মহাকাব্যের লক্ষণ বিচার কর। যে কোন একটি বাংলা মহাকাব্য অবলম্বনে এই লক্ষণগুলি দেখাও।

কবিতার ইতিহাসে মহাকাব্য সুপ্রাচীন কাল থেকেই একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সুউচ্চ স্থান অধিকার করে এসেছে। ‘মহাকাব্য’ এই অভিধায় চিহ্নিত বিভিন্ন যুগের রচনার মধ্যে যেমন অন্তঃপ্রকৃতি ও গঠনবৈশিষ্ট্য দু দিক থেকেই বহু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়, তেমনি মহাকাব্যের স্বরূপধর্ম বিষয়ে বিভিন্ন ধ্যানধারণাও দীর্ঘকাল থেকেই প্রচলিত। সংস্কৃত আলংকারিকদের মতে, কোনও প্রধান দেবতা, সদ্বংশজাত যশস্বী ক্ষত্রিয় নৃপতি, অথবা চন্দ্রসূর্য বংশের মত কোনও উচ্চ রাজবংশ-চরিত অবলম্বনে ছন্দে রচিত রচনা মহাকাব্য পদবাচ্য। মহাকাব্যে পর্বত, সমুদ্র, নগর, প্রান্তর, চন্দ্র, সূর্যের উদয়াস্ত প্রভৃতি স্বভাব বা প্রকৃতির শোভা, রাজা বা সেনাপতিদের মন্ত্রণায় সৈন্যচালনা ও যুদ্ধ, জন্ম ও মৃত্যু, বিরহ ও মিলন, ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ এই চতুর্বর্গ, উৎসব, পার্বণ, ঋতু বর্ণনা প্রভৃতির মধ্যে সমুদয় অথবা কোনও বিষয় মূল আখ্যানবস্তুর সঙ্গে সন্নিবিষ্ট হয়, গ্রন্থসমূহ অন্যূন সংখ্যায় বিভক্ত হয়, সর্গগুলি নাতিদীর্ঘ ও নাতিহ্রস্ব হয়, কবি স্বীয় ইষ্টদেবতার স্তুতি বন্দন বা সাধারণের মঙ্গল কামনা করে কাব্য আরম্ভ করেন; প্রত্যেক সর্গে পরবর্তী সর্গে বর্ণিত বিষয়ের আভাষ প্রদত্ত হয় এবং সর্গগুলি একরূপ ছন্দে অথবা বিবিধ ছন্দে রচিত হয়, কোনও সর্গের বর্ণিত বিষয়ের প্রধানতম বিষয়সূচক নামের শেষে পর্বের নামকরণ হয়ে থাকে। মহাকাব্যে বীর, করুণ, আদি ও শান্ত এই চারটির মধ্যে কোনও একটি রসের প্রাধান্য থাকে, অন্য তিনটি স্থায়ী এবং হাস্য, রৌদ্র ইত্যাদি রস অপ্রধান ও অস্থায়ীভাবে বিদ্যমান থাকে। বর্ণনীয় বিষয় অথবা নায়ক নায়িকার নামে মহাকাব্যের নামকরণ হয়। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’, ‘রঘুবংশ’; ‘ভারবির কিরাতার্জুনীয়ম্’; ‘মাঘের শিশুপালবধ’ কাব্য প্রভৃতি মহাকাব্যরূপে চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু এই আলংকারিক মানদণ্ডে রামায়ণ ও মহাভারতকে মহাকাব্যরূপে গ্রহণ করা যায় না। অথচ এই দুটি রচনাই যথার্থ মহাকাব্যপদবাচ্য।

