একত্ববাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া:

বহুত্ববাদ হল একত্ববাদের কেন্দ্রীভূত সর্বাত্মক ও অবাধ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিক্রিয়ার ফল। তবে বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় কেবল একত্ববাদের সমালোচনা হিসাবে নয়, স্বতন্ত্র রাষ্ট্রনৈতিক মতবাদ হিসাবে বহুত্ববাদ সুপ্রতিষ্ঠিত। বহুত্ববাদের স্বার্থক প্রবক্তা হিসাবে গিয়ার্কে (Gierke), মেইটল্যাণ্ড (Maitland), বার্কার, ল্যাঙ্কি, ম্যাকাইভার, কোল, ক্র্যাবে, লিওসে, দ্যুগুই (Duguit) প্রমুখ ব্যক্তির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এঁরা একত্ববাদের তীব্র সমালোচনা করেছেন। এঁরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করার পক্ষপাতী। সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত বহুত্ববাদের উদ্ভবের পিছনে দুটি মূল কারণ কাজ করছে। একটি হল একত্ববাদী আইনানুগ সার্বভৌমিকতার বিরোধিতা করা এবং অপরটি হল রাষ্ট্রের এলাকার মধ্যে বিভিন্ন সংঘ-সংগঠনের স্বাধীন অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করা।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী ধারণার বিরুদ্ধে বহুত্ববাদীদের প্রতিবাদ শুরু হয়। তবে বহুত্ববাদের বিকাশ এবং ব্যাপক প্রসার ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধ ও তার পরবর্তীকালে। অটো ভি. গিয়ার্কে ও এফ. ডব্লিউ. মেইটল্যাও-এর লেখায় এই প্রতিবাদের সূত্রপাত ঘটে। বহু লেখক ও বুদ্ধিজীবী এই প্রতিবাদের সামিল হতে থাকেন। কালক্রমে এই প্রতিবাদ একটি বৌদ্ধিক আন্দোলনে পরিণত হয়।

বহুত্ববাদী ধারণা:

বহুত্ববাদীদের মতানুসারে মানুষ হল সামাজিক জীব। মানুষের সামাজিক প্রকৃতি বিকশিত হয় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে। এই সমস্ত সংঘ-সংগঠন মানবসমাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠে। মানুষের সমাজজীবনের স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি হিসাবে এই সংগঠনগুলি গড়ে উঠে। এগুলি রাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্ট নয়। এই সমস্ত সংঘ-সংগঠনের শক্তির ভিত্তি হল মানুষের স্বাভাবিক আনুগত্য। এদের শক্তি রাষ্ট্রীয় শক্তির উপর নির্ভরশীল নয়। সমাজবদ্ধ মানুষ তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও বিবিধ প্রয়োজন পূরণের তাগিদে রাষ্ট্রের উপর নির্ভর করে। তেমনি অন্যান্য সামাজিক সংগঠনগুলির উপর মানুষের এই নির্ভরশীলতা আরও বেশি। ল্যাস্কি (Laski)-র মতানুসারে সমাজের প্রকৃতি যেহেতু সংঘমূলক, তাই কর্তৃত্ব বণ্টিত হওয়া দরকার। তিনি বলেছেন: “…because society is federal, authority must be federal also.

বহুত্ববাদীর মূল কথা:

এই মতবাদ অনুসারে রাষ্ট্রের ক্ষমতা চরম ও অসীম নয় এবং সার্বভৌমিকতাও অবিভাজ্য নয়। একত্ববাদীরা রাষ্ট্রের আইনগত চরম ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের কথা বলেন। বহুত্ববাদীদের মতানুসারে এই ধারণা নিতান্তই আনুষ্ঠানিক। এই ধারণাকে কার্যকর করা যাবে না। সমাজের অন্যান্য সংগঠনসমূহও রাষ্ট্রের মতই স্বাভাবিক ও গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রের মত এরাও সার্বভৌম। সংগঠনগুলি সমানাধিকারসম্পন্ন এবং এদের কার্যাবলীও গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান। রাষ্ট্র এদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। রাষ্ট্র অধিকতর শক্তিশালী হতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্র হল সমাজের মধ্যে অবস্থিত অসংখ্য সংগঠনের মধ্যে অন্যতম। সুতরাং আনুগত্যের জন্য অন্যান্য সামাজিক সংগঠনেরও দাবি আছে। এবং আনুগত্যের জন্য রাষ্ট্রের দাবিকে কোন অগ্রাধিকার দেওয়া যায় না। বস্তুত ব্যক্তির আনুগত্য এক নয়, একাধিক। তা ছাড়া রাষ্ট্রের প্রতি ব্যক্তির আনুগত্যকে সার্বভৌমিকতার একটি পূর্ব শর্ত হিসাবে গণ্য করা যায় না।

