা রয়েছে তার চরিত্রের মানস কাঠামাের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তবে এ কথাও সত্য যে, উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র নিঃসন্দেহে লেখকের আধুনিক জীবনবােধ ও বিশ্বাস-নিয়ন্ত্রিত। আর এ কারণেই আরেফ আলীর মতাে সাধারণ স্কুল শিক্ষকের মনােভাবনায় এক ধরনের দার্শনিকতা এবং তার মননে বুদ্ধিবৃত্তির সমুন্নত বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। আরেফ অশিক্ষিত দরিদ্র একটি পরিবারের সন্তান। কষ্টে সৃষ্টে কেবল আই.এ পাস করেছে নিকটস্থ জেলা শহরে। “জীবনে কখনাে সে পরিচিত নদী-খাল-বিল ক্ষেত্রের বাইরে কোথাও যায়নি।” সে গ্রামের মাইনর স্কুলের শিক্ষক এবং গ্রামের বড়বাড়ির আশ্রিত গৃহশিক্ষক। তাই তার চিন্তা-চেতনা সাধারণ স্তরের হওয়াই স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত ছিল। অথচ তার মধ্যে যে জীবনবােধ ও মননশীলতা লক্ষ করা যায় তা তার চরিত্রের পক্ষে অনেক বেশি উঁচুমাত্রার। তার চিন্তা-চেতনা দস্তুরমতাে দার্শনিকতাসমৃদ্ধ, যেমন-

ক. জীবনের মূল্য কী কেউ কখনাে সঠিকভাবে বুঝতে পারে? মানুষ সর্বদা জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে জীবনের মূল্য নিরূপণ করার চেষ্টা করে কিন্তু সক্ষম হয় কী? কী দিয়ে ওজন করে তুলনা করে? স্বর্ণকারের নিক্তিতেও তার মূল্য যাচাই করা যায় না। তার মূল্য নিরূপণের কোনে মানদণ্ড নাই।

খ. খাটি মানুষ অসঙ্কোচে দোষঘাট স্বীকার করে, কিন্তু হৃদয়ের সৌন্দর্য সহজে উন্মুক্ত করে না।

গ. নারীর উৎস কোথায়, কোথায়ই-বা জীবন মৃত্যুর উৎপত্তি? তা ছাড়া, জীবন কি সত্যই মৃত্যুর চেয়ে অধিকতর মূল্যবান।

আরেফ আলীর জীবন বাস্তবতার সঙ্গে তার মানস ভাবনার এই বিরােধকে স্বভাবতই অসঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে হয়। তবে সম্ভবত এর কারণ এই যে, এই চরিত্রকে আশ্রয়ের মাধ্যমে আধুনিক মনস্তত্ত্ব ভাবনা রূপায়িত করে পাশ্চাত্যরীতি মাফিক আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস রচনা করতে গিয়েই লেখক তার চরিত্রকে আধুনিক জীবন-ভাবনার অনুসারী করে তুলেছেন এবং এর ফলে চরিত্রে লেখকের আত্ম প্রক্ষেপ ঘটেছে। প্রসঙ্গত আরাে একটি ব্যাপার লক্ষণীয়, আরেফ আলী চারপাশের সমাজ পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কহীন একটি চরিত্র হওয়ায় তার চরিত্রের মহত্তম উত্তরণ ঘটেনি। সামাজিক সংঘাত ও সমস্যার অভিঘাতে এ চরিত্রের বিকাশ লক্ষ করা যায় না, বরং এটি বিকশিত হয়েছে লেখকের বক্তব্য বা তত্ত্বের স্পন্দনে। এখানেই চরিত্রটির সীমাবদ্ধতা।

মূলত, আরেফ চরিত্রের মধ্য দিয়ে লেখক তার দৃষ্টিভঙ্গি ও বক্তব্য তুলে ধরতে চেয়েছেন। বিশেষ পরিস্থিতিজাত ঘােলাটে নৈমিত্তিক অন্ধকারকে আমরা ‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসে পাই। যে অন্ধকার ঘনিয়ে উঠেছে প্রবলের অত্যাচারে, পুলিশের অত্যাচারে, ধনী এবং শক্তিমানের কাছে আমলাতন্ত্রের সাগ্রহ আত্মবিক্রয় এবং দুর্বলের অসহায়তায়।

