রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্বগত সাবেকী আলোচনায় রাজনীতিক দলের কার্যাবলী গতানুগতিক প্রকৃতির। তদনুসারে রাজনীতিক দলের কার্যাবলী প্রতিনিধি নির্বাচন, রাজনীতিক ক্ষমতা দখল, সরকার পরিচালনা ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য কাজকর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের আলোচনায় রাজনীতিক দলের কাজকর্মের পরিধি এত সংকীর্ণ নয়, বিশেষভাবে প্রসারিত। গতানুগতিক কার্যাবলী ছাড়াও রাজনীতিক দল এখন আরও অনেক কাজকর্ম সম্পাদন করে থাকে। সাম্প্রতিককালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাজনীতিক দলের এই সমস্ত কাজকর্ম সম্পাদনের উপর গুরুত্ব আরোপের পক্ষপাতী। অর্থাৎ নিজের নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং সরকারী ক্ষমতা দখল ও পরিচালনার মধ্যে রাজনীতিক দলের কার্যাবলী সীমাবদ্ধ নয়। Comparative Politics শীর্ষক গ্রন্থে রাজনীতিক দলের কার্যাবলী পর্যালোচনা প্রসঙ্গে অ্যালমও ও পাওয়েল (Almond and Powell) কতকগুলি বিষয়ের কথা বলেছেন। এই বিষয়গুলি হল: রাজনীতিক নিয়োগ, স্বার্থের গ্রন্থিভবন ও সমষ্টিবদ্ধকরণ ও রাজনীতিক সামাজিকীকরণ। আধুনিক রাজনীতিক ব্যবস্থা এবং প্রক্রিয়া পদ্ধতির পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক দলের কার্যাবলীকে নিম্নলিখিতভাবে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।

(১) রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থায়িত্ব সংরক্ষণ:

রাজনীতিক পদ্ধতির ঐক্যবদ্ধকরণ ও সংরক্ষণ রাজনীতিক দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসাবে পরিগণিত। Comparative Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে অ্যালান বল বলেছেন: “One of the most important functions of Political parties is that of uniting, simplifying and stabilising the political process, political parties tend to provide the highest common denomination.” বিরুদ্ধবাদীদের বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও রাজনীতিক দল অনৈক্যের পরিবর্তে ঐক্য ও সংহতির সৃষ্টি করে। রাজনীতিক দলের কার্যপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাজনীতিক ব্যবস্থার সংহতি ও স্থায়িত্ব সংরক্ষিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। রাজনীতিক দল সংকীর্ণ স্বার্থসমূহকে ঐক্যবদ্ধ করে, ভৌগোলিক দূরত্বকে বিলুপ্ত করে, বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিকে প্রতিহত করে এবং এইভাবে জাতীয় ঐক্যসাধনের পথকে প্রশস্ত করে। বল বলেছেন: “Parties bring together sectional interests, overcome geographical distances, and provide experience to sometimes division Government structures.” অনৈক্যের জায়গায় রাজনীতিক দল ঐক্য স্থাপন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রী দল (American Democratic Party) দীর্ঘদিন ধরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের রক্ষণশীল এবং উত্তরাঞ্চলের উদারপন্থীদের মধ্যে ঐক্য সাধনের পথকে প্রশস্ত করেছে। বল আরও বলেছেন: “The French Radical Party gave a Parliamentary coherence to a loose group of locally based notables….” পশ্চিম জার্মানীতে ‘জার্মান ক্রীশ্চান গণতন্ত্রী দল’ (German Christian Democratic Party) অনুরূপভাবে প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিকদের মধ্যে দূরত্বকে সংযুক্ত করেছে। গ্রেট ব্রিটেনের রাজনীতিক দলগুলি ক্যাবিনেট ও মন্ত্রিসভার মধ্যে সেতুবন্ধনের দায়িত্ব সম্পাদন করে। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় রাজনীতিক দলগুলি সরকারী কাঠামোর মধ্যে ঐক্য সাধনের উপর জোর দেয়। বল বলেছেন: “All political parties in federal systems emphasise the uniting of different government structures…. রাজনীতিক দল বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন সরকারী কাঠামোর মধ্যে এবং সমাজের অংশসমূহের বিভিন্ন উদ্দেশ্য ও স্বার্থের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা দূর করে। এবং এইভাবে অরাজকতা ও অনৈক্যের অবসান ঘটায়। রাজনীতিক দলের এই সংযোগসাধনমূলক ভূমিকার সুবাদে রাজনীতিক স্থায়িত্ব বজায় থাকে। বল বলেছেন: “This bridging function of political parties is an important factor in political stability. There are many other variables, but nevertheless political parties in their search for political power do form order of chaos.”