‘মহাকাব্য’ নামটি সংস্কৃত থেকে গ্রহণ করলেও আমরা ইংরেজিতে এপিক বলতে যা বোঝায় মহাকাব্যকে সেই অর্থেই গ্রহণ করেছি। ‘এপিক’ (Epic) শব্দটি এসেছে গ্রীক epos থেকে, তার অর্থ শব্দ, গান। আদি অলিখিত মহাকাব্যকে ‘ইপস’ বলা হত। মহাকাব্যের মূল উৎস ছিল মৌখিক গাথা। ইউরোপে এপিকের বিভিন্ন ধ্যান-ধারণা গ্রীক যুগ থেকেই প্রচলিত। এ বিষয়ে অ্যারিস্টটলের আলোচনাকে সামনে রেখেই আমাদের অগ্রসর হতে হয়। তাঁর মতে, ‘এপিক ও ট্র্যাজেডি উভয়েই সাধারণ বাস্তবতাকে ও সম্ভাব্যতাকে অতিক্রম করে জীবনের মহিমাদীপ্ত রুপ রচনা করে, মানুষ যা আছে এবং তাদের যা হওয়া উচিত এই উভয় দিকই এপিকে রূপায়িত হয়। এপিক ও ট্র্যাজেডির দু ধরনের রচনায়ই মানুষের নৈতিক বোধঘটিত ক্রিয়াকলাপ ও তৎসম্পর্কিত ঘটনা, তার ভুল-ভ্রান্তি, সুখদুঃখ ইত্যাদি ফুটিয়ে তোলে। এই দু শ্রেণীর কবিকর্মেই যাঁরা তাঁদের মহৎ কার্যাবলী ও যন্ত্রণাভোগের জন্য বিখ্যাত সেই রূপ সম্ভ্রান্ত, অভিজাত ও অসাধারণ মানুষদের উপস্থাপিত করা হয়। ট্রাজেডির মত মহাকাব্যের প্লটও নাট্য-রীতিতে গঠিত হওয়া প্রয়োজন। মূল ঘটনার আদি, মধ্য, অন্ত্য এই সুনির্দিষ্ট ক্রমবিন্যাস থাকে, তাতে নানা শাখা কাহিনীকেও স্থান দেওয়া হয়। অবশ্য ন্যারেটিভ বা কাহিনীর রূপ অবলম্বনের জন্য মহাকাব্যে শাখা কাহিনীরও বহুল ব্যবহারের সুযোগ বেশি এবং সেখানে একই সঙ্গে বিভিন্ন ঘটনাবলীর ক্রমবিকাশ লক্ষ্য করা যায়। এই শাখা কাহিনীগুলিতে অবশ্য ঐক্যসূত্র রক্ষা করা হয়, তারা বিপর্যয় (Catastrophe) বা পরিণামের দিকে অগ্রগতিকে বিলম্বিত করে শ্রোতা বা পাঠকদের স্বস্তি এনে দেয়। ট্র্যাজেডির মত মহাকাব্যও সরল অথবা জটিল, নৈতিক অথবা বিয়োগাত্মক হতে পারে। Illiad সরল ও বিষাদাত্মক, Odyssey জটিল ও নৈতিক। সাধারণত ট্র্যাজেডি ও এপিকে একটি চরিত্রকেই কেন্দ্রীয় চরিত্ররূপে গ্রহণ করা হয়, কিন্তু তার জীবনকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত চিত্রিত করা ঠিক নয়। ঘটনার গতি সহজ, সরল, অথবা জটিলও হতে পারে। মহাকাব্যে অনেক অসম্ভব বিষয় বা ঘটনার অবতারণা করে বিস্ময়ের সৃষ্টি করা হয়। এই রচনায় প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একই ধরনের ছন্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অ্যারিস্টটলের মহাকাব্য সম্পর্কিত আলোচনাকে এভাবে সূত্রবদ্ধ করা যায়—মহাকাব্যের বিষয়বস্তু বা কাহিনীকে মর্যাদামণ্ডিত হতে হবে, তাতে অবশ্যই মহৎ কার্যকলাপ ও বিরাট বিষয়গুলিকে প্রতিফলিত করতে হবে। তাকে একক ও পূর্ণাঙ্গ (It must be single and entire) হতে হবে, সংযোগবিহীন হলে চলবে না। হোমার একটিমাত্র থীম বা বিষয়বস্তুকে নির্বাচন এবং বিভিন্ন শাখাকাহিনীর দ্বারা তার বৈচিত্র্যসাধন করেছিলেন। মহাকাব্যের কবি তাঁর রচনায় আবির্ভূত হয়ে নিজস্ব কণ্ঠে যতদূর সম্ভব কম উক্তি উচ্চারণ করবেন। হোমার উপক্রমণিকাস্বরূপ কয়েকটি পঙক্তি লেখার পরই একটি পুরুষ, একটি নারী অথবা অন্য কোনও চরিত্র উপস্থাপিত করেন। মহাকাব্যের ছন্দকে সম্প্রসারিত (elaborate), ঐশ্বর্যদীপ্ত এবং ভাবরসাত্মক মহাকাব্যোচিত হতে হবে। মহাকাব্য অবশ্যই অতি বৃহৎ হবে না। হোমারের IIliad ও Odyssey-র ভিত্তিতেই অ্যারিস্টটল তাঁর মহাকাব্যের ধারণাকে গঠন করেছিলেন।

