ইতিহাস বিবর্তনের যে সূত্রগুলিকে মার্কস চিহ্নিত করেন – ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা বলে যা জনপ্রিয় তার মধ্যেই সমাজবিপ্লবের নির্দিষ্ট সম্ভাবনার প্রসঙ্গ রয়েছে। জার্মান আইডিওলজিতে মার্কস দেখাচ্ছেন। যে উৎপাদন পদ্ধতির বিবর্তনের এক বিশেষ পর্যায়ে যখন পুরানো উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে উৎপাদনশক্তির বিকাশ বাধা পায় তখনই সামাজিক বিপ্লবের সৃষ্টি হয়। পুরনো উৎপাদন সম্পর্কের বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন ঘটিয়ে তবেই উৎপাদনশক্তির বিকাশ ঘটে। সমাজের রূপান্তর ঘটে, পুরনো সমাজ রূপান্তরিত হয় পরবর্তী উন্নততর সমাজব্যবস্থায়। মার্কসীয় তত্ত্বে বিপ্লবকে দেখা হয় এক জটিল সংযোজিত পর্যায় হিসেবে যেখানে একাধিক পরস্পরবিরোধী শক্তির মধ্যে চলে দ্বন্দ্ব, টানাপোড়েন, পুরনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নতুন উৎপাদন শক্তির দ্বন্দ্ব, পুরনো শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে নিম্নকোটির মানুষজনের দ্বন্দ্ব এবং পুরনো শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে নতুন উদীয়মান শ্রেণীগুলির দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব চিরন্তন এবং নিরন্তর কারণ মানব ইতিহাস ত শ্রেণী সংগ্রামেরই ইতিহাস। ইতিহাসে সংঘটিত নানা বিপ্লবী অভ্যুত্থান নিয়ে মার্কস এবং এঙ্গেলস্ একাধিক রচনা প্রকাশ করেছেন, বিপ্লবের কারণ নিয়ে আলোচনা করেছেন। সিদ্ধান্তে এসেছেন, অতীতের সমস্ত বিপ্লবই পুরনো শাসকশ্রেণীর উচ্ছেদ ঘটিয়ে নতুন শাসকের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করেছে। তবে অতীতের সমস্ত বিপ্লব থেকে স্বতন্ত্র ভবিষ্যতের প্রলেতারীয় বিপ্লব, যে ঘটনা যাবতীয় শ্রেণী বিভাজনের সম্পূর্ণ অবসান ঘটাবে সে প্রসঙ্গে মার্কস তাঁর রচনায় বিক্ষিপ্তভাবে কিছু মন্তব্য করেছেন। ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার সূত্র ধরেই তাঁর অবস্থান হচ্ছে একমাত্র পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশ সম্পূর্ণ হলে এবং শ্রমিকশ্রেণীর পরিপূর্ণ আত্মপ্রকাশ ঘটলে তবেই ইতিহাসের সবচাইতে র‍্যাডিকাল, আমূল পরিবর্তনকারী প্রলেতারীয় বিপ্লব সম্ভব। তাঁর আশা এটা একমাত্র সম্ভব পশ্চিমের উন্নত পুঁজিবাদী শিল্পোন্নত দেশে যেখানে পুরো সমাজ শাসক শ্রেণী এবং শাসিত প্রলেতারিয় শ্রেণীতে স্পষ্টতই বিভক্ত। মার্কসীয় বিপ্লব তত্ত্বের প্রতিনিধিত্বমূলক ধারণাই সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত কমিউনিষ্ট ম্যানিফেস্টোতে যেখানে উন্নত পুঁজিবাদী দেশে পুঁজিবাদী অর্থনীতির উন্মেষ, বিকাশ, ক্রমপরিণতি এবং অন্তিম বিপর্যয়ের নিখুঁত রূপরেখা নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রলিতারীয় শ্রেণীর ক্রমবিকাশ এবং কালক্রমে বিপ্লবী সচেতনতা অর্জনের অবসম্ভাবিতা যা পূর্ব-নির্দিষ্ট তার নির্ঘণ্টে মার্কসের স্থির নিশ্চিত্ততা ছিল। পুঁজিবাদের যত অগ্রগতি হয় প্রলেতারিয়েত শ্রেণীরও তত বাড়বাড়ন্ত ঘটে। পুঁজিবাদের ধ্বংসের সম্ভাবনা, পুঁজিবাদের শোষণমূলক অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ নিয়মের মধ্যেই প্রথম থেকে বিরাজ করে। “পুঁজিবাদ নিজের কবর নিজেই খোঁড়ে’— এই আপ্তবাক্যটি মার্কসীয় বিপ্লব তত্ত্বের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। একমাত্র প্রলেতারিয় বিপ্লবই যে নতুন সমাজ গড়ে তুলবে, মার্কসের বিশ্বাস, তা হবে অতীতের যাবতীয় বিপ্লব থেকে গুণগত দিক থেকে একেবারেই আলাদা, যেখানে অতীতের যাবতীয় গ্লানি, ক্লেদ মুক্ত হয়ে মানবসমাজের সামনে নতুন যুগের দিশা উন্মুক্ত হবে। ইতিহাস প্রগতির এই অভূতপূর্ব সম্ভাবনা সম্ভব একমাত্র উন্নত পুঁজিবাদী দেশেই, অনুন্নত পিছিয়ে পড়া দেশে নয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশ এক নির্দিষ্ট পর্যায়ে উন্নীত হলে তবেই এই মুক্তির সম্ভাবনা থাকে, নতুবা নয়। সদ্য পুঁজিবাদী পথে পা বাড়ানো দেশগুলির অবিচল অপেক্ষা করা ছাড়া কোন পথ নেই।

