সাধারণ ইচ্ছার অর্থ: রুশোর সার্বভৌম সাধারণ ইচ্ছার তত্ত্বটির পরিপূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায় ১৭৬২ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Contract Social-এ। জনসাধারণের রাজনীতিক আনুগত্যের ভিত্তি হিসাবে ‘সমষ্টিগত ইচ্ছা’ বা ‘সাধারণ ইচ্ছা’ (General Will) তত্ত্বের কথা রুশো বলেছেন। এই তত্ত্বের মধ্যেই আবার ব্যক্তি-স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতার মধ্যে এক দুর্লভ সমন্বয়ের সন্ধান পাওয়া যায়।

রুশোর মতানুসারে প্রাকৃতিক পরিবেশের জনগণ সকলে সমবেতভাবে চুক্তি করে তাদের সকল অধিকার নিঃশর্ত এবং চূড়ান্তভাবে সমর্পণ করলে তাদেরই যৌথ ব্যক্তিত্বের কাছে। জনগণের এই সামগ্রিক বা যৌথ ব্যক্তিত্বকে রুশো ‘সমষ্টিগত ইচ্ছা’ বা ‘সাধারণ ইচ্ছা’ বলে অভিহিত করেছেন। এই ‘সাধারণ ইচ্ছা’ সকলের ইচ্ছার যোগফল মাত্র নয়। এ আবার সংখ্যাগরিষ্ঠের মতও নয়। একে প্রত্যেকের ‘প্রকৃত ইচ্ছা’ (Real Will) বলে ধরতে হবে। প্রত্যেকের প্রকৃত ইচ্ছা সাধারণের মঙ্গল কামনা করে, অর্থাৎ প্রত্যেকের কল্যাণ কামনা করে। তাই এ হল জনগণের কল্যাণকামী ইচ্ছার সমষ্টি। জনকল্যাণকর ব্যক্তি-ইচ্ছাসমূহের মিলনের যৌথরূপের মধ্যেই সাধারণ ইচ্ছা নিহিত থাকে।

সাধারণ ইচ্ছাই হল সার্বভৌম: রুশোর মতানুসারে এই সাধারণ ইচ্ছাই হল সার্বভৌম ক্ষমতার আধার। সাধারণ ইচ্ছাই হল চরম, চূড়ান্ত ও অবাধ ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর মতে আইন হল সাধারণ ইচ্ছার মূর্ত প্রকাশ। এই সার্বভৌম সাধারণ ইচ্ছা চূড়ান্ত ও অভ্রান্ত। ব্যক্তির প্রকৃত ইচ্ছা এবং সাধারণ ইচ্ছার মধ্যে কোন অসঙ্গতি নেই। সাধারণ ইচ্ছার সঙ্গে যদি ব্যক্তির কোন ইচ্ছার বিরোধ বাধে তবে বুঝতে হবে যে ব্যক্তির সেই ইচ্ছা অপ্রকৃত ইচ্ছা (Unreal Will)। সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ প্রাধান্য পেলে, ব্যক্তি তার প্রকৃত ইচ্ছার দ্বারা পরিচালিত হয়। তখন বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সাধারণ ইচ্ছাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সাধারণ ইচ্ছা হল চরম, অসীম, অভ্রান্ত ও মঙ্গলজনক। প্রকৃত ইচ্ছার সমন্বয়ে গঠিত সাধারণ ইচ্ছাই হল সার্বভৌম। অভ্রান্ত ও মঙ্গলজনক সাধারণ ইচ্ছাই বজায় থাকবে এবং ব্যক্তির স্বার্থেই অপ্রকৃত ইচ্ছাকে দমন করতে হবে। এইভাবে রুশো ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছেন। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও ব্যক্তি স্বাধীনতার মধ্যে এই সমন্বয় সাধন রুশোর এক অভিনব কীর্তি।

জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী: সার্বভৌমিকতা অবিভাজ্য ও অহস্তান্তরযোগ্য। তাই রুশোর মতে সরকার যে ক্ষমতা ব্যবহার করে তা অর্পিত ক্ষমতা (delegated power)। প্রকৃত ক্ষমতা সাধারণ ইচ্ছার মধ্যে নিহিত ও সমর্পিত। সার্বভৌমিকতার ন্যায় সাধারণ ইচ্ছাও অবিভাজ্য ও অহস্তাত্তরযোগ্য। কোল (G. D. H. Cole) মন্তব্য করেছেন: “I hold then that sovereignty being nothing less than the exercise of general will can never be alienated…” এই সাধারণ ইচ্ছার কাছে সকল ব্যক্তি যেমন সকল অধিকার সমর্পণ করল তেমনি সকলের ক্ষেত্রে তা সমানভাবে প্রযোজ্য। রুশো বলেছেন: ‘Which must both come from all and apply to all.” সকলেই এই সাধারণ ইচ্ছার সমান অংশীদার। সুতরাং সমষ্টিগতভাবে জনগণই হল সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী।

মস্তকহীন লেডিয়াথান: রুশোর এই সার্বভৌম সাধারণ ইচ্ছা হবসের সার্বভৌমের মতই সর্বাত্মক ও চূড়ান্ত। তবে রুশোর সার্বভৌমিকতার তত্ত্বে হবসের তত্ত্বের মত কোন রাজা বা ব্যক্তিবিশেষের স্থান নেই। হারণশ (Hearnshas)-র মতে হবসের মস্তকহীন লেভিয়াথানই হল রুশোর ‘সাধারণ ইচ্ছা’। এ হল হবসের লেভিয়াথানের মতই অবাধ ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর কথায়: “The General will of Rousseau is Hobbes’s Leviathan with his head chopped off….The headless Leviathan of Rousseau. is as formidable as the complete monster of Hobbes.”

সাধারণ ইচ্ছার সার্বভৌমত্বের বৈশিষ্ট্য:

রুশোর সাধারণ ইচ্ছার সার্বভৌমত্বের কতকগুলি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা যেতে পারে। তত্ত্বগত আলোচনায় সার্বভৌমিকতার যে বৈশিষ্ট্যগুলির কথা বলা হয়, রুশোর সাধারণ ইচ্ছার মধ্যে সেই সমস্ত বৈশিষ্ট্য বর্তমান।

(১) সাধারণ ইচ্ছা হল প্রজ্ঞাশীল ইচ্ছা (rational will)। এর মধ্যে কোন স্ব-বিরোধ নেই। এর একটি

ঐক্যবদ্ধ রূপ আছে। সাধারণ ইচ্ছা সমাজজীবনে বৈচিত্র্যের মধ্যেও ঐক্য স্থাপন করে। 

(২) সাধারণ ইচ্ছা মঙ্গলময় প্রকৃত ইচ্ছার সমষ্টি। সাধারণ ইচ্ছা হল অভ্রান্ত, কল্যাণকর এবং চরম। ব্যক্তি একে অমান্য করতে পারে না। ব্যক্তির ইচ্ছা সাধারণ ইচ্ছার বিরোধী হলে বুঝতে হবে যে, ব্যক্তি অপ্রকৃত ইচ্ছার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এই অবস্থায় বলপ্রয়োগের দ্বারা ব্যক্তিকে সাধারণ ইচ্ছার অনুবর্তী করতে হবে। রুশোর মতানুসারে এ হল বলপূর্বক ব্যক্তিকে স্বাধীন করা (force to be free)।

(৩) রুশো সাধারণ ইচ্ছার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছেন।

(৪) রুশো রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের চরমত্বের কথা বলেছেন। তাঁর মতে সীমাবদ্ধ সার্বভৌমিকতা হল একটি স্ব-বিরোধী ধারণা।

(৫) সার্বভৌম সাধারণ ইচ্ছা স্থায়ী। রাষ্ট্রের কর্ণধারদের খেয়ালখুশী বা জনসাধারণের ভাবাবেগের উপর সাধারণ ইচ্ছা নির্ভরশীল নয়।

(৬) সার্বভৌম সাধারণ ইচ্ছা অবিভাজ্য এবং অ-হস্তান্তরযোগ্য। রুশো (Rousseau) বলেছেন: “Power may be divided, though will can never be.” সার্বভৌম সাধারণ ইচ্ছাই প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী। সরকারের ক্ষমতা প্রকৃত ক্ষমতা নয়—অর্পিত ক্ষমতা।

সমালোচনা (Criticism): রুশোর সার্বভৌম ‘সাধারণ ইচ্ছা’ তত্ত্ব বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে।

