গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর দাক্ষিণাত্যে বেশ কয়েকটি রাজবংশের উদ্ভব হয়। এদের মধ্যে অন্যতম ছিল চালুক্য বংশ। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতক পর্যন্ত চালুক্য বংশ দাক্ষিণাত্যের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চালুক্যদের আদি পরিচয় সম্পর্কে মতভেদ আছে। দীনেশচন্দ্র সরকার, রামশরণ শর্মার মতে, চালুক্যরা ছিল দাক্ষিণাত্যের কানাড়া অঞ্চলের দ্রাবিড় জাতির মানুষ। ভিনসেন্ট স্মিথের মতে, এরা ছিল গুর্জর বংশের একটি শাখা। সম্ভবত এই বংশের পূর্বপুরুষ চল্ক বা চালুকের নাম থেকে চালুক্য নামের উদ্ভব হয়েছে। প্রথমে এরা বাদামী বা বাতাপিতে রাজধানী স্থাপন করে রাজ্যশাসন করে। তাই এরা বাতাপি বা বাদামির চালুক্য নামে পরিচিত। পরবর্তীকালে এদের আরো দুটি শাখা বেঙ্গী ও কল্যাণীকে কেন্দ্র করে রাজত্ব পরিচালনা করেছিল। রাজধানীর নামানুসারে এরা বেঙ্গীর চালুক্য ও কল্যাণীর চালুক্য নামে অভিহিত হত।

বাদামি’র চালুক্য বংশ :

বাকটিক বংশের পতনের যুগে বাতাপি বা বাদামির চালুক্য বংশের উত্থান ঘটেছিল। আইহোল জৈন মন্দিরে জৈন কবি রবিকীর্তি রচিত প্রশস্তি থেকে চালুক্য রাজাদের নানা তথ্য পাওয়া যায়। বাতাপি বা পশ্চিম চালুক্য রাজবংশের প্রথম পর্বের শাসক হিসেবে এই প্রশস্তিতে জয়সিংহ, রনরাজ, প্রথম পুলকেশী, কীর্তিবর্মন, মঙ্গলেশ ও দ্বিতীয় পুলকেশীর নাম উল্লেখিত আছে। এঁদের মধ্যে প্রথম পুলকেশীই সর্বপ্রথম ‘মহারাজা’ উপাধি নিয়েছিলেন। তাই অনুমান করা হয় যে, প্রথম দু’জন হয়ত কারো সামন্ত রাজা ছিলেন। অর্থাৎ স্বাধীন চালুক্য শাসনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন প্রথম পুলকেশী (৫৩৫-৫৬৬ খ্রিঃ)। বিজাপুর জেলার অন্তর্গত বাতাপিপুরা বা বাদামিতে তাঁর রাজধানী স্থাপিত ছিল। কয়েকটি রাজ্য বিজয়ের পর তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করে কর্তৃত্বের পরিচয় দেন। বাদামিতে তিনি একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তী শাসক ছিলেন তাঁর পুত্র প্রথম কীতিবর্মন (৫৬৬-‘৯৭ খ্রিঃ)। সুযোদ্ধা ও সাম্রাজ্যের সংগঠক হিসেবে তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন। কোঙ্কনের মৌর্যদের, বনবাসীর কদম্বদের এবং বেলারী অঞ্চলের নলদের পরাজিত করে তিনি সাম্রাজ্য সম্প্রসারিত করেন। কথিত আছে যে কীর্তিবর্মন উত্তরমুখে বাংলা-বিহার এবং দক্ষিণমুখে চোল পাণ্ড্যরাজ্য পর্যন্ত চালুক্য রাজ্যসীমা সম্প্রসারিত করেছিলেন। একটি লিপিতে দাবী করা হয়েছে যে, তিনি অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, ভট্টুরা, মগধ, মদ্রক, কেরল, গঙ্গ, মুশাকা, পাণ্ড্য, চোল প্রমুখ রাজ্যকে পরাজিত করেছিলেন। ড. দীনেশচন্দ্র সরকারের মতে, প্রথম কীর্তিবর্মনের রাজত্বকালে মহারাষ্ট্রের দক্ষিণভাগ, মাদ্রাজ ও মহীশূরের বহু অঞ্চলে চালুক্য বংশের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়েছিল। রাজ্যজয়ের পাশাপাশি সুনির্মাতা হিসেবেও তিনি সফল ছিলেন। তাঁর উদ্যোগে রাজধানী বাতাপি বহু সুদৃশ্য মন্দির ও প্রাসাদ দ্বারা শোভিত হয়েছিল। কীর্তিবর্মনের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই মঙ্গলেশ সিংহাসনে বসেন (৫৯৮ খ্রিঃ)। তিনি কলচুরিদের বশ্যতা আদায় করেন এবং কোঙ্কন উপকূলে রত্নগিরি জেলা অধিকার করেন। তাঁর এই সাফল্যের ফলে মধ্য এবং উত্তর মহারাষ্ট্র অঞ্চলে চালুক্যদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য স্থাপন করা সম্ভব হয়েছিল। মঙ্গলেশ বিষ্ণুর উপাসক ছিলেন এবং ‘পরমভাগবত’ উপাধি নিয়েছিলেন।