উন্নত পুঁজিবাদী দেশে বিপ্লবের সম্ভাবনার বিশ্বাস অচিরে ভেঙ্গে পড়ে। ১৮৪৮ সালে ফ্রান্সে প্রলেতারিয় বিপ্লবের পরাজয় এবং ইংলন্ডে চার্টিস্ট আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাওয়ার দরুন মার্কসীয় বিপ্লব তত্ত্বের যে নিশ্চিত প্রকল্প তাতে আসে শূন্যতা। মার্কস তাঁর পরবর্তীকালের লেখায় স্বীকারও করেন যে শ্রমজীবি মানুষজনের সাময়িক কোন অভ্যুত্থানকেই তাঁরা উদ্দীপিত হয়ে এগুলির চূড়ান্ত সাফল্য কামনা করতেন। যৌবনকালের উচ্ছ্বাস থেকেই তাদের এই সিদ্ধান্ত এবং অবশেষে হতাশা। উন্নত ইউরোপ থেকে এরপর তাঁদের নজর সরে ইউরোপের অনুন্নত, পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলিতে, প্রথমে ব্রিটেনের প্রাচীনতম উপনিবেশ আয়ারল্যান্ডে এবং মূলতঃ রাশিয়ায়। তিনি লক্ষ্য করেন উন্নত পুঁজিবাদী দেশে ঔপনিবেশিক শোষণের ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক সমৃদ্ধ শ্রমিকশ্রেণীর যারা পুঁজিবাদী অর্থনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত বিপ্লববিমুখ। বরং বিপ্লবের সম্ভাবনা রয়ে গেছে রাশিয়ার মত পুঁজিবাদের পথে সদ্য অগ্রসর হওয়া দেশে। অনুন্নত কৃষকেরা যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। অবশ্য মার্কসের এই নতুন অবস্থান ছিল অস্ফুট, অস্পষ্ট তবে খানিকটা অন্য ইঙ্গিতবাহী। মনে রাখতে হবে মার্কসের এই পরিবর্তিত অবস্থান কখনই স্বতন্ত্র ডিসকোর্স হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেনি। পুরনো অবস্থান নিয়ে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করলেও পুরোপুরি বেরিয়ে আসেননি। বিপ্লব সম্পর্কে লেনিনের তত্ত্বকে বুঝতে হবে পিছিয়ে থাকা মূলতঃ আধাসামন্তবাদী-আধাপুঁজিবাদী রাশিয়ার প্রেক্ষিতে। পুঁজিবাদের পথে সবে পাবাড়ানো রাশিয়ায় বিপ্লবের তাত্ত্বিক লেনিন মার্কসের বিপ্লব তত্ত্বে ছেদ আনেন, গড়ে তোলেন এক ভিন্ন বিপ্লবী ঐতিহ্য।