মহাকাব্য যে একধরনের জীবনভাষ্য, কতকগুলি সাধারণ নীতি বা আদর্শ প্রকাশের মাধ্যম, অ্যারিস্টটলের মহাকাব্য-সম্পর্কিত আলোচনায় তার কোনও স্বীকৃতি লক্ষ্য করা যায় না। রোমান কবি ভার্জিল যখন A Eneld রচনা করেন তখনই মহাকাব্যের কীর্তি ও তার সম্ভাবনা পূর্ণ স্বীকৃতি পায় : ভার্জিল একটি জাতির ভাগ্যকে অর্থপূর্ণ করে তোলা, তাদের ইতিহাসের ইঙ্গিতগুলির উপর গুরুত্ব আরোপ এবং অতীতের পটভূমিতে সমকালীন ঘটনাগুলির তাৎপর্য নির্দেশ—এইসব লক্ষ্য পূরণের জন্য সচেতনভাবেই তাঁর মহাকাব্যের পরিকল্পনা করেছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে ফ্রান্সে ও ইংল্যান্ডে মহাকাব্যের বিষয়বস্তু সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা দেখা যায়। Boileau, Rapin ও Le Bossu বলেছিলেন, মহাকাব্য মানুষের কল্পনার মহত্তম প্রয়াস, তার জন্য কবির চিন্তা ও প্রেরণা দুইয়েরই প্রয়োজন। এই রচনাকে একটি নৈতিক প্রতিপাদ্যের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। হোমারের Illiad, Oddyssey এবং ভারতবর্ষের রামায়ণ, মহাভারত মহাকাব্যের আদিরূপ। Illiad, Oddyssey-র মত রামায়ণ মহাভারতেও যুদ্ধ একটি প্রধান স্থান গ্রহণ করে আছে। কিন্তু প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মহাকাব্যগুলির পার্থক্য কাহিনী বিবৃত হয়েছে। আর মহাভারতে যেভাবে জীবনের ধ্রুব-শক্তি ও কল্যাণের জন্য বহু রক্তপাত ও দুঃখভোগের পর রাজ্যজয়ের আনন্দ ও সুখসৌভাগ্য পেছনে ফেলে প্রধান কুশীলব বা পঞ্চপাণ্ডবদের মহাপ্রস্থান যাত্রার যে বিচিত্র মহিমময় দৃশ্য অঙ্কিত হয়েছে তা তুলনাহীন। পরবর্তীকালের ইংল্যান্ডের ‘বিউলফ্ট’ (Beowulf) জাতীয় রচনাকেও মহাকাব্য বলা হয়। এই প্রাচীন কাব্যগুলি মূলত শৌর্য-বীর্যের গাথা। যাকে বীরত্বের যুগ (heroic age) বলা হয়, তার বীরত্বপূর্ণ জীবনাদর্শ ও তৎসম্পর্কিত সংগ্রাম এই কাব্যগুলিতে রূপায়িত হয়েছে। সেইজন্য কোনো কোনো সমালোচক এই প্রাচীন কাব্যগুলিকে Heroic Poetry রূপেও অভিহিত করেছেন।