বিভিন্ন বহুত্ববাদীর বক্তব্য:

বিংশ শতাব্দীর এই বাস্তববাদী ধারণা সার্বভৌম ক্ষমতার উপর একচ্ছত্র আধিপত্যকে অস্বীকার করে। বহুত্ববাদে রাষ্ট্রকে কোন উচ্চতর মূল্য বা মর্যাদা দেওয়া হয় না। ম্যাবট (Mabbot) মন্তব্য করেছেন, “…Pluralism regards the state as a particular association with no superior value or status.” রাষ্ট্র সর্বশক্তিমান ও অবাধ ক্ষমতার অধিকারী হলে ব্যক্তিস্বাধীনতা বিপর্যস্ত হবে এবং সমাজের অন্যান্য সংঘসমূহের স্বাভাবিক অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে, বিভিন্ন ধরনের সংগঠনের মধ্যে রাষ্ট্রও একটি সংগঠন। তিনি বলেছেন: “The state is only one among many forms of human association.” তিনি রাষ্ট্রের আইনগত সার্বভৌমিকতাকে আইনের কল্পনা এবং শূন্যগর্ভ ধারণা বলে মনে করেন। ল্যাস্কি বলেছেন: “The doctrine of sovereignty is a legal fiction and barren association.” তাঁর আরও অভিমত হল: “It would be of lasting benefit to political science if the whole concept of sovereignty were surrendered.” তাঁর মতানুসারে রাষ্ট্রের চরম ও অসীম সার্বভৌমিকতার মতবাদ মানবজাতির স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বহুত্ববাদী বার্কারের মতানুসারে অন্য কোন রাষ্ট্রনৈতিক মতবাদ সার্বভৌম রাষ্ট্রের মতবাদ অপেক্ষা শুষ্ক ও মূল্যহীন নয়। বার্কার মন্তব্য করেছেন: “No political common place has become more arid and unfruitful than the doctrine of Sovereign State.” ক্র্যাব (Krabbe)-এর অভিমত অনুসারে ‘রাষ্ট্রনৈতিক তত্ত্ব থেকে সার্বভৌমিকতার ধারণাটিকে পরিহার করা দরকার। তিনি বলেছেন: “The notion of sovereignty must be expunged from political theory.”

লিগুসে-র মতানুসারে বাস্তব ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের চরমত্বের ধারণার গুরুত্ব আর নেই। তিনি বলেছেন : “If we look at facts, it is clear that the theory of sovereign state has broken down.” বহুত্ববাদীরা রাষ্ট্রকে ধ্বংস করতে চান না। তাঁরা সার্বভৌম রাষ্ট্রের ধারণাকে বিলুপ্ত করতে চান। এঁদের মূল বক্তব্য হল আধুনিক কালের পরিপ্রেক্ষিতে সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী ধারণা একত্ববাদের তুলনায় অধিক বাস্তবসম্মত ও উপযোগী।

বহুত্ববাদের বৈশিষ্ট্য:

ম্যাক্সি তাঁর Political Philosophy গ্রন্থে বহুত্ববাদী তত্ত্বের কতকগুলি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন। 

(১) সমাজবদ্ধ মানুষ বিভিন্ন ও বহু সামাজিক, আর্থনীতিক সংগঠনের মাধ্যমে তাদের স্বার্থ ও কল্যাণ সাধনের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। প্রকৃতিগত বিচারে রাষ্ট্রও হল এই রকম একটি সংগঠন। 

(২) মানুষের কাছে রাষ্ট্রের প্রয়োজন ও গুরুত্ব আছে। অনুরূপভাবে শ্রমিকসংঘ, বাণিজ্য-সংগঠন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি স্বেচ্ছামূলক সংগঠনগুলিরও প্রয়োজন ও গুরুত্ব আছে। 

(৩) এই সংগঠনগুলি স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমাজে গড়ে ওঠে। এগুলিকে রাষ্ট্র সৃষ্টি করে না। এদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল নয়। 

(৪) এদের উপর রাষ্ট্র তার চূড়ান্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে বা তাদের কার্যকলাপ দক্ষতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। 

(৫) সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত একত্ববাদী ধারণা হল আইনের এক অলীক কল্পনা। একত্ববাদী তত্ত্ব মানবসমাজের স্বাভাবিক বিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতা স্বরূপ।

একত্ববাদের বক্তব্যকে তিনটি স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ থেকে বহুত্ববাদীরা সমালোচনা করেছেন : 

  • (ক) সমাজের সংঘসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে,

  • (খ) আইনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং 

  • (গ) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে।

(ক) সমাজের সংঘসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে বহুত্ববাদীরা একত্ববাদের সমালোচনা করেন

