সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘বোধন’ কবিতার আসল মূল্য দুর্ভিক্ষের বাস্তবানুগ চিত্রণে নয়, প্রতিরোধের সংকল্পে- আলোচনা করো।
‘বোধন’ কবিতাটিতে এক মৃত্যুময় সময়ের বিরুদ্ধে জনচেতনার প্রতিরোধী জাগরণকেই আহ্বান করেছেন কবি— মন্তব্যটি ‘বোধন’ কবিতা অনুসরণে বিশ্লেষণ করো।
‘ছাড়পত্র’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘বোধন’ কবিতাটি ১৩৫০ বঙ্গাব্দের (১৯৪৩) মন্বন্তরের প্রেক্ষাপটে রচিত। বাংলা সাহিত্যে পঞ্চাশের মন্বন্তরের এক গভীর ও ব্যাপ্ত প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কথাসাহিত্য-নাটক কবিতা—সর্বত্রই এই দুর্ভিক্ষ বা মন্বন্তর এক গভীর ছাপ রেখে গেছে। সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর মাত্র একুশ বছরের আয়ুসীমাতেই (১৩৩৩-১৩৫৪) প্রত্যক্ষ করেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তাণ্ডব, ফ্যাসিবাদী শক্তির হিংস্রতা, যুদ্ধকালীন বাংলার আর্থিক সংকট ও মন্বন্তর।
মাত্র ১৭/১৮ বছরের এক কিশোর-দৃষ্টি মন্বন্তরকে যে অনুপুঙ্খ দৃষ্টিতে দেখেছেন, তা বিস্ময়কর। ‘বোধন’ কবিতায় মহামন্বস্তরের যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, তা সম্পূর্ণ ইতিহাসসম্মত। সুকান্ত যে লিখেছেন—
মারী ও মড়ক, মন্বন্তর, ঘন ঘন বন্যার আঘাতে
আঘাতে ছিন্নভিন্ন ভাঙা নৌকার পাল।
এখানে চরম দুঃখ কেটেছে সর্বনাশের খাল।
ভাঙা ঘর, ফাঁকা ভিটেতে জমেছে নির্জনতার কালো…’
তাঁর এই অনুভব প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই এসেছে। ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী ১৯৪২-এর এপ্রিলে জাপানিদের হাতে বর্মার পতনের ফলে বাংলায় চাল আমদানি ব্যাহত হয়। ফলে বাংলায় অন্নাভাব প্রকট হয়ে ওঠে। কিন্তু এছাড়াও পঞ্চাশের মন্বন্তরের পিছনে যে কারণগুলি ছিল, তা হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে তীব্র অর্থনৈতিক মন্দা এবং সৈন্যদের জন্য বিপুল পরিমাণ চাল-গম ও দানাশস্য সংগ্রহ, সরকারি নিয়ন্ত্রণের অভাব ও সে কারণে অসাধু ব্যবসায়ী ও কালোবাজারীদের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি, অতিরিক্ত মুনাফার জন্য চাল মজুত করে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি ইত্যাদি। ঐতিহাসিকদের মতে, খাদ্যশস্যের এই অভাব শহরাঞ্চলের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। কিন্তু দরিদ্র গ্রামীণ মানুষ এবং শহরের নিম্নবিত্তরা এই সংকটে মর্মান্তিকভাবে শিকারে পরিণত করেছিল,—’ভাঙা ঘর, ফাঁকা ভিটেতে’ যে ‘নির্জনতার কালো’ ক্রমেই ঘনীভূত হয়েছিল, তা ইতিহাস সমর্থিত।