বাতাপির চালুক্য বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন দ্বিতীয় পুলকেশী (৬০৯-৬৪২ খ্রিঃ)। কীর্তিবর্মনের পুত্র দ্বিতীয় পুলকেশী মঙ্গলেশকে হত্যা করে আনুমানিক ৬০৯/৬১০ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসন দখল করেছিলেন। তিনি ৬৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। সিংহাসনে কিছুকাল তিনি বিদ্রোহী সামন্তদের দমনের কাজে লিপ্ত থাকেন। রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পর তিন রাজ্যবিস্তারে মন দেন। জৈন কবি রবিকীর্তি রচিত ‘আইহোল- প্রশস্তি’ থেকে তাঁর রাজ্যজয়ের বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া যায়। দ্বিতীয় পুলকেশী প্রথমে দক্ষিণ-ভারত বিজয়ে অগ্রসর হন। কদম্বদের রাজধানী বনবাসী তাঁর অধিকারভুক্ত হয়। মহীশূরের গঙ্গ এবং উত্তর-কোঙ্কনের মৌর্যগণও তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে। গুজরাটের লাটগণ, মালবগণ এবং ব্রোচের গুর্জরগণ তাঁর অধীনতা স্বীকার করে। এইভাবে দক্ষিণ ভারতে চালুক্য-শক্তি অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠে।

দ্বিতীয় পুলকেশী যখন দক্ষিণ ভারতে রাজ্যবিস্তারে ব্যস্ত ছিলেন, তখন উত্তর-ভারতে পুষ্যভূতি বংশের হর্ষবর্ধনও নিজেকে ‘সার্বভৌম সম্রাট’ রূপে প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় রত ছিলেন। সকলোত্তরপথনাথ হর্ষ নর্মদা নদী অতিক্রম করে দক্ষিণে রাজ্যবিস্তারে উদ্যত হলে দ্বিতীয় পুলকেশীর সাথে সংঘর্ষ বাধে। হর্ষবর্ধন এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দক্ষিণ ভারতে বিজয়ের আশা ত্যাগ করেন। দ্বিতীয় পুলকেশীর পরাক্রমে ভীত-সন্ত্রস্ত মহাকোশল ও কলিঙ্গের রাজাগণ চালুক্যরাজ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। পিষ্ঠপুরের দুর্গ দ্বিতীয় পুলকেশীর হস্তগত হয়। নিজভ্রাতা বিষ্ণুবর্ধনকে তিনি পিষ্ঠপুরের শাসক নিযুক্ত করেন। এইভাবে ‘পূর্বাঞ্চলের চালুক্যবংশের সূচনা হয়।