বহুত্ববাদীদের মতানুসারে সমাজ হল বিভিন্ন সংঘ-সংগঠনের এক যৌথ প্রকাশ। আধুনিক সমাজের কাঠামো যুক্তরাষ্ট্রীয়। ল্যাস্কি (H. Laski) তাঁর A Grammar of Politics শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “…it is integral to the proper understanding of any given society that it should be regarded as essentially federal in its nature.” সমাজে বহু ও বিভিন্ন ধরনের সংঘ-সংগঠন থাকে। এগুলি মানবজীবনের বহুবিধ চাহিদা পূরণ করে থাকে। প্রতিটি সামাজিক সংঘের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বা ভূমিকা থাকে। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। রাষ্ট্র হল একটি রাজনীতিক সংঘ এবং এর উদ্দেশ্য । কাজ হল রাজনীতিক বা আইনগত। তাই সার্বভৌম ক্ষমতা রাষ্ট্র ও সমাজের অন্যান্য সংঘের মধ্যে বণ্টিত হওয়া দরকার। সমাজে রাষ্ট্র একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিরাট প্রতিষ্ঠান, কিন্তু একমাত্র প্রতিষ্ঠান নয়। সমাজে আরও অসংখ্য সংঘ সংগঠন আছে। সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গ রাষ্ট্রের মত এই সমস্ত সংস্থার সভ্য। রাষ্ট্রের মত এই সংস্থাগুলিও সমাজবাসীদের আনুগত্য দাবি করতে পারে। কোকার (Coker) বলেছেন: “The State is contracted not merely by unassociated individuals but also by other associations evolving independently, electing individual loyalties better adopted than the State for serving various social needs.”

(১) একা রাষ্ট্র সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে: মানুষের সামাজিক, আর্থনীতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণের তাগিতেই সমাজের বিভিন্ন সংঘ ও সংগঠনের সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রের ন্যায় এদের উপযোগিতাও অনস্বীকার্য। এই সংঘসমূহের প্রত্যেকটির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও স্বাধীন সত্তা আছে। সংঘগুলির নিজস্ব অধিকার ও কর্তব্য আছে। এই কারণে রাষ্ট্র এককভাবে অসীম সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে। না এবং সামাজিক সংঘসমূহের কার্যকলাপকে অহেতুক নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ল্যাস্কি বলেছেন: “The group is real in the same sense that the State is real.”

(২) রাষ্ট্র ও সংঘের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক: ব্যক্তি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংঘগুলির এক্তিয়ার ছড়িয়ে আছে। বর্তমানে এদের সংখ্যাও বহু। এই সমস্ত সংগঠনসমূহের সঙ্গে ব্যক্তির প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপিত হচ্ছে। এবং সংঘ-সংগঠনগুলির সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বার্কার (E. Barker)- এর অভিমত অনুসারে ‘আমরা বর্তমানে ব্যক্তি বনাম রাষ্ট্রের কথা না লিখে রাষ্ট্র বনাম সংঘের কথাই লিখে থাকি। তিনি বলেছেন: “We no longer write Man Vs. the State, we write Group Vs. the State.”

(৩) সমাজ সংঘমূলক: বহুত্ববাদীরা একত্ববাদীদের মত রাষ্ট্র ও সমাজকে অভিন্ন এবং সমাজকে ‘অ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিসমূহের সংগঠন’ বলে মনে করেন না। বহুত্ববাদীদের মতে সমাজ হল সংঘমূলক। জনগণের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণসাধন একা রাষ্ট্রের পক্ষে অসম্ভব। তাই সমাজে রাষ্ট্র ছাড়াও বহু জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান আছে। ব্যক্তিজীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সাধনের ক্ষেত্রে এদের বিশেষ অবদানও অনস্বীকার্য। সেইজন্য কেবল রাষ্ট্রের প্রতি নয়, এই সমস্ত কল্যাণধর্মী সংগঠনসমূহের প্রতিও ব্যক্তি আনুগত্য প্রদর্শন করে। সংঘগুলির মাধ্যমেই ব্যক্তিসত্তার বিভিন্ন দিক বিকশিত হয় বলেই রাষ্ট্রের মত এগুলিও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী।