(২) রাজনীতিক ক্ষেত্রে সংযোগসাধন:

আধুনিক কালের রাজনীতিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক দলের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল রাজনীতিক সংযোগসাধন। রাজনীতিক দল সরকার ও জনসাধারণের মধ্যে সংযোগ সৃষ্টি ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা পালন করে। সরকারের দায়িত্ব ও ভূমিকা এবং নাগরিকের অধিকার সম্পর্কে দল জনগণকে অবহিত ও সতর্ক করে। স্ব স্ব মতাদর্শ ও কর্মসূচীর পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক দল নির্বাচকমণ্ডলীকে শিক্ষিত ও সচেতন করে। অ্যালান বল বলেছেন: “Political parties provide a link between government and people. They seek to educate, instruct and activate the electorate. ” রাজনীতিক বিষয়ে নির্লিপ্ত ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সংযোগসাধনের উদ্দেশ্যে দলগুলি গণ-সংযোগের মাধ্যমসমূহ এবং স্থানীয় সংগঠনগুলিকে ব্যবহার করে। শ্রমিক সংঘ ও অন্যান্য পেশাদারী সংগঠনসমূহের মাধ্যমেও রাজনীতিক দল রাজনীতিক প্রচার ও কাজকর্মকে অব্যাহত রাখে। এইভাবে দলগুলি জনসাধারণের রাজনীতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে এবং বিভিন্ন নীতি ও আদর্শ গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। সাধারণত নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজনীতিক দলগুলি অধিকতর সক্রিয় হয়ে থাকে। জনগণের মধ্যে দল সহমতের ভিত্তি গড়ে তোলে। পরস্পর-বিরোধী বিভিন্ন মতাদর্শ, কার্যপ্রক্রিয়া ও কর্মসূচী সম্পর্কে রাজনীতিক দলগুলি যাবতীয় মতামত জনসাধারণের সামনে তুলে ধরে। তার ফলে জনগণের রাজনীতিক সচেতনতা ও মূল্যবোধের স্তর অধিকতর উন্নত হয়। জনগণকে রাজনীতিকভাবে সংগঠিত করা এবং তাদের মধ্যে রাজনীতিক শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে রাজনীতিক দলের ভূমিকা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। যে-কোন রাজনীতিক ব্যবস্থার সাফল্য ও স্থায়িত্বের স্বার্থে রাজনীতিক দলের জনসংযোগ সাধনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদারনীতিক সমাজতান্ত্রিক নির্বিশেষে সকল রাজনীতিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এ কথা সাধারণভাবে সত্য। যে-কোন রাজনীতিক ব্যবস্থার অস্তিত্বকে অব্যাহত রাখার জন্য জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মৌলিক আস্থা অপরিহার্য।

(৩) রাজনীতিক ক্ষেত্রে নিয়োগ:

রাজনীতিক নিয়োগ কথাটি এক্ষেত্রে বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। কাউকে রাজনীতিক ক্ষেত্রে যে-কোন ভূমিকায় নিয়ে আসা বা যুক্ত করাকেই বলা হয়েছে রাজনীতিক নিয়োগ। বিভিন্নভাবে বা কারণে এ ধরনের রাজনীতিক নিয়োগের ঘটনা ঘটে। তবে রাজনীতিক দলই হল এ ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য মাধ্যম। সকল রাজনীতিক ব্যবস্থাতেই রাজনীতিক দলকে এই ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। উদারনীতিক সমাজতান্ত্রিক নির্বিশেষে প্রত্যেক রাজনীতিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক দল রাজনীতিক নিয়োগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসাবে কাজ করে। প্রত্যেক রাজনীতিক ব্যবস্থাতেই মুষ্টিমেয় বাছাই করা কিছু মানুষ বা রাজনীতিক এলিট (Political Elite) রাজনীতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করার অধিকার লাভ করেন। এই সমস্ত রাজনীতিক এলিটদের নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনীতিক দলের ভূমিকাই হল প্রধান। সমাজতান্ত্রিক বা যে কোন সামগ্রিকতাবাদী রাজনীতিক ব্যবস্থায় একমাত্র রাজনীতিক দলই রাজনীতিক নেতাদের নিযুক্ত করে। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও দলই রাজনীতিক ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিয়োগের ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করে। অ্যালান বল বলেছেন: “While increasing the scope of political activity and widening popular participation, political parties perform the important function of recruiting political leaders.”

যেখানে রাজনীতিক দল দুর্বল বা দলের অস্তিত্ব নেই, সেখানে রাজনীতিক নিয়োগ সম্পাদিত হয় বংশানুক্রমিকভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত পরিবার, সামরিক সংগঠন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রভৃতির মাধ্যমে। কেবল এই রকম ক্ষেত্রেই রাজনীতিক এলিটদের নিয়োগের ব্যাপারে রাজনীতিক দলের ভূমিকা থাকে না। আবার আদিম বা সাবেক সমাজব্যবস্থায় অন্যান্য সকল বিষয়ের মত রাজনীতিক বিষয়াদিও সাবেকী রীতিনীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। এ ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক অংশগ্রহণের যাবতীয় সুযোগ সুবিধা ঐতিহ্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং মুষ্টিমেয় মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে ব্যাপক জনসমর্থন ছাড়া রাজনীতিক নিয়োগের ভিত্তি দুর্বল হতে বাধ্য। এবং এই দুর্বলতা রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করে তোলে। বিপরীতক্রমে রাজনীতিক এলিটের নিয়োগের পিছনে ব্যাপক জনসমর্থন থাকলে রাজনীতিক ব্যবস্থা স্থিতিশীল হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়।

নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের ব্যাপারে সকল রাজনীতিক দলের পদ্ধতি প্রক্রিয়া অভিন্ন নয়। এ ক্ষেত্রে দলভেদে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সংশ্লিষ্ট দলের আভ্যন্তরীণ সংগঠনের উপর বিষয়টি নির্ভরশীল। কোন কোন রাজনীতিক দল দলীয় প্রার্থী নির্ধারণের জন্য দলের ভিতরে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবশালী মুষ্টিমেয় নেতারা দলীয় প্রার্থীকে মনোনীত করেন এবং তারপর দলের সদস্যদের দিয়ে আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের ব্যবস্থা করেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে দলের ভিতরে যে সমস্ত গোষ্ঠী বা চক্র থাকে তাদের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করার পর দলীয় প্রার্থী মনোনীত করা হয়।

(৪) রাজনীতিক সামাজিকীকরণ:

আধুনিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক সামাজিকীকরণ রাজনীতিক দলের একটি উল্লেখযোগ্য কাজ হিসাবে বিবেচিত হয়। রাজনীতিক দলের এই ভূমিকাটি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আবশ্যক। রাজনীতিক দল মাত্রেরই নির্দিষ্ট রাজনীতিক মতাদর্শ ও মূল্যবোধ থাকে। প্রতিটি রাজনীতিক দল হল বিশেষ একটি মতাদর্শ ও মূল্যবোধের প্রতীক। বাস্তবে দলের এই রাজনীতিক মতাদর্শ অস্পষ্ট প্রতিপন্ন হতে পারে। আবার দলের মতাদর্শগত তাত্ত্বিক ভিত্তির সঙ্গে বাস্তব কার্যধারার ব্যাপক ব্যবধানও থাকতে পারে। এতদ্‌সত্ত্বেও প্রতিটি রাজনীতিক দলের মতাদর্শগত তাত্ত্বিক ভিত্তিকে অস্বীকার করা যায় না। বল বলেছেন: “All political parties have philosophical bases, no matter how blurred and no matter how divorced from the actual political behaviour of the party these foundations may be.” কোন রাজনীতিক দলের মতাদর্শগত ভিত্তি সুসংহত হলে সংশ্লিষ্ট দলটি মতাদর্শানুসারী রাজনীতিক দল হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। দলের এই মতাদর্শগত ভিত্তি দলের সদস্যদের কাছে দলের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি হিসাবে প্রতিপন্ন হয়।