উপন্যাসের মূল বিষয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে আরেফ। উপন্যাস লেখক দেখাতে চেয়েছেন, পূর্ব বাংলার গ্রামীণ সমাজে Polarization হচ্ছে। সেখানে ধর্মীয় গােড়ামি, অন্ধ আভিজাত্য ও কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে আধুনিকতা মনস্ক যুক্তিবাদী মানুষের জন্ম হচ্ছে তারা যদিও অর্থনৈতিকভাবে পরনির্ভর, শক্তির দিক থেকে দুর্বল কিন্তু তা সত্ত্বেও ক্রমেই তারা বাধা কাটিয়ে উঠছে এবং মেরুদণ্ড সােজা করে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে তারা জয়লাভ করতে পারছে না। তার কারণ, কায়েমি স্বার্থ ও প্রশাসনিক দাপটের হাতে তারা বন্দি।

আরেফ আলীর আত্মস্খনন, আত্মসন্ধান ও সত্য-আবিষ্কার-প্রক্রিয়ার উন্মোচনে বিশ্লেষণাত্মক পরিচর্যাও (analytical treatment) এ উপন্যাসে অনিবার্যতা পেয়েছে। এক্ষেত্রে চৈতন্যের দ্বিধাবিভক্তি এবং মনাে আদালতের বিন্যাসপ্রক্রিয়া সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর স্ব-উদ্ভাবিত শিল্পরীতি হিসেবে বিবেচ্য। আরেফ আলী কখনাে হত্যাকারী কাদেরের মুখখামুখি, কখনাে বিদীর্ণ চৈতন্যের টানাপােড়েনে অস্থির যন্ত্রণাদগ্ধ, আবার কখনাে বা সভ্যতা এবং মানবতার পক্ষে রায় দানকারী বিচারক। বহির্বাস্তবতার রূপায়ণে ঔপন্যাসিকের পরিচর্যারীতি বর্ণনাত্মক (narrative) ও চিত্রময় (pictorial) চরিত্র সমীকত দষ্টিকোণ উৎসারিত পরিচর্যার ক্ষেত্রে চিত্রময়তা থেকে বিশ্লেষণের গভীরে অনুপ্রবেশের প্রবণতাই মুখ্য। চাদের অমাবস্যার দষ্টিকোণ ও পরিচর্যার ক্ষেত্রে অন্তঃপ্রবাহী ভূমিকা পালন করেছে নাটকীয়তা আরেফ আলীর নব অভিজ্ঞতার উন্মােচন থেকে শুরু করে পরিণামী দৃশ্য পর্যন্ত নাটকীয় অন্তণ প্রবহমান।

সুতরাং সার্বিক আলােচনা থেকে বলা যায়- ‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসে একদিকে নিষ্ঠুর লম্পট খুনি কাদেরের কঠিন নির্দেশ ও ভয়ের তাড়নায় ভীরু, দুর্বল, অসহায় আরেফ আলীর উৎকণ্ঠা ও ভয়, অন্যদিকে তার নৈতিক চেতনা ও ক্রমবিকাশমান সাহসিকতা এ দুইয়ের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্বকে ঔপন্যাসিক অত্যন্ত সূক্ষ্ম তুলির আঁচড়ে এঁকেছেন এবং এভাবে অস্তিত্ব প্রয়াসীর সামগ্রিক সংকটের সঙ্গে তার সূক্ষ্ম যােগসূত্র রচনা করেছেন। সাত্রের অস্তিত্ববাদের আলােকে দেখলে দেখা যায়, আরেফ আলী মুখােশধারী সমাজের বাসিন্দা এবং পরান্নভােগী ও পরাশ্রয়ী হয়েও স্বাধীন ইচ্ছার পথে পা বাড়িয়েছে। বাঁশঝাড়ে নির্মম ঘটনার সাক্ষী হয়ে সে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে এক গভীর দায়িত্ব। বাইরের শক্তির কাছে সে নতি স্বীকার করেনি। নিজের নিশ্চিত আশ্রয় নষ্ট হবে জেনেও নিজের সিদ্ধান্তে সে অটল থেকেছে। সাত্রের মতাে সেও বিশ্বাস করে- “কর্ম-বৃত্তিতেই মুক্তি-স্ব-দাযিত্ব কর্ম-বৃত্তিতে।” এভাবে আরেফ আলী সক্রিয় কর্ম-বৃত্তিতেই অস্তিত্বময় হয়ে ওঠে।

2.3/5 - (3 votes)