গ্রামে গ্রামে কৃষক বা কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের মানুষ একমুঠো অন্নের জন্য পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি ত্যাগ করে যখন চলে যেতে পারে, তখনই বুঝতে হয়, অন্নের দুর্ভিক্ষ তখন কী পরিমাণে তীব্রতা পেয়েছিল। প্রথম অবস্থায় কৃষিজীবী নিরন্নেরা তাদের স্থাবর সম্পদ ও ঘরজমি জোতদার-মহাজনের কাছে বন্ধক রেখে বা বিক্রি করে অন্ন সংগ্রহ করেছিল। দুর্ভিক্ষের সেই সুযোগটুকু পূর্ণমাত্রাতেই কাজে লাগিয়েছিল মহাজন ও অসাধু জোতদার জমিদারেরা। তারপর নিঃস্ব হয়ে উপায়ান্তর না দেখে তারা আশেপাশের গঞ্জ ও শহরের স্টেশনে, ফাঁকা জমিতে, ফুটপাথে গিয়ে ভিড় জমিয়েছিল। কেননা শহরের মানুষের তখনও অধিক মূল্যে হলেও চাল পাচ্ছিল। গ্রামের অম্ল তখন গোপনে শহরের মজুতদারদের হাতে এসে সজ্জিত হয়েছিল। তাই গ্রামের মানুষগুলি একমুঠো ভাত, নিদেনপক্ষে একবাটি ফ্যান ভিক্ষা পাবার আশায় শহরে এসে মৃত্যুর প্রহর গুণছিল। অধ্যাপক মানস মজুমদার লিখেছেন—“ক্ষুধার্ত মানুষজন সবচেয়ে ভিড় করলো মহানগীর কলকাতায়। তার একটা কারণ ১৯৪৩-এর কলকাতার কাছাকাছি জেলাগুলিতেই প্রথম দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ১৯৪৩-এর জুলাইয়ে কলকাতার রাস্তাঘাট দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষে ছেয়ে গেল। গৃহস্থের দরজায় দরজায় একমুঠো ভাত বা একটুখানি ফ্যানের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। ….ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া শহরবাসীর উচ্ছিষ্ট খাদ্যসামগ্রীর অধিকার নিয়ে কুকুর আর মানুষের প্রাণপণ সংগ্রাম চললো। শহর কলকাতায় জীবিত কঙ্কালের মিছিল চলল রাজপথে জমে উঠল মৃতদেহের স্তূপ।….১৯৪৩-এর অক্টোবরে কলকাতায় দুর্ভিক্ষপীড়িত শরণার্থীর সংখ্যা ছিল অন্ততপক্ষে এক লক্ষ্য।”
এই ‘গ্রাম নগরের ভিড়ে’, এই বারবার ‘মৃত্যু হানা’-র উপত্যকার নিস্তব্ধতার সংকেতচিত্র যথার্থভাবেই ফুটে উঠেছে সুকান্তর ‘বোধন’ কবিতায়। যথার্থই তখন গ্রামবাংলার দিকে তাকালে এই রক্তহীন-আলোহীন বিবর্ণতার আঁধারচিত্রই শুধু জেগে উঠত। সুকান্তও বলেছেন—
‘এই যে আকাশ, দিগন্ত, মাঠ, স্বপ্নে সবুজ মাটি
নীরবে মৃত্যু গেড়েছে এখানে ঘাঁটি।”