এই মতাদর্শগত ভিত্তির পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিটি রাজনীতিক দল সুনির্দিষ্ট মতাদর্শগত লক্ষ্যে জনমত সংগঠিত করার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। দলীয় মতাদর্শের ভিত্তিতেই বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রতি সংশ্লিষ্ট দলের দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত। কোন একটি রাজনীতিক দলের মতাদর্শ বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার বিরোধী হতে পারে এবং তা প্রচলিত রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসাবে প্রতিপন্ন হতে পারে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্বে পশ্চিম ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক দলগুলির কথা বলা যায়। সমকালীন উদারপন্থী ও রক্ষণশীল রাজনীতিক এলিটদের প্রবল প্রতিপক্ষ হিসাবে এই সমাজতান্ত্রিক দলগুলি আসরে অবতীর্ণ হয়। আবার এই মতাদর্শ বিদ্যমান রাজনীতিক কাঠামো ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সমর্থনসূচক হতে পারে।

রাজনীতিক দল হল এক ব্যাপক সামাজিক কাঠামোযুক্ত সংগঠন। এই সংগঠন তার রাজনীতিক কাজকর্মের সঙ্গে জনসাধারণের এক উল্লেখযোগ্য অংশকে সংযুক্ত করতে সক্ষম হয়। প্রতিটি রাজনীতিক দলই চায় তার মতাদর্শ ও মূল্যবোধকে জনসাধারণের মধ্যে সঞ্চারিত করতে। দল মাত্রেরই উদ্দেশ্য হল নাগরিকদের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা উদ্বুদ্ধ করা এবং রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে নাগরিকদের মধ্যে দলীয় মতাদর্শ ও কর্মসূচীর অনুকূলে আস্থা ও বিশ্বাসের মনোভাব সৃষ্টি করা। রাজনীতিক বিশ্বাস, মতাদর্শ ও মূল্যবোধ প্রসঙ্গে নাগরিকদের প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে রাজনীতিক দলের এই ভূমিকাই হল রাজনীতিক সামাজিকীকরণ। রাজনীতিক দল মাত্রেই একটি বিশেষ রাজনীতিক মতাদর্শ, মূল্যবোধ বা রাজনীতিক সংস্কৃতির শুধুমাত্র ধারক বা বাহক নয়; রাজনীতিক সংযোগ সাধনের মাধ্যমে দল সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক সংস্কৃতিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সর্বপ্রকারে উদ্যোগী হয়। এই রাজনীতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে রাজনীতিক দলের ভূমিকা দ্বিবিধ। প্রথমত রাজনীতিক দল বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থাকে দৃঢ়ভিত্তিক করতে পারে এবং প্রচলিত রাজনীতিক সংস্কৃতিকে অব্যাহত রাখার পথ সুগম করতে পারে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিক দল বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাজনীতিক মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি নাগরিকদের মধ্যে জাগ্রত করে এবং সহায়ক রাজনীতিক কাজকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। দ্বিতীয়ত, রাজনীতিক দল বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা ও রাজনীতিক সংস্কৃতির কাঠামোর আমুল পরিবর্তনের ব্যাপারে আগ্রহী হতে পারে। এ ক্ষেত্রে দল নাগরিকদের মধ্যে নতুন ও মৌলিক মতাদর্শ, মূল্যবোধ ও বিশ্বাস সঞ্চারিত করতে উদ্যোগী হয়। অ্যালান বল বলেছেন: “Parties present issues, they set value goals for the society.”