অতঃপর দ্বিতীয় পুলকেশী তুঙ্গভদ্রার দক্ষিণে (সুদূর দাক্ষিণাত্য) রাজ্যবিস্তারে উদ্যোগী হন। পল্লবরাজ প্রথম মহেন্দ্রবর্মনকে পরাজিত করে তিনি পল্লব রাজধানী কাঞ্চীর সন্নিকটে উপস্থিত হন। কাঞ্চীতে লুণ্ঠন চালিয়ে বিজয়ী চালুক্যবাহিনী কাবেরী নদী অতিক্রম করে চোল, কেরল ও পাণ্ড্যদের বশ্যতা আদায় করে। এইভাবে দ্বিতীয় পুলকেশী নর্মদা থেকে কাবেরী নদীর দক্ষিণের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের উপর নিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। পল্লবদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় পুলকেশীর সাফল্য দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। পল্লবরাজ প্রথম নরসিংহবর্মন তাঁর পিতার পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে বাতাপি আক্রমণ ও বিধ্বস্ত করেন। এই যুদ্ধে দ্বিতীয় পুলকেশী পরাজিত ও নিহত হন বলে মনে করা হয়।

দ্বিতীয় পুলকেশী ছিলেন চালুক্যবংশের শ্রেষ্ঠ নরপতি। চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাঙ দ্বিতীয় পুলকেশীর রাজত্বকালে দাক্ষিণাত্য পরিভ্রমণ করেন। তিনি দ্বিতীয় পুলকেশীকে দক্ষিণ ভারতে ‘সবচেয়ে শক্তিশালী নরপতি’ বলে উল্লেখ করেছেন। শাসক হিসেবেও তাঁর দক্ষতা ছিল প্রশংসনীয়। তিনি পারস্যের শাসক দ্বিতীয় খসরুর সাথে মৈত্রী স্থাপন ও দূত বিনিময় করে বর্হিভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।

দ্বিতীয় পুলকেশীর রাজত্বকাল সম্পর্কে আইহোল প্রশস্তি’র বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় পুলকেশীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ইতিহাসমূলক সূত্র হিসেবে আইহোল প্রশস্তির অবদান অনস্বীকার্য। জৈন কবি রবিকীর্তি আনুমানিক ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে এই প্রশক্তি উৎকীর্ণ করেছিলেন। আইহোলি অঞ্চলে প্রায় ৭০টি মন্দির নির্মিত হয়েছিল। মেগুটি অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত এমনই একটি শিবমন্দিরে রবিকীর্তি দ্বিতীয় পুলকেশীর রাজত্বকাল বিষয়ক এই প্রশস্তিটি উৎকীর্ণ করেছেন। তাই সাধারণভাবে এটি ‘আইহোল প্রশস্তি’ বা ‘মেগুটি প্রশস্তি’ নামে পরিচিত। রবিকীর্তি ছিলেন দ্বিতীয় পুলকেশীর অন্যতম সভাসদ ও সভাকবি। চালুক্যরাজ ব্যক্তিগতভাবে জৈন ধর্মের অনুগামী ছিলেন। স্বভাবতই পৃষ্ঠপোষক রাজার ভূয়সী প্রশংসা আইহোল প্রশস্তির ছত্রে ছত্রে বিধৃত রয়েছে।

দ্বিতীয় পুলকেশীর রাজ্যবিস্তার এবং যুদ্ধযাত্রা প্রসঙ্গে আইহোল প্রশস্তি নানা তথ্য দেয়। পুষ্যভূতিদের সাথে চালুক্যদের সংঘর্ষ বিষয়ে কেবল আইহোল প্রশস্তিতে উল্লেখ পাওয়া যায়। এই প্রশক্তির ২৩ তম স্তবকে থানেশ্বরের পুষ্যভৃতি বংশীয় রাজা হর্ষবর্ধনের সাথে দ্বিতীয় পুলকেশীর যুদ্ধের বিবরণ আছে। এখানে বলা হয়েছে যে, ‘হর্ষের হর্ষ চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হয়েছে, যুদ্ধে দক্ষ হস্তিবাহিনী ভূপতিত হয়েছে। ২৮ তম স্তবকেও একই সুরে হর্ষের বাহিনীর বিরুদ্ধে চালুক্যরাজের সাফল্যের কাহিনী উৎকীর্ণ আছে। আইহোল প্রশক্তির বয়ান অনুযায়ী এই যুদ্ধ সংঘঠিত হয়েছিল বিন্ধ্যপর্বত এবং নর্মদা নদীর তীরবর্তী কোনো এলাকায়। এর অবস্থান ছিল দ্বিতীয় পুলকেশীর সাম্রাজ্যের উত্তর সীমান্তে। তবে এই প্রশস্তির বিশ্বস্ততা সন্দেহের অতীত নয়। কারণ হর্ষকে পরাজিত করার দাবি দ্বিতীয় পুলকেশীর তরফে করা হলেও, সকলোত্তর পথনাথ’কে পরাস্ত করার কৃতিত্ব এখানে দাবি করা হয়নি।

