নজরুলের ‘দোলন-চাঁপা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত কবিতা ‘অভিশাপ’। ‘দোলন-চাঁপা’ কাব্যগ্রন্থের বিভিন্ন কবিতায় কবির সঙ্গে কবি-প্রণয়িনীর হৃদয়-লীলার যে বিচিত্র বর্ণালিঙ্গন দেখা যায় আলোচ্য কবিতাটিতেও তার স্বাক্ষর উপস্থিত। এই কাব্যের অন্যান্য কবিতার মত এই কবিতার মর্মকেন্দ্রেও রয়েছে কবির প্রেমভাবনা। কিন্তু এই প্রেম মিলনের মহাসঙ্গমে সার্থকতা লাভ করেনি। বিরহ-তাপিত এই প্রেম বৈষুব পদাবলীর ভাষায় যেন বিপ্রলম্ভ-শৃঙ্গার। আলোচ্য ‘অভিশাপ’ কবিতায় উপেক্ষিত প্রেমিকের বিধুর দীর্ঘশ্বাস নিঃসীম বেদনার সঞ্চার করেছে।

পেয়েও হারিয়ে যাওয়া বা অপ্রাপণীয় বিরহ-বিধুর প্রেমের যে আর্তি কবিতাটির মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, তাই কবিতাটির মধ্যে সৃষ্টি করেছে এক রোমান্টিক পরিমণ্ডল। আলোচ্য ‘অভিশাপ’ কবিতাটিতে এই কবিমনের পরিচয় ওয়া যায়। হারফোর্ডের কথায় রোমান্টিকতা একদিকে ‘an extraordinary development of imaginative sensibility’—অর্থাৎ কল্পনাশক্তির অসাধারণ বিকাশ। কিন্তু এর সঙ্গে রয়েছে অপ্রয়োজনীয় বা সুদূরের প্রতি আকাঙ্ক্ষা এবং তার সঙ্গে বেদনাবোধের মধ্যে আনন্দ অনুভবের এক বিশেষ প্রবণতা। আলোচ্য কবিতাটিতেও কল্পনার সৌন্দর্যের সঙ্গে অপ্রয়োজনীয়ের জন্য আকাঙ্ক্ষা এবং তার সঙ্গে কবিমনের অভিশাপ ও বেদনা যুগপৎ প্রকাশিত হয়েছে।

প্রেমিকার উদ্দেশ্যে রচিত আলোচ্য কবিতাটিতে কবি এই পৃথিবী থেকে হারিয়ে কবি-প্রণয়িনী যে বেদনা ও যন্ত্রণা বোধ করবেন তারই ফল কাল্পনিক চিত্র উপস্থাপিত করা হয়েছে। কবি-কৃত এ বেদনাদায়ক কল্পনার মধ্যে মিশে রয়েছে কবির অভিমান এবং আত্মপ্রসাদ অনুভবের এক শিশুসুলভ চাপল্য।