(৫) স্বার্থের গ্রন্থিকরণ ও সমষ্টিবদ্ধকরণ:

বর্তমানে রাজনীতিক দলের আর একটি বড় দায়িত্ব হল স্বার্থের গ্রন্থিবদ্ধকরণ এবং স্বার্থের সমষ্টিবদ্ধকরণ। রাজনীতিক দলগুলি বর্তমানে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বার্থের গ্রন্থীকরণ (interest articulation) বা বিভিন্ন স্বার্থের প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে কাজ করে। অ্যালমণ্ড ও পাওয়েল (Almond and Powell)-এর অভিমত অনুসারে বিভিন্ন চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বা স্বার্থগোষ্ঠীসমূহের দাবিদাওয়াগুলিকে কার্যপদ্ধতিতে রূপান্তরিত করাই হল স্বার্থের গ্রন্থিকরণ। এ প্রসঙ্গে ওয়াসবি (S. Wasby) মন্তব্য করেছেন: “Parties articulate interests, in some cases repeating those of interest-groups and in other cases stating new and independent ones.” বিভিন্ন রাজনীতিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক দল বহু ও বিভিন্ন স্বার্থকে প্রকাশিত করে এবং এই সমস্ত স্বার্থের বাস্তব রূপায়ণের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। স্বার্থের সমষ্টিবদ্ধকরণের উদ্যোগ উত্তেজনা প্রশমনের ক্ষেত্রে সহায়তা করে। অ্যালান বল বলেছেন: “The representation of interests is a safety valve; it brings diverse interest into the political process and appears, at least, to be attempting to satisfy their demands.”

স্বার্থের সমষ্টিবদ্ধকরণ-এর ক্ষেত্রে রাজনীতিক দলের ভূমিকাই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতিক দল বিভিন্ন ধরনের স্বার্থের সমন্বয় সাধনের ব্যবস্থা করে। দল স্বার্থের পরিধিকে সম্প্রসারিত করে। এবং এইভাবে দল নিজের সমর্থনের ভিত্তিকে অধিকতর ব্যাপক ও শক্তিশালী করে থাকে। স্বার্থের সমষ্টিবদ্ধকরণের ক্ষেত্রে অন্যান্য সামাজিক গোষ্ঠীর ভূমিকাকেও অস্বীকার করা যায় না। তবে এ ক্ষেত্রে রাজনীতিক দলের ভূমিকাই হল অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ। বল বলেছেন: “This aggregation’ of interests is carried out by other groups in the political system as well as political parties, but in the main the function is performed by the parties.”

(৬) নাগরিকদের সংঘবদ্ধকরণ:

রাজনীতিক ক্ষেত্রে নাগরিকদের সংঘবদ্ধ করার ক্ষেত্রে রাজনীতিক দলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতিক সংঘবদ্ধকরণের ক্ষেত্রে সকল রাজনীতিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক দলগুলি একই অভিন্ন উপায় পদ্ধতি অবলম্বন করে না। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক দলগুলি সভা-সমিতি, বিক্ষোভ-মিছিল, বিভিন্ন গণ-মাধ্যম প্রভৃতির সাহায্যে জনগণকে রাজনীতিকভাবে সংঘবদ্ধ করে থাকে। কিন্তু সামগ্রিকতাবাদী রাজনীতিক ব্যবস্থায় বা ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থায় রাজনীতিক দল সংঘবদ্ধকরণের উদ্দেশ্যে অপেক্ষাকৃত জঙ্গী পদ্ধতি অবলম্বন করে। অভিন্ন ধরনের পোষাক, পতাকা, জনসমাবেশ প্রভৃতি ব্যবস্থাদির মাধ্যমে জনগণ ও রাজনীতিক দলের মধ্যে গভীর সংযোগ সাধনের ব্যবস্থা করা হয়।

(৭) নাগরিকদের রাজনীতিক বিষয়ে অংশগ্রহণ:

রাজনীতিক দল রাজনীতিক কার্যকলাপের সঙ্গে জনগণকে সংযুক্ত করে। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দলের এই ভূমিকাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতিক দল জনসাধারণের সামনে বিভিন্ন রাজনীতিক সমস্যা তুলে ধরে। রাজনীতিক বিষয়াদি বিচার-বিশ্লেষণ করে। রাজনীতিক সমস্যাদি সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করে। এইভাবে রাজনীতিক দল জনসাধারণের রাজনীতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে। তার ফলে রাজনীতিক কাজকর্মে জনসাধারণের অংশগ্রহণের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি হয় ও বৃদ্ধি পায়। সাধারণত নির্বাচনী কার্যকলাপকে কেন্দ্র করে জনসাধারণের রাজনীতিক অংশগ্রহণের সুযোগ-সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। এই ভূমিকা সম্পাদনের মাধ্যমে রাজনীতিক দল গণতান্ত্রিক শাসনের স্বরূপ বজায় রাখে। আধুনিক গণতন্ত্রে রাজনীতিক দলই প্রাণ সঞ্চার করে। ফাইনার (Finer)-এর অভিমত অনুসারে গণতন্ত্র তার আশা-নিরাশা সমেত দলব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। তিনি বলেছেন: “Democracy rests in its hopes and doubts upon the party system. There lies political centre of gravity.” ম্যাকাইভারের মতানুসারে বৃহৎ গণতন্ত্রের পক্ষে দলব্যবস্থা অপরিহার্য।

(৮) ক্ষমতা দখল ও সরকার গঠন:

সরকারী ক্ষমতা দখল করা এবং সরকার গঠন ও পরিচালনা করা প্রতিটি রাজনীতিক দলের প্রধান উদ্দেশ্য ও কাজ। সাবেকী ও আধুনিক নির্বিশেষে সকল রাজনীতিক দলেরই এটি হল সাধারণ ও চিরাচরিত লক্ষ্য। এবং এই উদ্দেশ্যে সকল রাজনীতিক দলই সাধ্যমত উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করে। রাজনীতিক দলমাত্রেই চায় তার মতাদর্শ ও কর্মসূচীকে বাস্তবে রূপায়িত করতে। এবং এই উদ্দেশ্যে প্রতিটি রাজনীতিক দল সরকারী ক্ষমতা দখল করার জন্য উদ্যোগী হয়। দল জনসাধারণের মধ্যে রাজনীতিক চিন্তা-চেতনা ও মতাদর্শ সঞ্চারিত করে ও জনগণকে সংঘবদ্ধ করে। এবং এইভাবে প্রতিটি রাজনীতিক দল নিজের সমর্থনে এক রাজনীতিক ক্ষমতাকেন্দ্র গড়ে তোলার ব্যবস্থা করে। তবে সকল রাজনীতিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক দলের এই ভূমিকা অভিন্ন প্রকৃতির হয় না। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একাধিক রাজনীতিক দল বর্তমান থাকে। দলগুলি নির্বাচনে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে একটি দল ক্ষমতাসীন হয় এবং সরকারী ক্ষমতার দখলকে অব্যাহত রাখতে সতত সচেষ্ট থাকে। অপরদিকে বিরোধী দলগুলি ক্ষমতাসীন দলকে সরকারী ক্ষমতা থেকে সরাতে সচেষ্ট থাকে। বৈপ্লবিক পরিবর্তনে বিশ্বাসী রাজনীতিক দলগুলি কৌশল হিসাবে নির্বাচনী রাজনীতিতে যোগ দেয় এবং বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার বৈধতা সম্পর্কে মানুষের যাবতীয় ভ্রান্ত ধারণাকে দূর করার চেষ্টা করে। এইভাবে বিপ্লবী দলগুলি নিজেদের মতাদর্শের সমর্থনে জনমতকে সংগঠিত করতে সাধ্যমত চেষ্টা করে। আবার যে রাজনীতিক ব্যবস্থায় লক্ষ্য ও সরকারী ক্ষমতা লাভের পদ্ধতি প্রসঙ্গে ব্যাপক ঐকমত্য বর্তমান থাকে, সেখানে যে-কোন শাসকদল রাজনীতিক ব্যবস্থার অনুকূলে যাবতীয় ভূমিকা পালন করে। সাধারণত সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক দলের এই ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়।

