জনসমাজ

জনসমাজ বলতে স্বাতন্ত্র্যকামী গোষ্ঠীকে বোঝায় না। জনসমাজের ধারণা হল মোটামুটি একই ধরনের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত এক মানবসমষ্টির ধারণা। অবশ্য কোন কোন লেখক এই জীবনযাত্রার ব্যাপারটিকে খুবই নির্দিষ্ট অর্থে ভাষা, ঐতিহ্য, প্রথা ইত্যাদির সঙ্গে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেন। যেমন, বাসে (Burgess) বলেন, ‘জনসমাজ হল সেই জনসমষ্টি যারা একই ভূখণ্ডে বসবাস করে, যাদের ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, আচার-আচরণ অভিন্ন এবং যাদের অধিকারবোধে ও অভিযোগে ঐক্যের সন্ধান পাওয়া যায়।’ এটা অবশ্য একটি আদর্শ জনসমাজের কথা। বাস্তবে একই ভূখণ্ডে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে বহু বিচিত্র ভাষা বা জীবনধারা (Culture) থাকা সত্ত্বেও জাতীয়তাবোধের মত গভীরতর ঐক্যভাবও গড়ে উঠতে পারে। জনসমাজ বলতে জাতি গঠনের যে প্রাথমিক কাঠামোগত পর্যায় বোঝায় সেক্ষেত্রে বার্জেসের মত অনুযায়ী সর্ববিষয়ে অভিন্নতার উপস্থিতি একটি আবশ্যিক শর্ত হতে পারে না। তা ছাড়া ভাষা, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে অভিন্নতার উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করলে জনসমাজের আকৃতি খুবই ক্ষুদ্র হয়ে পড়বে। তখন জনসমষ্টিগুলিকে জনসমাজ না বলে ক্ষুদ্র স্বাতন্ত্রকামী গোষ্ঠী (Ethnic Group) হিসাবে গণ্য করতে হবে। স্বভাবতই জাতি ও জাতীয়তাবাদের আলোচনায় ‘জনসমাজ’ বলতে এ রকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীকে বোঝান হয় না। প্রকৃত প্রস্তাবে সংঘবদ্ধভাবে জীবনযাপন করা হল মানুষের সহজাত প্রকৃতি। এই প্রকৃতির তাড়নায় মানুষ অপরের সঙ্গে মিলিতভাবে বসবাস করতে চায়। এ ক্ষেত্রে আশা-আকাঙ্ক্ষা, অভীপ্সা, সামাজিক ঐতিহ্য, ভাষা-ধর্ম প্রভৃতির অভিন্নতা অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি করে। কতকগুলি ক্ষেত্রে অভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অস্তিত্ব একটি মানবগোষ্ঠীকে একত্রিত করে। এইভাবে একটি জনসমষ্টি গড়ে উঠে। সাধারণভাবে বলা যায় যে, নির্দিষ্ট কোন ভূখণ্ডে বসবাসকারী একটি মানবগোষ্ঠী হল জনসমাজ।

জনসমাজের ধারণা:

নানাবিধ ভাষা, সাহিত্য, প্রথা, ধর্ম প্রভৃতি থাকা সত্ত্বেও যদি কোন নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে বসবাসকারী এক বৃহত্তর মানবগোষ্ঠী বহুকাল ধরে প্রায় একই ধরনের রাজনীতিক ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে এবং যদি তাদের মধ্যে দীর্ঘকালব্যাপী পারস্পরিক সাংস্কৃতিক ও আর্থনীতিক ক্রিয়াকলাপের আদান-প্রদান লক্ষ্য করা যায়, তবে সেই বিচিত্র মানবগোষ্ঠীকে একটি ‘জনসমাজ’ বলতে অসুবিধা নেই। এই অর্থেই বহুকাল ধরেই ভারতের মানুষ ‘People of India’ বলেই আখ্যাত। নতুবা বার্জেসের অভিমত গ্রহণ করলে ভারতীয় জনসমাজ বলতে কোন ধারণাই আমাদের আসতে পারে না। জনসমাজ গঠনের ক্ষেত্রে অনেকে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসের থেকে ঐতিহ্যগত ও ভাবগত ঐক্যের উপর গুরুত্ব আরোপের পক্ষপাতী। কেঞ্জী (Mackenzie) মন্তব্য করেছেন: “A people is a group of individuals, not necessarily living together, but having a certain unity of tradition and sentiment.” প্রকৃত প্রস্তাবে জনসমষ্টির মধ্যে এক ঐক্যানুভূতি তাদের অধিকারবোধ ও অভিযোগের ধারণা এবং সমাজচেতনার ক্ষেত্রে অভিন্ন প্রকৃতির কতকগুলি বৈশিষ্ট্য গড়ে তোলে। এইভাবে একটি জনসমষ্টি বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে সংগঠিত জনসমাজের রূপ ধারণ করে।


জাতীয় জনসমাজ

জাতীয় জনসমাজ (Nationality) কথাটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। শাসনতান্ত্রিক ও আন্তর্জাতিক আইনে জাতীয় জনসমাজের দ্বারা রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত ব্যক্তির পরিচিতি বোঝান হয়। আবার উদ্ভবগত ঐক্য অর্থে জাতীয় জনসমাজ কথাটি ব্যবহার করা হয়। এই অর্থে জাতীয় জনসমাজ শব্দটি জাতীয় উপ-জনসমাজ (Sub-Nationality) ধারণাটিকে ব্যক্ত করে। যাইহোক ধারণাগত বিভ্রান্তি নিরসনের জন্য জাতীয় জনসমাজের সঠিক অর্থ নির্ধারণ করা দরকার।