মানব সভ্যতার ইতিহাসে সর্বপ্রথম সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে রাশিয়ায়। রাশিয়ার শ্রমিকশ্রেণীর বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে ১৯১৭ সালের অক্টোবর মাসে এই বিপ্লব সংঘটিত হয়। তারফলে রাশিয়ার রাষ্ট্রনীতিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে। পৃথিবীতে প্রথম একটি দেশে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। এ হল সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বা অক্টোবর বিপ্লবের শীর্ষ নেতা ছিলেন লেনিন। এই মার্কসবাদী তাত্ত্বিক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে ধারণাগত ও প্রায়োগিক আলোচনা করেন। স্বভাবতই বিপ্লব সম্পর্কিত লেনিনের আলোচনা মার্কসবাদকে অধিকতর সমৃদ্ধ করেছে। বিপ্লব সম্পর্কিত মার্কসবাদী আলোচনায় লেনিনের অবদান অনস্বীকার্য।

বিপ্লব সম্পর্কে লেনিনের ধ্যান-ধারণার উৎস রক্ষণশীল ঐতিহ্যের মধ্যেই বর্তমান। এই রক্ষণশীল ঐতিহ্য থেকেই বিপ্লব সম্পর্কিত লেনিনের ধারণাগত সূত্রপাত ঘটেছে। এর উত্তরাধিকার তিনি লাভ করেছেন। প্লেখানভ (Plekhanov)-এর কাছ থেকে। লেনিন তাঁর The Development of Capitalism in Russia শীর্ষক গ্রন্থে রাশিয়ার আর্থনীতিক বিকাশ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। এর থেকেও লেনিনের বিপ্লব সম্পর্কিত ধারণার সূত্রপাত ঘটেছে। লেনিন তাঁর What the Friends of the People Are শীর্ষক গ্রন্থে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, আর্থনীতিক কাঠামোগত বিচারে রাশিয়া ইতিমধ্যে ছিল মূলত পুঁজিবাদী। এই অবস্থায় বুর্জোয়ারা দুর্বল হওয়ার জন্য গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম সর্বহারাদেরই পরিচালনা করতে হবে। অনেকে এমন কথাও বলেন যে, উল্লিখিত গ্রন্থটিতে লেনিন স্বেচ্ছাপ্রণোদিত জ্যাকোবীয় (Jacobian) ধারায় আশু সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বলেছেন। লেনিন নিজে কিন্তু ‘সফল সাম্যবাদী বিপ্লব’ (Victorious Communist Revolution)-এর কথা বলেছেন। সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য পূর্বশর্ত হিসাবে লেনিন কিছু বিষয়ের কথা বলেছেন। সংশ্লিষ্ট পূর্বশর্তসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিপন্ন হয় যে, লেনিন সাম্যবাদী বিপ্লবের সাফল্যের বিষয়টিকে দূরবর্তী সম্ভাবনা হিসাবে দেখেছিলেন। ১৯১৬ সালে পুঁজিবাদ সম্পর্কিত আলোচনা লেনিনের ধ্যান-ধারণা সম্পর্কিত মৌলিক কাঠামোকে বহুলাংশে বদলে দেয়। তার আগে অবধি তিনি আশু সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বলেননি। ডেভিড ম্যাকলিলান (David Melellan) তাঁর Marxism After Marx শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে লিখেছেন: “Until then, his basic perspective was that of the proletariat leading a bourgeois revolution in a basically capitalist Russia.” বিপ্লব সম্পর্কিত লেনিনের বক্তব্যের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর নিম্নোক্ত রচনাসমূহে। এগুলি হল: The collapse of the Second International, Imperialism, Two Tactics of Soviet Democracy. Left-wing Communism-An infantile disorder, The Impending Catastrophe and How to combat It ইত্যাদি।