রাজনীতিক দলের কার্যাবলী সম্পর্কে মার্কসীয় ধারণা

রাজনীতিক দলের প্রকৃতি ও কার্যাবলী সম্পর্কিত উদারনীতিক ধ্যান-ধারণার সঙ্গে মার্কসীয় ধারণার মিল নেই। মার্কসবাদীরা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টি পর্যালোচনা করেন। মতাদর্শ, রাজনীতিক লক্ষ্য, কর্মসূচী, শ্রেণীগত বিন্যাস প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে মার্কসবাদীরা রাজনীতিক দলের প্রকৃতি ও কার্যাবলী ব্যাখ্যা করেন। মার্কস-এঙ্গেলস্ প্যারী কমিউনের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে বলেছেন যে, বিপ্লবী দলের অস্তিত্ব ছাড়া শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামকে সঠিক পথে পরিচালনা করা মুস্কিল। শ্রমিক শ্রেণীর এই বিপ্লবী দলের সাংগঠনিক চরিত্র হবে অন্যান্য রাজনীতিক দলের থেকে আলাদা। বিপ্লবী দল সম্পর্কিত মার্কস-এঙ্গেলসের এই ধারণাকে লেনিন আরও বিকশিত করেছেন। What is to be done ?, ‘Left Wing Communism …….An Infantile Disorder’, ‘One Step Forward’, ‘Two Steps Back’ প্রভৃতি রচনায় রাজনীতিক দল সম্পর্কে লেনিনের অভিমত ব্যক্ত হয়েছে। এই সমস্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক দলের কার্যাবলী সম্পর্কিত মার্কসীয় ধারণা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যায়।

(ক) লেনিন দলকে শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রগামী বাহিনী হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। বিপ্লবী মতাদর্শ, নিয়ম নীতি ও সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দল শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রগামী বাহিনীতে পরিণত হবে। সঙ্গে সঙ্গে দল সমগ্র শ্রেণীর অচ্ছেদ্য অংশ ও বাহিনীতে পরিণত হবে।

(খ) লেনিনের মতানুসারে দল হল বিভিন্ন দলীয় সংগঠনের এক ঐক্যবদ্ধ ব্যবস্থা। লেনিন দলকে শ্রমিক শ্রেণীর সংগঠিত বাহিনী হিসাবে উল্লেখ করেছেন। সংগঠিত বাহিনী হিসাবে দল শ্রেণী-সংগ্রাম পরিচালনা করবে। দল শ্রমিক শ্রেণীকে প্রতিবিপ্লবী আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে, বুর্জোয়াদের সঙ্গে সংগ্রামে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেবে, শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করবে এবং শৃঙ্খলাবোধে উদ্বুদ্ধ করবে। 

(গ) মার্কসবাদী দল হল শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্বের সর্বশ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। দল শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত করবে। এবং শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে তা সুদৃঢ় করবে।

(ঘ) শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব সৃষ্টি ও সংরক্ষণের জন্য দলের মধ্যে কঠোর শৃঙ্খলা ও সংহতি থাকবে। দলের সিদ্ধান্ত সকল সদস্য আন্তরিকভাবে অনুসরণ করবে।

(ঙ) লেনিনের মতানুসারে পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত ও ধনতন্ত্র বিকশিত হলে বহু পেটি-বুর্জোয়া ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী: সর্বহারা শ্রেণীতে পরিণত হয়। এরা শ্রমিকদের দলে ঢুকে পড়ে এবং বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এদের বিশ্বাস করা চলবে না। দল থেকে এদের তাড়াতে হবে। 

(চ) লেনিনের মতানুসারে দল হল শ্রমিক শ্রেণীর সংগঠনের সর্বশ্রেষ্ঠ রূপ। দল ছাড়াও শ্রমিক শ্রেণীর অনেক দলীয় শাখা সংগঠন থাকে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে সমবায় সমিতি, ট্রেড ইউনিয়ন, যুব সংঘ, সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এই সমস্ত শাখা সংগঠনের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণীর কর্তৃত্ব কায়েম হয়।

Rate this post