জাতীয় জনসমাজ ও জাতি এক নয়: জনসমাজ কালক্রমে জাতীয় জনসমাজে পরিণত হয়। অর্থাৎ জাতীয় জনসমাজ সামাজিক বন্ধনের বিচারে জনসমাজেরই উচ্চতর পর্যায় বলে চিহ্নিত। জাতি (Nation) বলতে এই সামাজিক-রাজনীতিক ঐক্য সাধন প্রক্রিয়ারই সর্বোচ্চ ও সর্বশেষ পর্যায়কেই বোঝায়। কোন কোন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জাতীয় জনসমাজ ও জাতির মধ্যে পার্থক্য আছে বলে মনে করেন না। এঁদের মতানুসারে যখনই কোন জনসমাজের মধ্যে রাজনীতিক ঐক্যসাধনের আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে এবং সেইমত তারা রাজনীতিকভাবে সংগঠিত হয় তখনই তাকে জাতীয় জনসমাজ বা জাতি বলা হয়। কিন্তু ‘জাতীয় জনসমাজ’ ও ‘জাতি’ এই দুটি ধারণাকে অভিন্ন মনে না করে এদের মধ্যে পর্যায়গত কি তারতম্য আছে তা নির্দেশ করা প্রয়োজন।

জাতীয় জনসমাজের ধারণা:

যে সামাজিক অভিন্নতার কথা ‘জনসমাজ’ ধারণাটি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে গ্রহণ করা যায়নি, জাতীয় জনসমাজের ধারণাটিতে সেই অভিন্নতার বৈশিষ্ট্যই প্রধান। অর্থাৎ জাতীয় জনসমাজ হল একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমার মধ্যে বসবাসকারী এমন এক জনসমাজ যাদের মধ্যে বংশ, ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য বা ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও ইতিহাসগত ও রাজনীতিক স্মৃতিগত এক দৃঢ় ঐক্যের বন্ধন গড়ে উঠেছে। এই রকম ঐক্যবদ্ধ মানবসমাজের আর এক বৈশিষ্ট্য হল তারা নিজেদের অন্যান্য যে-কোন সমাজ বা জাতীয় জনসমাজ থেকে স্বতন্ত্র বলে মনে করে। যে ঐক্যের দৃঢ়তা ও স্বাতন্ত্র্যকামিতা ‘জনসমাজের’ স্তরে তেমন দানা বাঁধে না সেই ঐক্যবোধ ও স্বাতন্ত্র্যবোধ এই জাতীয় জনসমাজের (Nationality) পর্যায়েই বৃহত্তর মানবগোষ্ঠীকে পরিচালিত করে।

জে. এস. মিল (John Stuart Mill)-এর মত: জনসমাজ গঠনের জন্য সমজাতীয় রাজনীতিক চেতনার দরকার হয় না। কিন্তু জাতীয় জনসমাজ গঠনের ক্ষেত্রে সমজাতীয় রাজনীতিক চেতনার প্রয়োজন আছে। রাজনীতিক চেতনাসম্পন্ন জনগোষ্ঠীকে জাতীয় জনসমাজ বলা হয়। জে. এস. মিল জাতীয় জনসমাজের এই রাজনীতিক চেতনার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। মিলের মতানুসারে ‘রাজনীতিক চেতনাসম্পন্ন জনসমাজই হল জাতীয় জনসমাজ।’ তিনি বলেছেন: “A portion of mankind may be said to constitute a nationality if they are united among themselves by common. sympathies…which make them cooperate with each other more willingly than with the other people, desire to be under the same government and desire that it should be government by themselves or a portion of themselves exclusively.”

কোকার (Cokar) ও ডুর্কহেইম (E. Durkheim): কোকার-এর মতানুসারে জাতীয় জনসমাজ গঠিত হয় অতীত ইতিহাসের অভিজ্ঞতা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সমন্বয়ের মাধ্যমে (“Nationality is primarily, a product of historical experience and cultural tradition.”)। সমাজতত্ত্ববিদ এমিল ডুর্কহেইম মন্তব্য করেছেন: “A nationality is a group of which the members wish to live under the laws and form of a state.” প্রকৃত প্রস্তাবে নিজেদের মধ্যে ঐক্যবোধ এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠীর থেকে পার্থক্যবোধ জাতীয় জনসমাজের বৈশিষ্ট্য।

ব্রাইস (Lord Bryce) ও গার্ণার (Garner): লর্ড ব্রাইস যথার্থই বলেছেন: “A nationality is a population held together by certainties, as for example, language and literature, ideas, customs, and traditions in such wise so to feel itself a coherent unity distinct from other population similarly held together by like ties of their own….” গার্লারের মতানুসারে জাতীয় জনসমাজ হল কুলগত বা অন্যান্য ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ একটি জনসমষ্টি বা একটি অংশ (“In the substantive sense, the term is employed to designate a group or portion of population which is united by racial or other bonds.”)।

জিমার্ন ও ম্যাকাইভার (MacIver): জিমার্ন-এর মতানুসারে ‘জাতীয় জনসমাজ হল ধর্মের ন্যায় আত্মিক ধারণা, মনন, চিন্তার এক অবস্থা এবং অনুভূতি, চিন্তা ও জীবনধারণের এক স্বাভাবিক গতি। ম্যাকাইভারের মতে, ‘জাতীয় জনসমাজ হল সম্প্রদায়ের সামাজিক ঐক্যবোধ যা এক বিশেষ ঐতিহাসিক পরিবেশের ভিতর রাষ্ট্রের মাধ্যমে নিজের অভিব্যক্তির জন্য সক্রিয় (“Nationality is the sense of community which under the historical conditions of a particular epoch, has possessed or still seeks expression through the unity of a state.”)

Rate this post