(৪) রাষ্ট্রের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ: ‘ক্ষমতা কার্যের আনুপাতিক হবে’—একথা স্বীকার করলে রাষ্ট্রের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। কারণ রাষ্ট্রের কার্যকলাপ সীমাবদ্ধ। সসীম রাষ্ট্র অসীম ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে না। প্রতিটি সংগঠনের ক্ষমতা তার কাজের দ্বারা সীমাবদ্ধ। রাষ্ট্রও হল একটি সামাজিক সংগঠন। সুতরাং রাষ্ট্রের ক্ষমতার পরিধিও তার কাজকর্মের এক্তিয়ারের দ্বারা সীমাবদ্ধ। সামাজিক সংগঠনগুলির ক্ষমতাও তাদের কার্যাবলীর সীমারেখা দ্বারা সীমাবদ্ধ। তবে এদের স্ব-স্ব কর্মক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকা উচিত। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব সেক্ষেত্রে অসঙ্গত ও অবাঞ্ছিত। ম্যাকাইভারের মতে, কুঠার যেমন পেনসিল কাটার পক্ষে অনুপযোগী, রাষ্ট্রও তেমনি ব্যক্তির অন্তর্জীবনের সূক্ষ্ম অনুভূতিসমূহের উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনুপযোগী।

(৫) সংঘগুলি সার্বভৌম: গিয়ার্কে ও মেইটল্যাণ্ডের মতানুসারে সমাজের স্থায়ী সংগঠনগুলি স্বাভাবিকভাবেই গড়ে উঠে। রাষ্ট্র এগুলিকে সৃষ্টি করেনি। তাই রাষ্ট্র যুক্তিসঙ্গতভাবে এদের উপর পুরোপুরি কর্তৃত্ব করতে পারে না। এই সংঘগুলিও রাষ্ট্রের মত সার্বভৌম। 

(৬) মানুষ রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে: সংঘমূলক সমাজতন্ত্রবাদের প্রবক্তা হিসাবে পরিচিত কোল, হসন প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতানুসারে রাষ্ট্র হল মানুষের তৈরি একটি প্রতিষ্ঠান। সুতরাং স্বাভাবিক কারণে মানুষ রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। রাষ্ট্রের আইনসঙ্গত সার্বভৌমিকতাকে অধ্যাপক ল্যাস্কি একটি শূন্যগর্ভ ধারণা হিসাবে গণ্য করেছেন।

(৭) ডুর্কহেইমের অভিমত: এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সমাজতত্ত্ববিদ এমিল ডুর্কহেইম (E. Durkheim)-এর অভিমতও উল্লেখ করা দরকার। তাঁর মতানুসারে বর্তমানে মানুষের আর্থনীতিক জীবন জটিল আকার ধারণ করেছে। এই অবস্থায় রাষ্ট্র আর্থনীতিক জীবনের সকল ক্ষেত্রে যাবতীয় দায়িত্ব সাফল্যের সঙ্গে সম্পাদন করতে পারে না। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন পেশাদারী গোষ্ঠী আছে। এই সমস্ত গোষ্ঠীর হাতে আর্থনীতিক জীবনের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ন্যস্ত করা উচিত। তাছাড়া এদের রাজনীতিক প্রতিনিধিত্বের অধিকার প্রদান করা আবশ্যক।

(৮) বিবেকের অনুশাসন: একত্ববাদিগণ বিবেকের গুরুত্বকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্রের প্রতি চরম আনুগত্য প্রদর্শনের কথা বলেছেন। কিন্তু ল্যাস্কির মতানুসারে বিবেকের অনুশাসনের অনুগামী হওয়াই আমাদের প্রাথমিক কর্তব্য।

(খ) আইনের পরিপ্রেক্ষিতেও বহুত্ববাদিগণ একত্ববাদের সমালোচনা করেছেন

(১) আইন হল সামাজিক নিয়মকানুন: বহুত্ববাদীদের মতে, আইন ‘সার্বভৌমের আদেশ নয় এবং রাষ্ট্র আইনের স্রষ্টা নয়’। আইনের উৎস রাষ্ট্র নয়। আইনের উৎপত্তি হয়েছে সামাজিক প্রয়োজন থেকে। আইন হল একধরনের সামাজিক নিয়ম-কানুন। সমাজবদ্ধ মানুষের সামাজিক প্রয়োজনের তাগিদে রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে আইনের উৎপত্তি হয়েছে। ফরাসী আইনবিদ্ দ্যুণ্ডই (Duguit) বলেছেন: “There is no sovereignty; there is no commanding For superior will of the state.”