[1] বিপ্লবের ক্ষেত্রে কৃষকশ্রেণীর ভূমিকা সম্পর্কিত বিষয়ে লেনিনের ধ্যান-ধারণার নিজস্বতা ও নমনীয়তার পরিচয় পাওয়া যায়। কৃষক শ্রেণীকে রাজনীতিক ক্ষমতার সঙ্গে সংযুক্ত করার প্রস্তাব উত্থাপনের ব্যাপারে লেনিনকেই প্রথম মার্কসীয় দার্শনিক হিসাবে অভিহিত করা হয়। কৃষক শ্রেণীর ভূমিকার ব্যাপারে লেনিনের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অতিমাত্রায় সদর্থক। ক্লাসিক্যাল পশ্চিম ইউরোপীয় মার্কসবাদী পরিকল্পনায় উদারনীতিকদের যে অবস্থান স্বীকার করা হয়েছিল, লেনিন কৃষক শ্রেণীকে সেই অবস্থান দিয়েছেন। ১৯০৫ সালের বিপ্লবের ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে লেনিনের মধ্যে এই প্রত্যয়ের সৃষ্টি হয় যে, বিপ্লবের ভাগ্য প্রান্তিক গোষ্ঠীসমূহের বিশেষত কৃষক শ্রেণীর মনোভাবের উপর নির্ভরশীল। ১৯০৫ সালের গ্রীষ্মে লেনিন Two Tactics শীর্ষক একটি রচনা লেখেন। এই রচনায় তিনি সর্বহারা ও কৃষক শ্রেণীর বৈপ্লবিক গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব (revolutionary democratic dictatorship of the proletariat and peasantry)- এর কথা বলেন। ১৯০৬ সালে চতুর্থ পার্টি কংগ্রেসে লেনিন জমির জাতীয়করণ ও কৃষকশ্রেণীর মধ্যে তার বণ্টনের ব্যাপারে প্রস্তাব উত্থাপন করেন। লেনিন বলেছেন যে, বিপ্লব হবে গণতান্ত্রিক। কারণ লেনিন বিপ্লবের বুর্জোয়া প্রকৃতি সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন। লেনিন কিন্তু এবিষয়ে সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন যে, বুর্জোয়া বিপ্লবের সাফল্যের অব্যবহিত পরেই শুরু হবে সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম।

মার্কসীয় দর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে লেনিন কৃষক শ্রেণীর বৈপ্লবিক ভূমিকা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। লেনিনের অভিমত অনুযায়ী কৃষকশ্রেণী হল শ্রমিক শ্রেণীর মজুদবাহিনী। তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী শ্রমিকশ্রেণী বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করবে। তারপর সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা দরকার। তারজন্য কৃষির সঙ্গে শিল্পের সংযোগ এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন। কৃষকশ্রেণীর সক্রিয় সহযোগিতা এই সমস্ত ক্ষেত্রে একান্তভাবে অপরিহার্য। লেনিন জার-শাসিত রাশিয়ায় বিপ্লব পরিচালনা করেছেন। তখন তিনি প্রলেতারিয়েতের মিত্র হিসাবে কৃষকশ্রেণীকে বিপ্লবের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এ প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী শেপতুলিন তাঁর Marxist-Leninist Philosophy শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “He (Lenin) also established that the peasantry was an ally of proletariat.”

[2] মার্কস-এঙ্গেলস্ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বলেছেন। লেনিন বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল সূত্রটিকে বাস্তবে প্রয়োগ করেছেন। শুধু তাই নয়, লেনিন বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন কিভাবে বুর্জোয়া বিপ্লবকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে পরিণত করা যায়। লেনিনের অভিমত অনুযায়ী বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতৃত্ব থাকবে প্রলেতারিয়েতের হাতে। সমাজবিজ্ঞানী শেপতুলিন তার Marxist Leninist Philosophy শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “Lenin developed the Marxist teaching on the character and motive forces of the bourgeois democratic revolution and its connection with the socialist revolution, enriching the teaching with important conclusions.”

লেনিনের অভিমত অনুযায়ী বুর্জোয়া বিপ্লবের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে সৃষ্টি হয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু অনতিবিলম্বে এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের উপর প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির কর্তৃত্ব কায়েম হয়। রাষ্ট্র ক্ষমতা বুর্জোয়াদের দখলে আসার পরবর্তী পর্যায়ে বুর্জোয়াদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে পড়ে। তখন তারা অনন্যোপায় হয়ে গণতন্ত্রবিরোধী শক্তিসমূহের সঙ্গে সমঝোতা করে। এই অবস্থায় গণতন্ত্রের পরিপূর্ণ বিকাশের পথটি প্রতিহত হয় এবং প্রক্রিয়াটি অসমাপ্ত অবস্থায় আটকে যায়। শ্রমিক শ্রেণীর উপর সার্বিক সামাজিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব বর্তায়। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণী সম্পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব সম্পাদন করে। এইভাবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যে গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিপূর্ণতা পায়।