দ্বিতীয় পুলকেশীর মৃত্যুর পর পল্লবরা চালুক্যদের কয়েকটি অঞ্চল দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। পুলকেশীর পুত্রদের অর্ন্তদ্বন্দু পল্লবদের বিরুদ্ধে রাজ্য পুনরুদ্ধারের প্রয়াসগুলি ব্যর্থ করে দেয়। অবশেষে প্রথম বিক্রমাদিত্যর উদ্যোগে চালুক্যরা হৃত ক্ষমতা আংশিক পুনরুদ্ধার করতে পারে। তিনি গঙ্গ বংশ ও পাণ্ড্যরাজাদের সাথে মিত্রতাবদ্ধ হয়ে পল্লবদের বিরুদ্ধে অভিযান চালান এবং রাজধানী বাদামি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। বাদামিতে চালুক্য শাসন পুনঃস্থাপন করে তিনি বংশের মর্যাদা রক্ষা করেন। পল্লব শাসকরা ব্রাহ্মণদের ভূমিভোগের যে অধিকার কেড়ে নিয়েছিল, বিক্রমাদিত্য তা পুনরায় চালু করেন। পরবর্তী শাসকদের আমলেও চালুক্য-পল্লব সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল। বিক্রমাদিত্যর পুত্র বিনয়াদিত্য ৬৮১ থেকে ৬৯৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তিনি পল্লব, কলভ্র, কেরলগণ, ভীল, মালব, চোল, পাণ্ড্য, গঙ্গ প্রভৃতি রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। এমন কি ইরান (পার্সিক) এবং সিংহল (শ্রীলঙ্কা) রাজ্য থেকেও উপঢৌকন আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর পুত্র বিজয়াদিত্যর আমলেও পল্লব চালুক্য সংঘর্ষ চলেছিল। চালুক্য রাজা কাঞ্চি দখল করে কৃতিত্ব দেখান এবং পল্লব রাজা পরমেশ্বর বর্মনের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে সফল হন। বিজাপুর জেলার পটডাকলে তিনি একটি শিবমন্দির নির্মাণ করেছিলেন এবং জৈন ভিক্ষুদের সরকারী অনুদান প্রদান করে মহানুভবতা দেখিয়েছিলেন। পরবর্তীশাসক দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্যর আমলেও (৭৩৪-৪৫ খ্রিঃ) পল্লবদের সাথে সংঘর্ষ চলেছিল। সম্ভবত তিনি যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে পল্লবদের বহু সম্পদ ও হাতি দখল করতে সক্ষম হন। তিনি কাঞ্চিতে প্রবেশ করলেও মন্দির ধ্বংস করা থেকে বিরত ছিলেন। দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য চোল, কেরল, পাণ্ড্য, কলভ্র প্রমুখের বিরুদ্ধেও সকল অভিযান চালান এবং এই বিজয় অভিযানকে স্মরণীয় করে রাখতে দক্ষিণ সমুদ্রের তীরে একটি বিজয়স্তম্ভ নির্মাণ করেন। রাজ্য বিজয়ের পাশাপাশি শিক্ষা-সংস্কৃতি চর্চাও প্রসারের কাজেও তাঁর আন্তরিকতা ছিল।

দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্যই ছিলেন চালুক্য বংশের শেষ সফল শাসক। অতঃপর তাঁর পুত্র কীর্তিবর্মন (২য়) ৭৪৬ থেকে ৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ছিলেন। তাঁর দক্ষতার ছিল না। পিতার সাথে পল্লবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাম্রাজ্যের ভাঙ্গন রোধ করতে পারেন নি। রাজত্বের শেষ দিকে তিনি রাষ্ট্রকুট রাজা দস্তিদূর্গের কাছে পরাজিত হলে চালুক্যদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। দস্তিদুর্গের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় কীর্তিবর্মন বাতাপির চালুক্য বংশের প্রতিপত্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার নতুন চেষ্টা চালান। কিন্তু পরবর্তী রাষ্ট্রকূট রাজ প্রথম কৃষ্ণের কাছে তিনি পরাজিত হন। এর ফলে বাতাপির চালুক্য বংশের শাসনের অবসান ঘটে।

কল্যাণের চালুক্য বংশ :

রাষ্ট্রকুট বংশের শেষ দক্ষ শাসক ছিলেন তৃতীয় কৃষ্ণ। তাঁর মৃত্যুর পর (৯৬৮ খ্রিঃ) রাষ্ট্রকুটদের গরিমা নিম্নগামী হতে থাকে। দশম শতকের শেষ দিকে রাষ্ট্রকুটদের জনৈক চালুক্য-সামন্ত দ্বিতীয় তৈলপ বা তৈল রাষ্ট্রকুট-রাজ দ্বিতীয় কর্ককে পরাজিত করে কল্যাণে চালুক্য বংশের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। এঁদের ‘পরবর্তী চালুক্য বংশ’ও বলা হয়। দ্বিতীয় তৈলপ হায়দ্রাবাদের অন্তর্গত কল্যাণ অঞ্চলে রাজধানী গড়ে শাসন শুরু করেন (৯৭৫-৯৭ খ্রিঃ)। কল্যাণের চালুক্যগণ সম্ভবত বাদামির চালুক্যবংশের একটি শাখা ছিল। তৈলপ ছিলেন সুযোদ্ধা ও সংগঠন। পূর্বের বাদামির চালুক্যদের অধিকাংশ অঞ্চল তিনি পুনরুদ্ধার করেন। মালবের পারমার বংশীয় রাজাকে পরাজিত করে তাঁর রাজ্যের একাংশ তৈলপ অধিকার করেন। বাংলার পাল ও দক্ষিণের চেদি রাজাকেও তিনি পরাজিত করেন। দ্বিতীয় তৈলপের মৃত্যুর (৯৯৭ খ্রিঃ) পর যথাক্রমে সত্যাশ্রয়, দ্বিতীয় জয়সিংহ, প্রথম সোমেশ্বর ও দ্বিতীয় সোমেশ্বর ১০৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন।

পরবর্তী শাসক, ত্রিভুবনমল্লবা বিক্রমাদিত্য(১০৭৬-১১২৮ খ্রিঃ) ছিলেন কল্যাণের চালুক্যবংশের শ্রেষ্ঠ রাজা। কবি বিল্‌হন রচিত ‘বিক্রমাঙ্কদেব চরিত’ গ্রন্থ থেকে তাঁর রাজত্বের বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি সিংহাসনে বসে ‘চালুক্য বিক্রম অব্দ’ নামে একটি গণনাবর্ষ চালু করেন। ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য ছিলেন সুযোদ্ধা। প্রথম সোমেশ্বরের রাজত্বকালে অধিকাংশ সামরিক সাফল্য বিক্রমাদিত্যের কৃতিত্বে সম্ভব হয়েছিল। চোলরাজ কুলোতুঙ্গকে পরাজিত করে তিনি চোল রাজধানী দখল করেন। হোয়সল, কদম্ব, কাকতীয় প্রভৃতি রাজগণ তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেন। সিংহল রাজ্যের সাথেও তাঁর মিত্রতা ছিল। বিদ্যানুরাগী রূপেও তিনি খ্যাত ছিলেন। কাশ্মীরী কবি বিস্হন তাঁর রাজসভা অলংকৃত করেন। ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের আগ্রহে বিজ্ঞানেশ্বর মিতাক্ষরা আইন গ্রন্থ রচনা করেন।

ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের পর কল্যাণের চালুক্য-শক্তি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। অবশেষে দ্বাদশ শতকের শেষ দশকে দেবগিরির যাদবগণ ও মহীশূরের হোয়সলদের আক্রমণে কল্যাণে চালুক্য শাসনের অবসান ঘটে।

Rate this post