(২) রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আইনের কর্তৃত্বাধীন: অন্যতম সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে রাষ্ট্রও এই সকল নিয়ম কানুনের আওতার মধ্যে থাকে। বহুত্ববাদীদের মতানুসারে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আইনের কর্তৃত্বাধীন। রাষ্ট্র আইনের ঊর্ধ্বে নয়। রাষ্ট্রের ক্ষমতা আইনের দ্বারা সীমিত। ক্র্যাব, দ্যুণ্ডই প্রমুখ আইনবিদ্‌গণ আইনকে রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন এবং রাষ্ট্রের চরমত্বকে অস্বীকার করেছেন। সুতরাং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আইনের কর্তৃত্বাধীন। তাই লিওসে বলেছেন: ‘বাস্তব ঘটনার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার তত্ত্ব অবলুপ্তির পথে। তাঁর নিজের কথায়: ‘If we look at the facts, it is clear enough that the theory of Sovereign State has broken down.” ল্যাস্কির সিদ্ধান্ত হল ‘সার্বভৌমিকতার সমগ্র ধারণাটি বিসর্জন দিলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্থায়ী কল্যাণ সাধিত হবে।’ তিনি বলেছেন: “It would be of lasting benefit to Political Science if the whole concept Sovereignty were surrendered.”

(৩) আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সংঘগুলির হাতেও থাকা দরকার: বহুত্ববাদীদের মতানুসারে, সরকার প্রণীত আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের চরম, চূড়ান্ত ও অপ্রতিহত ক্ষমতা প্রযুক্ত হয়। সরকার গঠিত হয় দোষত্রুটিসম্পন্ন সাধারণ মানুষকে নিয়ে। তাই সরকারের হাতে আইন প্রণয়নের অসীম ক্ষমতা ছেড়ে দিলে বিপদের আশঙ্কা থাকে। এই কারণে বহুত্ববাদীরা আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ও দায়িত্ব কেবলমাত্র রাষ্ট্র তথা সরকারের হাতে ন্যস্ত না করে সামাজিক সংগঠনসমূহের হাতে ন্যস্ত করার পক্ষপাতী।

(৪) উপযোগিতার উপলব্ধিই হল আইনের পিছনে সমর্থন: শাস্তির ভয়ে মানুষ আইন মান্য করে— একত্ববাদীদের এই যুক্তি বহুত্ববাদীরা মানেন না। তাঁদের মতানুসারে আইনের উপযোগিতার উপলব্ধিই আইনের প্রতি মানুষের আনুগত্য প্রদর্শনের ভিত্তি। আইনের পিছনে ন্যায়-নীতির সমর্থন থাকে। তাই আইন কর্তৃত্বের উৎস হিসাবে গণ্য হয়। সমাজের অধিবাসীরা যুক্তিসঙ্গত বলেই আইন মেনে চলে। ক্র্যাবে (Krabbe) মন্তব্য করেছেন: ‘‘Law is valid by virtue of the fact that is incorporates principles of right.”

(গ) আন্তর্জাতিকতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও বহুত্ববাদিগণ একত্ববাদের তীব্র সমালোচনা

(১) আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব সীমাবদ্ধ: বহুত্ববাদীদের মতানুসারে, রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্ব আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয়ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিটি রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক আইন, প্রথা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অধিকার, বিশ্বজনমত প্রভৃতিকে মান্য করে চলতে হয়। আন্তর্জাতিক আইনের দ্বারা রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা অনেকাংশে সীমিত। বর্তমানে আন্তর্জাতিক পরিবেশের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। পরিবর্তিত অবস্থায় আন্তর্জাতিক আইন রাষ্ট্রের জাতীয় আইনের ন্যায় শক্তিশালী ও কার্যকর হয়ে উঠেছে। আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে প্রচলিত প্রথা, রীতিনীতি ও জনমতের নিয়ন্ত্রণকে অস্বীকার করা যায় না।

(২) আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত হওয়া দরকার: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমূহ অসীম ক্ষমতা অবাধে প্রয়োগ করলে বিশ্বশান্তি বিপন্ন হবে এবং অরাজকতার সৃষ্টি হবে। বৈদেশিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলির সর্বাত্মক ক্ষমতার অনিয়ন্ত্রিত প্রয়োগ ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্রগুলির অস্তিত্বকে বিপন্ন করবে, বিশ্বযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠবে এবং মানবসভ্যতা সংকটের সম্মুখীন হবে। রাষ্ট্রের অবাধ সার্বভৌম ক্ষমতা স্বীকৃত হলে সমগ্র বিশ্ব ও বিশ্ববাসীকে আবার একটি বিভীষিকাময় বিপর্যয়ের আশংকায় দিন কাটাতে হবে। তাই আন্তর্জাতিক আইনের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের চরম কর্তৃত্ব অস্বীকৃত। রাষ্ট্রের অবাধ কর্তৃত্ব ও চরমত্বের ধারণা স্বীকার করে নিলে সভ্যতার ধ্বংস এড়ান যাবে না। ল্যাস্কি (Harold Laski) মন্তব্য করেছেন: “The full implications of sovereignty in this context a licence to wreck civilisation.” তাঁর আরও অভিমত হল: “The notion of an independent sovereign state is on the international side, fatal to the well-being of humanity.”