[3] সর্বহারার একনায়কত্বের জন্য মার্কসের মত লেনিন বিপ্লবের অপরিহার্যতার কথা বলেছেন। কিন্তু বিপ্লবের পদ্ধতি প্রসঙ্গে লেনিনের ধারণা কতকাংশে স্বতন্ত্র। কার্ল মার্কসের অভিমত অনুযায়ী বিপ্লব সর্বদাই হিংসাত্মক হবে এমন নয়। মার্কসবাদ অনুযায়ী হিংসা ও বিপ্লব ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত নয়। বিপ্লবের সঙ্গে হিংসা থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। লেনিন এ প্রসঙ্গে ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁর মতানুসারে সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লব অপরিহার্যভাবে হিংসাত্মক পথ অনুসরণ করবে। লেনিনের যুক্তি অনুযায়ী শোষক মালিকশ্রেণী শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামকে স্তব্ধ করে দেওয়ার লক্ষ্যে সহিংস শক্তিপ্রয়োগের পথ অবলম্বন করবে। এই অবস্থায় শ্রমিকশ্রেণীকেও বিপ্লবে বলপ্রয়োগ করতে হবে। শাসক ও শোষক শ্রেণী হিংসাত্মক উপায়ে সর্বহারা শ্রেণীর সংগ্রামী শক্তি ও চেতনাকে ধ্বংস করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সর্বতোভাবে উদ্যোগী হয়। শাসকশ্রেণীর হিংসাত্মক কার্যকলাপের প্রতিক্রিয়া হিসাবে সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লবে বলপ্রয়োগ ও হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে। বিপ্লবের সঙ্গে হিংসা এইভাবে সংযুক্ত হয়। তবে, লেনিনের মতানুসারে বিপ্লব হিংসা বা ধ্বংসের তাণ্ডব নয়, সৃষ্টির মহোৎসব। বিপ্লবের মাধ্যমে মেহনতী মানুষ নতুন সমাজ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে সক্রিয় ও সৃজনশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তাঁর অভিমত অনুযায়ী বিপ্লব হল উৎপীড়িত ও শোষিতের মহোৎসব, হিংসার তাণ্ডব নয়। লেনিনের কথায়: “Revolutions are the festivals of the oppressed and the exploited.” বস্তুত লেনিন বিপ্লবের সৃজনশীল চরিত্রের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

লেনিনের অভিমত অনুযায়ী বিপ্লবের শান্তিপূর্ণ ও হিংসাত্মক পথের মধ্যে সাধারণভাবে কোন বিরোধিতা থাকে না। শান্তিপূর্ণ পথেও সমাজের পরিবর্তন সম্ভব। কিন্তু তারজন্য দরকার হল উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রনীতির সুদীর্ঘ ঐতিহ্য এবং সামাজিক ভিত্তি। কোন দেশে এ রকম ঐতিহ্য ও ভিত্তি বর্তমান থাকলে সে দেশে গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিক রীতিনীতি অনুসরণ করে শ্রেণীসংগ্রাম পরিচালনা করা যায় এবং এই সংগ্রামকে বিকশিত ও সম্প্রসারিত করা যায়। এই পথে শ্রেণীসংগ্রামকে চরম পর্যায়েও উপনীত করা যায়। কিন্তু সমাজে প্রতিবিপ্লবী প্রবণতার কারণে বিপ্লব হিংসাত্মক হয়ে উঠে। শোষিতশ্রেণীর আন্দোলনকে শোষক শ্রেণী সশস্ত্র পথে স্তব্ধ করে দিতে উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করে। তখন বিপ্লবের ক্ষেত্রে হিংসার প্রয়োগ অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। যে দেশে শ্রেণীসংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ই রক্তরঞ্জিত, সে দেশে শান্তিপূর্ণ পথে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন সম্ভব নয়।

[4] লেনিন বিপ্লবের সূত্রপাতের ব্যাপারে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি দেশ ও কাল সম্পর্কে মার্কসীয় দর্শনকে বিকশিত ও বাস্তবমুখী করেছেন। লেনিনের অভিমত অনুযায়ী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যেখানে যত বেশী দুর্বল হবে ধনতন্ত্রের ভাঙ্গন সেখানে তত বেশী তরান্বিত হবে এবং প্রশস্ত হবে সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লবের পথ। শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবের অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি হবে ধনতন্ত্রের ভাঙ্গন প্রকট হলে।