প্রেমিক-কবি যেদিন এই পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবেন, তাঁর জীবনতরী এ-পারের খেয়াঘাটে আর ভিড়বে না, তখন প্রেমিকা অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় তাঁর খবর জানতে চাইবে। সেদিন তার প্রেমিকা পাগল হয়ে তাঁর ছবি বুকে বেঁধে কেঁদে কেঁদে ‘ফিরবে মরু কানন গিরি,/সাগর আকাশ বাতাস চিরি’ সর্বত্র তাঁকে খুঁজবে। নিশীথ রজনীতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে প্রেমিকের স্মৃতির অনুষঙ্গে হঠাৎ চমকিত হবে, মন হবে উন্ননা, বুকের কাছে প্রেমিককে খুঁজতে গিয়ে শূন্য শয্যার স্পর্শে বিরহী হৃদয় কান্নায় ভেঙে পড়বে। আর এইসব ক্ষণ-মুহূর্তেই প্রেমিকা যে বিরহ-যন্ত্রণা অনুভব করবে তাই হবে এতদিন পর্যন্ত প্রেমিকের প্রতি অনাদর প্রকাশের শাস্তি। প্রেমিকের শেখানো গান গাইতে গিয়ে হৃদয়বীণা যখন বিরহ বিষাদের করুণ বেহাগ বা রাগিণীতে ক্রন্দিত হবে তখনই প্রেমিকের স্মৃতি আলোড়িত করবে প্রেমিকার মনকে। ছয় ঋতুর বিরাম-বিহীন আবর্তনে শরৎ আসবে, শিউলি ফুলে প্রেমিকার অঙ্গনতল ভরে থাকবে। আর সেই ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথতে গিয়ে মনে পড়বে শিউলি ফুলে ঢাকা প্রেমিকের সমাধির কথা, বিচ্ছেদের চিরবিরহ-অনল প্রেমিকাকে দগ্ধ করবে। আশ্বিনের শিশির-ভেজা রাত্রিতে প্রেমিকার পাশে সবাই হয়তো থাকবে, থাকবে না মরণ-পথের যাত্রী তার প্রেমিক। কিন্তু রাত্রে দয়িতের বাহুবন্ধনের স্পর্শ প্রেমিকের স্পর্শের কথা মনে করিয়ে দেবে। দয়িতের স্পর্শও অনাকাঙ্ক্ষিত বলে মনে হবে। শীতের হিমঝরা রাতে একদিন যে প্রেমিকের আদর সোহাগেও প্রেমিকা মুখ ফিরিয়ে থাকতো, তার কথা, তার স্মৃতি প্রেমিকার মনে পরে পরেই ফিরে আসবে, আর তারই ফলে শীতের তপ্তশয্যাও হয়ে উঠবে স্মৃতি-কণ্টকিত। প্রেমিকার জীবনের গাঙে আবার হয়তো প্রেমের জোয়ার আসবে, দোদুল্যমান তরীতে থাকবে হয়তো আবার অন্য কেউ। কিন্তু নবাগত প্রেমিকের আসঙ্গলিপ্সার মধ্যেও কথা বলে উঠবে পুরানো প্রেমিকের স্মৃতি। আর সেদিনও প্রেমিকার নবীন সখার এমনি কারাবন্ধ অবস্থা হলে, সেও কেঁদে কেঁদে অন্ধ হবে। প্রেমিকার সুখের মেলা হবে শেষ। শ্রান্ত প্রতীক্ষার দীর্ঘবেলা হবে অনবসিত। মৃত্যুর সঙ্গে সংগ্রামের মুহূর্তে প্রেমিকের কথা বারবার প্রেমিকার মনে আসবে। বসন্তের দোলন-চাঁপায়, চৈত্র রাতের জ্যোৎস্না-মাখানো উতলা হাওয়ায়, আকাশ-ছাওয়া তারার মেলায় ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হবে প্রেমিকের আশাহত প্রাণের অতৃপ্ত ক্রন্দন, আর প্রেমিকের স্মৃতির অনুষঙ্গের প্রেমিকা আকাশের ‘তারার পানে চেয়ে চেয়ে প্রেমিকের দৃষ্টিকে অন্বেষণ করবে। ঝড়-বাদলের রাত্রের ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের ক্ষণে নিরাপত্তার আশ্বাস কামনায় প্রেমিকের সঙ্গ কামনায় প্রেমিকার চিত্ত উন্মুখ হবে। প্রেমিকা নিজের ভুল বুঝতে পেরে প্রেমিকের সঙ্গ ও সোহাগের জন্য বিচলিত হয়ে উঠবে, পুরানো স্মৃতির রোমন্থনে আবার প্রেমিককে প্রেমের আলিঙ্গনে বাঁধবে। এতদিন প্রেমিকের বুকে প্রেমিকা যে আঘাত করে এসেছে, সেই আঘাতই বুমেরাং হয়ে প্রেমিকার বুকে ফিরে আসবে। আর সেই আঘাত-প্রত্যাঘাতের স্মৃতির সরণি ধরেই মারণপথের যাত্রী প্রেমিক প্রেমিকা হৃদয়ে ফিরে আসবে। বিরহ-অনলে দগ্ধ প্রেমিকা তার হৃদয়ের মাঝে আবার তাকে বরণ করে নেবে, বাহুর বন্ধনে গ্রহণ করবে। বিরহতাপিত গঙ্গাজলে ধৌত করবে প্রিয়ের চরণতল। এর মধ্য দিয়েই ঘটবে প্রেমিকের প্রতি প্রেমিক-হৃদয়ের এতদিন ধরে প্রকাশিত অবহেলা ও নিরুত্তাপ ব্যবহারের প্রায়শ্চিত্ত। ‘আমার হৃদয় যেমতি করিছে, তেমতি হউক সে’—দীর্ঘ বিরহদগ্ধ অতৃপ্তমন রাধা-হৃদয় প্রেমিকের এই ঝঞ্ঝানল উৎসবই হচ্ছে প্রেমিক-হৃদয়ের অভিশাপ। এ অভিশাপ কোন ব্যক্তির জীবনে নেমে আসা প্রাকৃতিক বা দৈবদুর্যোগজনিত নেমে আসা বিপর্যয়কর কোন অভিশাপ নয়। প্রেমিকের প্রেম প্রত্যাখ্যাত প্রেমিকার জীবনে প্রেমিকের অনুপস্থিতিহেতু শূন্যতাজনিত যে প্রত্যাশিত অনুশোচনা তাকেই অভিশাপ বলা হয়েছে। তাই কবিতাটির প্রতি স্তবকের শেষে ‘ধ্রুবপদের মতো একটি পদ ঘুরে ঘুরে এসেছে, ‘বুঝবে সেদিন বুঝবে।

এই ধ্রুবপদটিই অতৃপ্ত ঐহিক-হৃদয়ের বিরহজ্বালাকে বারবার তুলে ধরেছে। অপ্রয়োজনীয়, অধরা প্রেমিকার উদ্দেশে কবির ভাষা ও ছন্দ অভিসার যাত্রা করেছে এবং প্রেমিক-হৃদয়ের আর্তি তার কল্পনাকে এক রোমান্টিক মেদুরতায় আবিষ্ট করে কবিতাটির কক্ষপথে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ব্যক্তিগত বিরহ চিরন্তন বিরহে পর্যবসিত হয়েছে।

Rate this post