(৩) রাষ্ট্রসমূহ পরস্পরের উপর নির্ভরশীল: বর্তমান বিশ্বের কোন রাষ্ট্রই স্বয়ং সম্পূর্ণ নয়; একে অপরের উপর বিভিন্ন ক্ষেত্রে নির্ভরশীল। ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র এখন পরস্পরের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। এই অবস্থায় যে-কোন রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতা ও ইচ্ছা মানবসভ্যতার পক্ষে প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। বর্তমানে তাই একত্ববাদীদের অনিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা এবং জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণার পরিবর্তে আন্তর্জাতিকতার আদর্শে অনুপ্রাণিত রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বলা হয়ে থাকে। বস্তুতপক্ষে বিশ্বশান্তি এবং নিজস্ব স্বার্থ এবং নিরাপত্তার স্বার্থে রাষ্ট্রকে সার্বভৌম কর্তৃত্ব জাহির না করে অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতা ও সম্মানজনক সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হয়।

সমালোচনা (Criticism): সার্বভৌমিকতার সম্পর্কে বহুত্ববাদীদের বক্তব্য বহুলাংশে সত্য; কিন্তু পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত নয়। কোকার, কোহেন এমনকি বহুত্ববাদী ল্যাস্কিও এই মতবাদের সমালোচনা করেছেন।

(১) রাষ্ট্রের অনন্য ভূমিকা অনস্বীকার্য: সামাজিক সংঘ বা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠত্ব অনস্বীকার্য। সামাজিক সংগঠনসমূহ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে স্বাধীন হলেও রাষ্ট্রের একটি বিশেষ দায়িত্ব আছে। বিভিন্ন সংঘের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিবাদের মীমাংসা, এদের কার্যকলাপের মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং সহযোগিতার অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখার গুরুদায়িত্ব রাষ্ট্রের। প্রকৃত প্রস্তাবে রাষ্ট্রকে এমন অনেক কাজ করতে হয়, যা অন্য কোন সংঘ-সংগঠনের পক্ষে সম্পাদন করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে দেশের নিরাপত্তা বিধান, সমাজজীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা সংরক্ষণ, আইনগত দ্বন্দ্ব-বিবাদের সুষ্ঠু মীমাংসা প্রভৃতির কথা বলা যায়। ল্যাস্কির মতানুসারে, আইনগত বিচারে অস্বীকার করা যাবে না যে, রাষ্ট্রের এমন কিছু অঙ্গ আছে যার কর্তৃত্ব অপরিসীম। তিনি বলেছেন: “Legally no one can deny that there exists in every state some organ whose authority is unlimited.”

(২) ঐক্য ও সংহতির বিরোধী: বহুত্ববাদ রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা এবং রাষ্ট্রের প্রতি ব্যক্তির আনুগত্যকে বিভক্ত করে অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির পথকে প্রশস্ত করেছে। এর ফলে সামাজিক ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। একত্ববাদীদের অভিযোগ হল বহুত্ববাদীদের ব্যাখ্যা সমাজব্যবস্থায় মধ্যযুগীয় বিশৃঙ্খলা ও আধা-নৈরাজ্যের জন্ম দিবে। মধ্যযুগে রাষ্ট্র, গীর্জা, সামন্তপ্রভু ও অন্যান্য গোষ্ঠী (clan)-র মধ্যে সার্বভৌমিকতা বিভক্ত ছিল। তার ফলে এই সময়ে ঐক্য ও সংহতি বিপন্ন হয়েছে এবং শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়েছে। বস্তুত রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ছাড়া সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে এবং ঐক্য ও সংহতি নষ্ট হবে। সমাজব্যবস্থার মধ্যে একটি প্রাধান্যকারী সংগঠন থাকা দরকার। তা না হলে সামাজিক সংগঠনের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধের মীমাংসা করা, সুস্থ সমাজজীবনের স্বার্থে নিরাপত্তামূলক বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রভৃতি সম্ভব হবে না। এই সমস্ত কারণের জন্য গেটেল তাঁর Political Science শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন যে বহুত্ববাদ বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতার জন্ম দেবে। এ প্রসঙ্গে লেস্লী লিপসন (L. Lipson) তাঁর The Great Issues of Politics গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন যে, ‘যথার্থ বহুত্ববাদীরা হলেন নৈরাজ্যবাদী।’