মার্কসীয় দর্শন অনুসারে বিপ্লব সর্বপ্রথম সংগঠিত হবে শিল্পোন্নত দেশেই। মার্কসীয় মতবাদের এই বক্তব্যকে লেনিন পরিবর্তিত রূপে প্রতিপন্ন করেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী এমন কথা বলা যায় না যে, কেবল শিল্পোন্নত দেশেই সর্বহারার বিপ্লব প্রথম সংঘটিত হবে। লেনিনের মতানুসারে বিপ্লব সংঘটিত হবে। সেখানেই যেখানে সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খল সব থেকে দুর্বল হয়ে পড়েছে। লেনিনের বিপ্লবী নেতৃত্বে বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শিল্পে অনগ্রসর রাশিয়ায়।

আর একটি প্রচলিত মার্কসীয় ধারণা হল যে, বুর্জোয়া বিপ্লব প্রথম হবে শিল্পে অনগ্রসর দেশে। বুর্জোয়ারা বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করবে এবং ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে চূড়ান্তভাবে বিকশিত করবে। তারপরই সংঘটিত হবে সর্বহারার বিপ্লব। অর্থাৎ বুর্জোয়া বিপ্লব ও সর্বহারার বিপ্লবের মধ্যে ব্যবধান বর্তমান। এ বিষয়ে লেনিনের ব্যাখ্যা অনেকাংশ আলাদা। লেনিনের অভিমত অনুযায়ী বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং সর্বহারার বিপ্লব অভিন্ন শৃঙ্খলে আবদ্ধ। জারতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র এবং ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লেনিন সর্বহারা শ্রেণীর সুস্পষ্ট প্রাধান্যের কথা বলেছেন।

[5] লেনিন বিপ্লবের সূত্রপাত সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বিপ্লবী পরিবেশের কথা বলেছেন। বিপ্লব কোন আকস্মিক ঘটনা নয়। বিপ্লব সংঘটিত হয় উপযুক্ত এক বৈষয়িক পরিবেশে। আর্থনীতিক বিচারে বিপ্লব অপরিহার্য হয়ে উঠে তখনই যখন বাস্তব পরিবেশ উপযোগী হয়। বিপ্লবের পূর্বশর্ত হিসাবে তিনি বিপ্লবী পরিবেশের উপর জোর দিয়েছেন। লেনিনের অভিমত অনুযায়ী বিপ্লবের সূত্রপাত করে সমাজের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। বিপ্লবের গতি ত্বরান্বিত হয় বাহ্যিক দ্বন্দ্বের দ্বারাও। বাহ্যিক দ্বন্দ্ব দেখা দেয় বিভিন্ন সমাজব্যবস্থার অসমান উন্নতির জন্য। বিপ্লবের পূর্বশর্ত হিসাবে লেনিন দু’ধরনের অবস্থার অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। এই দু’ধরনের অবস্থা হল: 

  • (ক) বস্তুগত বা বিষয়গত অবস্থা (objective (conditions) এবং 

  • (খ) বিষয়ীগত অবস্থা (subjective conditions).

(ক) লেনিন বিপ্লবের বিষয়গত অবস্থা বলতে বুঝিয়েছেন বৈপ্লবিক পরিস্থিতি বা অবস্থা (revolutionary situation)-র কথা। লেনিন বৈপ্লবিক পরিস্থিতি সৃষ্টির সহায়ক কতকগুলি সমস্যা চিহ্নিত করেছেন। এই সমস্যাগুলি হল: (১) দেশে বিভিন্ন চরম সমস্যার জন্য শাসকশ্রেণীর নীতিতে সংকট দেখা দিলে এবং কোন পরিবর্তন ব্যতিরেকে শাসকশ্রেণীর পক্ষে দেশ শাসন অসম্ভব হয়ে পড়লে; (২) শোষিত শ্রেণীর দারিদ্র্য ও দুর্দশা অস্বাভাবিকভাবে প্রকট হয়ে পড়লে; এবং (৩) শোষণের অবসানের উদ্দেশ্যে সাধারণ মানুষ স্বাধীনভাবে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনে প্রস্তুত হলে। সুতরাং বিপ্লবের বস্তুগত অবস্থা সৃষ্টি না হওয়া অবধি বিপ্লব সংঘটিত হয় না।

(খ) অনুরূপভাবে আবার বিপ্লবের শুধুমাত্র বিষয়গত উপাদান বর্তমান থাকলেই বিপ্লবের ঘটনা ঘটে না বা বিপ্লবের সাফল্য সুনিশ্চিত হয় না। বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং সাফল্য লাভ করে বিপ্লবের বিষয়গত উপাদানসমূহের সঙ্গে বিষয়ীগত উপাদানসমূহের সংযুক্ত অবস্থানের মাধ্যমে। লেনিন বিপ্লবের কতকগুলি বিষয়ীগত উপাদান চিহ্নিত করেছেন। এই উপাদনাগুলি হল: (১) জনগণের বিপ্লবী চেতনা, সংগ্রামী মানসিকতা ও দৃঢ়তা; (২) সকল সংগ্রামী শক্তিকে কেন্দ্রীভূত করার কাজে অগ্রগামী বাহিনীর সংগঠন; (৩) সংগ্রামী অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এবং নির্ভুল রণনীতি ও রণকৌশল নির্ধারণে ও জনগণকে নেতৃত্বদানে সক্ষম একটি রাজনীতিক দলের অস্তিত্ব।

রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানীদের অনেকের অভিমত অনুসারে সমকালীন পশ্চিম ইউরোপের ধনতান্ত্রিক বিকাশের পর্যায়ের সঙ্গে রাশিয়ার আর্থনীতিক বিকাশের পর্যায় সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। রাশিয়ায় তখনও ধনতান্ত্রিক আর্থ-সামাজিক বিকাশ উপযুক্ত অবস্থায় উপনীত হয়নি। সমালোচকদের অভিযোগ অনুযায়ী বিপ্লবের বস্তুগত বা বিষয়গত অবস্থা সৃষ্টি হয়নি। স্বভাবতই সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বা অক্টোবর বিপ্লবকে বিষয়ীগত উপাদানসমূহের উপর বিশেষভাবে নির্ভর করতে হয়েছে। এই বিষয়টিকে ধ্রুপদী মার্কসবাদ থেকে বিচ্যুতি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। লেনিনের অভিমত অনুযায়ী বিপ্লবের বস্তুগত বা বিষয়গত অবস্থা ও বিষয়ীগত উপাদানসমূহ কখনই সম্পূর্ণ পরস্পর বিচ্ছিন্ন অবস্থায় অবস্থিত থাকে না। মার্কসীয় দর্শন অনুযায়ী বিষয়গত অবস্থা এবং বিষয়ীগত উপাদানসমূহ পারস্পরিক দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক-নির্ভর। রাশিয়াতে বিষয়গত পরিস্থিতি বা অবস্থার অস্তিত্ব ছিল। স্বভাবতই বিষয়ীগত উপাদানসমূহের উদ্ভব স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটেছিল।

ঊনবিংশ শতাব্দীর পটভূমিতে প্রণীত হয়েছে ধ্রুপদী মার্কসীয় দর্শন। বিংশ শতাব্দীতে একচেটিয়া পুঁজিবাদের উগ্র সাম্রাজ্যবাদী অভিব্যক্তি ঘটে। তারফলে বিষয়গত পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের পরিবর্তন ঘটে। পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে লেনিন মার্কসবাদের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে লেনিনের উদ্যোগ-আয়োজনকে মার্কসবাদ থেকে বিচ্যুতি বলা যায় না। লেনিনের এই ভূমিকার ফলে মার্কসীয় দর্শনে সৃষ্টিশীল সংযোজন ঘটেছে। লেনিন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিষয়গত পরিস্থিতিকে প্রতিপন্ন করেছিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে অভিন্ন প্রেক্ষিতে বিষয়ীগত উপাদানসমূহের সপক্ষে বক্তব্যকে বিন্যস্ত করেছিলেন। পুঁজিবাদী আর্থনীতিক সংকটকে রাজনীতিক সংকটে রূপান্তরিত করা এবং সামাজিক বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় সমগ্র ব্যবস্থাটির মূলোৎপাটনের ক্ষেত্রে লেনিনের উদ্যোগ-আয়োজনের সদর্থক দিকটিকে অস্বীকার করা যায় না।

Rate this post