ভার্জিলের A Eneid, দান্তের Divine Comedy, মিল্টনের Paradise Lost প্রভৃতি মহাকাব্যরূপে চিহ্নিত রচনাগুলি Illiad, Odyssey বা রামায়ণ, মহাভারতের মত একটি জাতির জীবন থেকে স্বতোৎসারিত নয়, তারা শিল্পীর সচেতন মানসের সৃষ্টি। কিন্তু এই মহাকাব্যগুলি যে নানাভাবে মহাকাব্যের আদর্শ ও ঐতিহ্যকে অনুসরণ করেছে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। সমালোচকেরা আদি মহাকাব্যগুলি থেকে পরবর্তীকালের শিল্পমানসের সচেতন সৃষ্টি মহাকাব্যগুলিকে পৃথক করার জন্য আদি মহাকাব্যগুলিকে খাঁটি মহাকাব্য (Authentic Epic or Epic of Growth) এবং পরবর্তীকালে রচনাগুলিকে আলঙ্কারিক বা সাহিত্যিক মহাকাব্য (Literary Epic) আখ্যা দিয়েছেন। মহাকাব্যের রীতিতে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপাত্মক এক ধরনের কাব্য লিখিত হয়েছে, তাকে বলা হয় বিদ্রূপাত্মক মহাকাব্য (Mock Epic), যেমন ইংল্যান্ডের কবি পোপের The Rape of the Lock।

মহাকাব্যের কি এমন কোনও সাধারণ স্বরূপবৈশিষ্ট্য আছে যা বিভিন্ন কালের মহাকাব্যোচিত রচনাগুলিতে নিজস্ব রূপগত স্বাতন্ত্র্যের মধ্যেও উদ্ভাসিত হয়? মহাকাব্যের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত এই প্রসঙ্গে টিলিয়ার্ডের সূত্রগুলি বিশেষভাবে স্মরণীয়—প্রথমত, স্বরের গাম্ভীর্য ও প্রকাশভঙ্গির চমৎকারিত্ব; দ্বিতীয়ত, ঐকতানিক (choric) বৈশিষ্ট্যে মহাকাব্যের কবি কখনও তাঁর কাল, কখনও একটি সমগ্র জাতি, কখনও বা একটি সমগ্র যুগ, অন্তত একটি বৃহৎ গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের চিত্ত ও অনুভূতির প্রবক্তার ভূমিকা গ্রহণ করেন; তৃতীয়ত, পরিধিগত বিস্তার ও বহুবিষয় ধারণ ক্ষমতা এবং চতুর্থত, সমস্ত অংশে সাংগঠনিক নিয়ন্ত্রণ। সংক্ষেপে বলা যায়, ভাববস্তু ও প্রকাশকলার সমুন্নতি (Sublimity) ও গাম্ভীর্য, জাতি, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের জীবনাদর্শের মর্যাদাদীপ্ত প্রকাশই মহাকাব্যের স্বরূপলক্ষণ। বিভিন্ন কালের মহাকাব্যগুলির মধ্যে বিষয়বস্তু ও রূপগত পার্থক্য যতই থাকুক, তারা বিভিন্নভাবে বিরাটত্ব ও শৌর্যময় জীবনের ভাবানুভূতি আমাদের মনে সঞ্চারিত করে দেয়। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন—“কালে কালে একটি সমগ্র জাতি যে কাব্যকে একজন কবির কবিত্বশক্তি আশ্রয় করিয়া রচনা করিয়া তুলিয়াছে, তাহাকেই যথার্থ মহাকাব্য বলা যায়।” Illiad, Odyssey কিংবা রামায়ণ, মহাভারতের মত সাহিত্যিক মহাকাব্যগুলি সামগ্রিকভাবে একটি জাতির জীবনের মহাদর্পণ না হতে পারে, কিন্তু তাদের মধ্যে যে একটি বৃহত্তর সমাজ বা গোষ্ঠীর আদর্শ ধ্যানধারণা রূপায়িত হয় তাতে কোনও সন্দেহ নেই। দান্তে তাঁর Divine Comedy তে সমগ্র মধ্যযুগীয় খ্রিস্টধর্মের প্রবস্তারূপেই অবতীর্ণ হয়েছেন, মিল্টন Paradise Lost-এ সপ্তদশ শতাব্দীর ইংরেজ জাতির একটি বৃহৎ অংশের জীবনবোধকে রূপ দিয়েছেন।