ফলে গ্রামীণ অর্থনীতির এই সমূহ বিপর্যয়, মানুষের এই সমূহ অবনমন, মানবিকতার এমন শোচনীয় নিধনযজ্ঞ বাংলার কবি-সাহিত্যিকদের অনিবার্যভাবেই আলোড়িত করেছিল। কিশোরবয়স্ক সুকান্তও শহরে বসেই এই সর্বনাশা ও পতনচিত্রকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। অবসন্ন, ন্যুব্জ, প্রাণশক্তিহীন, প্রতিরোধের শক্তিহীন, ভবিষ্যৎহীন এই কঙ্কালমিছিল কবিমনে শুধু করুণারই সঞ্চার করেনি, সেইসঙ্গে আলোড়িত করেছিল তীব্র ঘৃণায়। কেননা এই মৃত্যুতাড়িত সময়ে ‘চুপি চুপি কান্না’ বয়ে বেড়ানোর নৈরাশ্যবাদী মনোভঙ্গি সুকান্ত স্বীকার করতে পারেন নি। কবির মনে হয়েছে, যে ধূর্ত, লোভী, অপরাধীদের চক্রান্তে এই ভয়ঙ্কর মহামন্বন্তর, তাদের ক্ষমা করা ইতিহাসের বিচারে সর্বনাশের নামান্তর—
“ধূর্ত, প্রবঞ্জক যারা কেড়েছে মুখের শেষগ্রাস
তাদের করেছে ক্ষমা, ডেকেছে নিজের সর্বনাশ।”
একইভাবে কৃষকের ক্ষেত্রের শস্য যে মজুতদার-কালোবাজারীরা গোপন ঘরে লুকিয়ে রেখে কৃত্রিম অন্নাভাব সৃষ্টি করে শুধু লোভের মিনার গড়ে তুলতে, তাদের কাছে কৃপাভিক্ষাও আসলে নিশ্চিত মৃত্যুকেই আহ্বান করা। কেননা, অমানবিক সেইসব পশুরা লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণের মূল্যেই লোভের প্রাসাদ-গড়ার ষড়যন্ত্র করেছে। কবি সাধারণ পীড়িত মানুষকে মনে করিয়ে দিয়েছেন ওইসব লোভী মানুষদের সঙ্গে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের শ্রেণিগত বিভাজনটিকে—
“তুমি তো প্রহর গোনো,
তারা মুদ্রা গোনে কোটি কোটি
তাদের ভাণ্ডার পূর্ণ; শূন্য মাঠে কঙ্কাল-করোটি
তোমাকে বিদ্রূপ করে……”
সমকালীন বাংলা সাহিত্যে ১৩৫০-এর দুর্ভিক্ষের চিত্র হয়তো সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘বোধন’ কবিতার থেকেও কোথাও কোথাও আরো তীব্র ও মর্মস্পর্শী ভাষায় লিপিবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু সুকান্তর ‘বোধন’ কবিতার বিশেষত্ব অন্যত্র। ‘বোধন’ কবিতায় কবি দুর্ভিক্ষের চিত্র-রচনায় তেমন আগ্রহী ছিলেন না। তিনি সেই সর্বগ্রাসী সময়ে সংহতিহীন নিশ্চেষ্ট অসহায়তাকে আঘাত করে জাগাতে চেয়েছিলেন। ‘বোধন’ কবিতার উদ্দেশ্য সেই প্রতিরোধের উদ্বোধন। তাই কবি লেখেন—
“লক্ষ লক্ষ প্রাণের দাম
অনেক দিয়েছি : উজাড় গ্রাম।
সুদ ও আসলে আজকে তাই
যুদ্ধশেষের প্রাপ্য চাই।”
কবি সুকান্ত সর্বহারা জনতার মুখে তুলে দিয়েছেন দুর্ভিক্ষের ষড়যন্ত্রীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ভীষণ সংকল্প—
“শোনূরে মালিক, শোন্ রে মজুতদার!
তোদের প্রাসাদে জমা হল কত মৃত মানুষের হাড়
হিসাব কি দিবি তার?
……………..
আদিম হিংস্ৰ মানবিকতার যদি আমি কেউ হই
স্বজনহারানো শ্মশানে তোদের চিতা আমি তুলবই।”
অতএব একথা স্বীকার করতেই হবে, পঞ্চাশের মন্বন্তর কেন্দ্রিক কবিতার ক্ষেত্রে ‘বোধন’ কবিতাটির একটি স্বতন্ত্র মূল্য আছে। সে মূল্য ঠিক দুর্ভিক্ষের ইতিহাস সম্মত চিত্রণের জন্য নয়, এ কবিতার আসল মূল্য মৃত্যুময় সময়ের কাছে নৈরাশ্যময় আত্মসমর্পণের পরিবর্তে প্রতিরোধের সংকল্পে।”