(৩) নৈতিক ও আইনগত ধারণা এক নয়: বহুত্ববাদিগণ রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার আইনগত ও নৈতিক ধারণার মধ্যে কোন পার্থক্য করেননি। একত্ববাদীদের মতানুসারে সার্বভৌমিকতার ধারণা হল সম্পূর্ণ আইনগত। নৈতিকতার সঙ্গে এর কোন যোগ নেই। সামাজিক সংঘগুলির স্বাতন্ত্র্য ও সার্বভৌমত্বের দাবি নীতিগতভাবে সমর্থন করা যায়—আইনগতভাবে নয়। সার্বভৌম ক্ষমতার উপর সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির অধিকার হল প্রকৃতপক্ষে নৈতিক অধিকার—আইনগত অধিকার নয়। গেটেল (Gettell) তাঁর Political Science গ্রন্থে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, আইনগত এবং নৈতিক ধারণা সম্পর্কে বহুত্ববাদীরা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছেন। তা ছাড়া বহুত্ববাদ রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য করতে পারেনি।

(৪) ল্যাস্কির অভিমত: বহুত্ববাদী ল্যাস্কিও এই তত্ত্বের সমালোচনা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে শ্রেণী-সম্পর্কের প্রকাশ হিসাবে রাষ্ট্রের প্রকৃতিকে এই মতবাদ যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি। ল্যাস্কি বলেছেন: “It did not sufficiently realise the nature of the State as an expression of class relations.” শ্রেণীবিভক্ত সমাজব্যবস্থায় সংঘসমূহের হাতে রাজনীতিক কর্তৃত্ব কখনই থাকতে পারে না।

(৫) আইন সম্পর্কিত ধারণা ঠিক নয়: বহুত্ববাদীরা আইনের উৎস হিসাবে বিবেকের অনুশাসন, সামাজিক সংহতি প্রভৃতির কথা বলেন। তাঁরা আইনের উপর প্রভাব হিসাবে সামাজিক ন্যায়বিচার, জনমত, ব্যক্তির ভালমন্দ প্রভৃতির কথা বলেন। এই সব কারণে আইন সম্পর্কিত বহুত্ববাদীদের ধারণাটি অস্পষ্টতা দোষে দুষ্ট। প্রকৃত প্রস্তাবে সার্বভৌমের আদেশ হিসাবে আইনের ব্যাখ্যা অনেক সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট। তাই বর্তমানে এই একত্ববাদী ধারণা মোটামুটি মেনে নেওয়া হয়।

(৬) কোকারের মত: কোকার-এর মতানুসারে আইন প্রণয়ন ও আইন প্রয়োগের জন্য রাষ্ট্রের অস্তিত্ব। রাষ্ট্র অন্যান্যদের উপর যে সমস্ত নিয়ম-নিষেধ আরোপ করে তা রাষ্ট্রের উপর আরোপ করা যায় না। সম প্রকৃতি বিশিষ্ট অন্য কোন কর্তৃপক্ষের কাছে রাষ্ট্রকে দায়িত্বশীল করা যায় না। রাষ্ট্র হল আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান। সুতরাং রাষ্ট্র দেশের মধ্যে অন্য সকল সংঘ-সংগঠনের উপরে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। বস্তুত একত্ববাদে সামাজিক নীতি ও যুক্তিগত বিচারে রাষ্ট্রকে অবাধ ক্ষমতার অধিকারী করা হয়নি। আবার রাষ্ট্র ভুল পথে ও অন্যায়ভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যাবে না, এ কথাও বলা হয়নি।

(৭) লিপসনের অভিমত: পরিশেষে লেস্লী লিপসন (L. Lipson)-এর অভিমত উল্লেখ করা দরকার। তাঁর The Great Issues of Politics গ্রন্থে লিপসন বলেছেন যে, বৃহৎ রাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে বহুত্ববাদের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার্য। কিন্তু ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এই মতবাদ অর্থহীন। তাঁর আরও অভিমত হল যে, গণ-চেতনার বৃদ্ধির জন্য বর্তমানে রাষ্ট্রের কাজকর্মের পরিধি প্রসারিত হয়েছে। তা ছাড়া সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি রাষ্ট্রের এক্তিয়ারকে প্রভাবিত করেছে। তার ফলে রাষ্ট্র একত্ববাদের পথে এগোচ্ছে।

মূল্যায়ন (Evaluation): বহু বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও বহুত্ববাদের গুরুত্বকে অস্বীকার করার উপায় নেই। বহুত্ববাদের বহু দুর্বলতা আছে। বর্তমানে এই তত্ত্বের প্রভাবও বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। এতদসত্ত্বেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা থেকে বহুত্ববাদী ধারণা একেবারে অপসারিত হয়নি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহুত্ববাদী দৃষ্টিকোণের গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত হওয়া আবশ্যক।