বাঙলার ঊনবিংশ শতাব্দীর কবি মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বৃত্রসংহার’ এবং নবীনচন্দ্র সেনের ত্রয়ী কাব্য ‘কুরুক্ষেত্র, রৈবতক ও প্রভাস’কে মহাকাব্য বলা হয়। হেমচন্দ্রের ‘বৃত্রসংহার’-এর বিষয়বস্তু মহাকাব্যোচিত, কিন্তু চরিত্র পরিকল্পনা ও প্রকাশভঙ্গি কোনও দিক থেকেই তিনি কাব্যটিকে মহাকাব্যের মর্যাদায় উন্নীত করতে পারেন নি। নবীনচন্দ্রের ত্রয়ী কাব্যে কবির মাত্রাতিরিক্ত ভাবালুতার প্লাবনে এত শিথিল, তরল ও অসংযত হয়ে পড়েছে যে তাদের মধ্যে কোথাও মহাকাব্যোচিত গাম্ভীর্য ও উদাত্ততা খুঁজে পাওয়া যায় না। একমাত্র মধুসুদন বাঙালী জীবনের নিজস্ব সীমায় মহাকাব্যের উদাত্ত ও পৌরুষদীপ্ত রূপকে অনেকটা পরিমাণেই ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। তার বিষয়বস্তু, রামায়ণের সুপরিচিত কাহিনী, কিন্তু ভাবপ্রেরণা সম্পূর্ণ নতুন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ নতুন মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ বাঙালি সমাজের আলোকপ্রাপ্ত অংশ পরাধীনতার গ্লানি, দৈন্য, অদৃষ্টের বিড়ম্বনা ইত্যাদির মধ্যেই মানবিক মর্যাদাসম্পন্ন মূল্যবোধের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, রাবণের পৌরুষে, দেবতা ও মানুষের সম্মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহে এবং ইন্দ্রজিতের দেশাত্মবোধে প্রাণবন্ত বাণীরূপ লাভ করেছে। সেইজন্যই ভারতীয় সংস্কার বিশ্বাসে চিরনিন্দিত রাক্ষস-রাবণকে নায়কের মর্যাদা দেওয়া সত্ত্বেও মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগ্রত বাঙালী নিজের নবজীবনের আকুতিতে ভাষা পেতে দেখেছিল। ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র প্রতি অংশে এমনকি সেখানে করুণ রসের এবং স্নেহমমতা বাঙালি জীবনের হৃদয়বৃত্তির প্রাবল্যে রচনা গীতিধর্মী, সেখানেও আমরা অমিত্রাক্ষর ছন্দের উদাত্ত গম্ভীর সুর অনুভব করি। রাবণের বেদনা সকল সময়েই পৌরুষদীপ্ত ও মর্যাদামন্ডিত। মহাকাব্যের ভাবপ্রেরণার বৈশিষ্ট্যে এই রচনাটি সমুজ্জ্বল।

ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র মহাকাব্যোচিত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন—“মহাকাব্যের সার্থক রচনা যুগমানসের প্রতিনিধিত্ব ছাড়াও কয়েকটি বিরল গুণের একাধিক (organic) সমাবেশের ওপর নির্ভরশীল। যে বিরাট পটভূমিকার মধ্যে উহার ঘটনাবিন্যাস করতে হয় তাহাকে পূর্বতন ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, আখ্যান-কিংবদন্তী, ধর্মবোধ ও চেতনার সমবায়ে গঠন করা প্রয়োজন। সুতরাং অতীত ইতিহাসের সহিত ব্যাপক ও অন্তরঙ্গ পরিচয়, কল্পনার দিগন্তব্যাপী প্রসার, ভাবসমুন্নতি সৃষ্টির জন্য অতীতের বিচিত্র উপাদান-গঠিত প্রাণসত্তার এক বিশাল আয়তন-ব্যাপ্ত, সহজ সম্প্রসারণ—মহাকাব্য রচয়িতার পক্ষে অত্যাবশ্যকীয় গুণ। প্রকান্ড প্রাসাদ-প্রাঙ্গণের উপর প্রসারিত অসীম নীলাকাশের ন্যায় মহাকাব্য-বর্ণিত আখ্যায়িকার ঊর্ধ্বতন বায়ুস্তরে যেন জাতীয় জীবনের দেহাধিষ্ঠিত আত্মা স্থির-স্তব্ধভাবে আসীন এইরূপ অনুভূতি জাগাইতে হইবে। দ্বিতীয়ত, এই পরিধির বিশালতা ও কল্পনা প্রসারের উপযোগী উদাত্ত প্রকাশ-রীতির উপর সহজ, অস্খলিত অধিকার থাকা চাই। এই মহিমান্বিত, ঊর্ধ্বাচারী প্রকাশের জন্য যেমন চাই সুপ্রযুক্ত শিল্পকৌশল ও শব্দনির্বাচনের বিশিষ্ট আভিজাত্যপ্রধান ভঙ্গী, তেমনি চাই অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত সমুন্নতি। শুধু শিল্পকলা আনিবে নিষ্প্রাণ আলংকারিক স্ফীতি; আর অলংকারবর্জিত শুষ্ক অনুভূতি যতই অকৃত্রিম হউক, আনিবে মহাকাব্যের মর্যাদাহীন সাধারণ কাব্যের ভাষা। তৃতীয়ত, অন্যান্য ক্ষুদ্রায়তন কাব্যের তুলনায় মহাকাব্যে থাকিবে সূক্ষ্ম কারুকার্যের পরিবর্তে বড় তুলির টানে আঁকা একপ্রকার প্রশস্ত, সাধারণীকৃত রং ও রেখার বিন্যাস, যাহার প্রধান লক্ষণ অন্তর্মুখী গভীরতা নহে, বহির্মুখী ব্যাপ্তি। মধুসূদনের কাব্যে এই সমস্ত গুণেরও আশ্চর্য সমাবেশ লক্ষ্য করা যায়। বীররস, করুণরসের সাধারণীকৃত রূপ, ঐশ্বর্য সমারোহ, বর্ণাঢ্য চিত্রসৌন্দর্য, রণসজ্জা ও যুদ্ধবিগ্রহের ধ্বনিগাম্ভীর্য ও কোলাহলমুখরতা— এই সমস্ত কাব্যবর্ণনার মধ্য দিয়া ফুটাইয়া তুলিতে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ব্যক্তিত্বের নিগূঢ়তায় কোন মহাকাব্যকারই প্রবেশ করেন না, মধুসূদনও করেন নাই; তাঁহার নর-নারী শ্রেণী-প্রতিনিধি। রাবণের রাজমহিমার অন্তরালে তাঁহার ব্যক্তি হৃদয়ের স্পন্দন বিশেষ শোনা যায় না; ইন্দ্ৰজিৎ ও প্রমীলার কণ্ঠে যে শৌর্য ও প্রণয়াবেশের মিশ্রিত সুর ধ্বনিত হইয়াছে তাহা রাজপরিবারের তরুণ তরুণীর সাধারণ পরিচয়; চিত্রাঙ্গদা রাজমহিষীর সম্ভ্রম সংযত শোকপ্রকাশে সন্তানহারা মাতৃহৃদয়ের হাহাকারকে সংবৃত করিয়াছে। চিতাশয্যায় শায়িত ইন্দ্রজিৎ-প্রমীলার ভস্মীভূত দেহের সম্মুখে দাঁড়াইয়া রাবণের যে শোকোচ্ছ্বাস তাহা রাজচরিত্রানুযায়ী, রাজ্যের কল্যাণচিন্তায় ব্যক্তিগত শোকের আতিশয্য হইতে নিয়ন্ত্রিত। মধুসুদনের মহাকাব্যের সর্বত্র এই পরিমিতিবোধ ও কাব্যাদর্শের নিখুঁত অনুসরণ।”

Rate this post