(১) অস্পষ্ট ও বিমূর্ত: ‘সাধারণ ইচ্ছা’ সম্পর্কিত রুশোর বক্তব্য সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট নয়। এর প্রকৃতি তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু এর নির্দিষ্ট রূপ সম্পর্কে তাঁর ধারণা ধোঁয়াটে। রুশোর সাধারণ ইচ্ছার ধারণাটি বিমূর্ত ও সংকীর্ণ। বাস্তব জগতের সঙ্গে এই ধারণার কোন যোগ নেই।

(২) সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচারের সুযোগ: রুশো ‘সাধারণ ইচ্ছা’-র নামে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচারকে সমর্থন করেছেন। বস্তুত প্রকৃত ইচ্ছা বা সাধারণ ইচ্ছা হল সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা এবং অপ্রকৃত ইচ্ছা, যাকে সাধারণ ইচ্ছার বিরোধী বলা হয়েছে তা হল সংখ্যা লঘিষ্ঠের ইচ্ছা। সুতরাং সাধারণ ইচ্ছাকে সার্বভৌম ঘোষণা করার অর্থ হল সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচারকে স্বীকার করা।

(৩) সর্বাত্মক রাষ্ট্রের সমর্থন: রুশোর তত্ত্ব গণতান্ত্রিক আদর্শের পরিপন্থী এবং সর্বাত্মক রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষক। দার্শনিক রাসেলের মতে, রুশোর তত্ত্বে গণতন্ত্রের প্রতি মোখিক সমর্থন থাকলেও এই তত্ত্ব সর্বাত্মক রাষ্ট্রকে (totalitarian state) সমর্থন করে। রাসেল বলেছেন: “Rousseau’s doctrine though it pays lip service to democracy lends to the justification of totalitarian state.” গণতন্ত্রের সমর্থক হয়েও রুশো চরমতন্ত্রের কথা বলেছেন। রুশোর সাধারণ ইচ্ছা হবসের মস্তকহীন লেভিয়াথান মাত্র। সাধারণ ইচ্ছার নামে রুশো চরম স্বৈরাচারের পথ প্রশস্ত করেছেন। আশিরবাথম (Ashirvatham) মন্তব্য করেছেন : “The phrase ‘forced to be free’ open the floodgates of absolutism.”

(8) প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র অসম্ভব: রুশো তাঁর সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্বে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে জনগণের কথা বলে বস্তুত প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কথা বলেছেন। কিন্তু বর্তমানকালে বৃহদায়তনবিশিষ্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তা অসম্ভব ও অবাস্তব।

(৫) হারশ-র মত: রুশো তাঁর তত্ত্বে ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও সার্বভৌমিকতার মধ্যে সমন্বয় সাধনের যে চেষ্টা করেছেন হারশ-র মতে তাও সফল হয়নি। হারশ বলেছেন: “Rousseau’s problem of combining state sovereignty with the freedom of the subject remained unsolved.”

(৬) অজুহাতের সুযোগ: রুশোর মতানুসারে সাধারণ ইচ্ছা হল অভ্রান্ত ও কল্যাণকর। কিন্তু সাধারণের স্বার্থ সম্পর্কিত ধারণা পরিষ্কার নয় এবং তা নির্দেশ করাও সহজ নয়। এই সুযোগে স্বৈরাচারী শাসকও সাধারণের স্বার্থের অজুহাত দেখিয়ে নিজের অপকর্মকে সমর্থন করতে পারে।

মূল্যায়ন: উপরিউক্ত বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও রাষ্ট্রনৈতিক মতবাদ হিসাবে রুশোর তত্ত্বের ব্যাপক স্বীকৃতি ও গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না; জনগণই হল রাষ্ট্রনৈতিক কর্তৃত্বের উৎস এবং জনগণের মঙ্গলবিধানই সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের মুখ্য উদ্দেশ্য—রুশোর এই সকল বক্তব্যের সারবত্তা সর্বজনস্বীকৃত। এর দ্বারাই রুশো জনগণের সার্বভৌমিকতার তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। রুশোর এই মতবাদে সমাজের ঐক্যবদ্ধ রূপটির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এই রাজনীতিক সত্যটি মতবাদটির একটি উল্লেখযোগ্য অবদান। মানুষের অধিকার, ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের সমর্থনে রুশোর দৃঢ় বক্তব্য বিপ্লবের অগ্নিগর্ভবাণী হিসাবে সর্বজনবিদিত।

Rate this post