(১) ‘মানবসমাজ সংঘমূলক এবং মানবজীবনে সংঘের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ’— বহুত্ববাদীদের এই বক্তব্য অনস্বীকার্য। সংঘগুলি ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে অপরিহার্য ভূমিকা গ্রহণ করে। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সংঘের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অনস্বীকার্য। এই বিষয়ে ডাল (Robert Dahl), লিপসেট (S. M. Lipset) প্রমুখ আধুনিক মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। আবার আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার ক্ষেত্রে গোষ্ঠীগত দৃষ্টিভঙ্গি হল একটি অতি পরিচিত আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তা হিসাবে আর্থার বেন্টলি, ডেভিড ট্রুম্যান প্রমুখ আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

(২) বহুত্ববাদ রাষ্ট্রীয় স্বৈরতন্ত্রের পথকে অবরুদ্ধ করেছে এবং ব্যক্তি ও সংঘের স্বাতন্ত্র্যের দাবী তুলেছে। তারফলে গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার বিকাশের পথ প্রশস্ত হয়েছে। রাষ্ট্রের চরম ও একচ্ছত্র ক্ষমতার দাবি হল স্বৈরাচারমূলক এবং ব্যক্তি-স্বাধীনতার বিরোধী। অনুরূপভাবে রাষ্ট্রের আদর্শবাদী তত্ত্বেও রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতার কথা বলা হয়। সুতরাং এই মতবাদটিও রাষ্ট্রীয় স্বৈরাচারের পক্ষে এবং ব্যক্তি-স্বাধীনতার বিরোধী। বহুত্ববাদ হল এইসবের বিরুদ্ধে একটি প্রবল প্রতিবাদ। বহুত্ববাদ রাষ্ট্রীয় স্বৈরাচারের পথে প্রবল প্রতিরোধের সৃষ্টি করেছে এবং ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা করেছে।

(৩) বর্তমানে সামাজিক জটিলতা এবং দায়-দায়িত্বের ব্যাপকতা বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। তার ফলে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের কাজকর্মের পরিধি প্রসারিত হয়েছে। আবার রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্তর্নিহিত ত্রুটি ও জটিলতাকে অস্বীকার করা যায় না। তাই সকল বিষয়ে দ্রুত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা রাষ্ট্রের পক্ষে সব সময় সম্ভব হয় না। এই অবস্থায় সামাজিক সংঘ-সংগঠনগুলির হাতে কিছু কার্যভার বণ্টন করা ছাড়া উপায় থাকে না। সুতরাং সামাজিক সংঘসমূহের মধ্যে সার্বভৌম ক্ষমতাকে বণ্টন করা দরকার। তা হলে সামাজিক কল্যাণ সুনিশ্চিত হবে।

(৪) আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে শান্তি, সম্প্রীতি ও সহযোগিতা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বহুত্ববাদের অবদান অনস্বীকার্য। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ধারণা আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার পক্ষে বিপদস্বরূপ। রাষ্ট্রের হাতে চরম ও অপ্রতিহত ক্ষমতার অস্তিত্ব আগ্রাসী মনোভাবের উৎস হিসাবে কাজ করে। যুদ্ধ ও প্রতিহিংসার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তার ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অশান্তি ও যুদ্ধ দেখা দেয়। বহুত্ববাদী ধারণা এই প্রতিকূল অবস্থার পথে প্রতিরোধের সৃষ্টি করে।

(৫) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় বহুত্ববাদীরা সামাজিক সংঘের গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার ফলে রাজনীতিক জীবনে বাস্তবতার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। সাম্প্রতিককালের রাজনীতিক জীবনে পেশাদারী বিভিন্ন সংঘ-সংগঠনের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। তাই এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৃত্তি বা পেশাগত প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থাকে স্বীকার করা হয়েছে।

(৬) বহুত্ববাদ সমাজের সংঘসমূহের স্বাতন্ত্র্যকে স্বীকৃতি জানিয়ে গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের উপর জোর দিয়েছে।

(৭) সার্বভৌমিকতার আইনগত ধারণাকে বহুত্ববাদ আক্রমণ করেছে এবং সার্বভৌমিকতার প্রচলিত ধারণাকে বাস্তব অবস্থার সঙ্গে এক সঙ্গতিপূর্ণ রূপ দিয়েছে। সামাজিক প্রয়োজন থেকেই আইনের সৃষ্টি হয়েছে’—বহুত্ববাদীদের এই বক্তব্য বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে।

(৮) বহুত্ববাদ রাষ্ট্রের উপযোগিতাকে আদৌ উপেক্ষা করেনি—রাষ্ট্রের চরম, সর্বাত্মক ও অবাধ কর্তৃত্বকে খর্ব করেছে মাত্র। গেটেল (R, G. Gettell) মন্তব্য করেছেন: “The pluralists make a timely protest against the rigid and dogmatic legalism of the Austinian theory of Sovereignty.”

Rate this post