ভাষা সাহিত্যের মূল অঙ্গ হলেও শিল্পের ক্ষেত্রে ভাষার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। শিল্পের মধ্যে ভাষা সৌন্দর্যবোধ বা দীপ্তি সৃষ্টি করে। ‘পটুয়া শিল্প’ প্রবন্ধ মধ্যে শিল্পী যামিনী রায় এই ভাষাকে দুভাবে বিভক্ত করেছেন। তা হল আটপৌরে ভাষা ও সাধু ভাষা। ভাষার দ্বিবিধ রূপ নিয়ে শিল্প সৃষ্টি হতে পারে। শিল্প রূপের কারুকার্য গ্রাম্য সংস্কৃতির বিকাশ সাধনের জন্য আটপৌরে ভাষার প্রভাব বিদ্যমান। এই দুই ধরনের ভাষা প্রসঙ্গে লেখক শিল্পের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন।

পটুয়া শিল্প বাংলাদেশের গ্রামীণ মানুষের সৃষ্টি। প্রাগৈতিহাসিক শিল্পের পাশাপাশি গ্রাম্য সরলতাকে আশ্রয় করে পটুয়া শিল্প ঘরোয়া দেশজ ভাষা বা আটপৌরে ভাষার মধ্যে প্রাণলাভ করেছিল। গ্রামের মানুষ অশিক্ষিত কিন্তু গ্রাম্য সংস্কৃতির ইতিহাসে যে পুরাণ ও ঐতিহাসিক মানুষকে শিক্ষিত করে তুলেছিল পটুয়া শিল্পীরা সেই সূত্রকে বহন করে শিল্প সৃষ্টি করেছিল। ঘরোয়া কথা এবং আটপৌরে ভাষা দিয়ে গ্রাম্য নাগরিক এঁকে চলল ছবি। সভ্যতার বিবর্তনে এই ছবির মধ্যে এল পালিশ এবং ভাষার এল প্রাধান্য। গ্রাম্য জীবনের পোশাক পরে শহরের চাহিদা মেটাতে প্রতিমা গড়ার পরিবর্তে ছবি আঁকতে শুরু করল এবং তা বিক্রি করে উপার্জন শুরু করল। গ্রামের মানুষের সহজ, সরল, সাদাসিদে ভাষার মধ্যে দিয়ে শহরতলী নগরজীবনের পটের ছবিতে যে ভাষা সৌন্দর্য চেতনা সৃষ্টি করেছে তা হল আটপৌরে ভাষা। ঘরের মানুষ যেমন ভাবে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করতে থাকে দেশজ শিল্পেও ঠিক তেমন প্রাধান্য পরিলক্ষিত হতে থাকে। এদের শিল্পে শহর জীবনের ছাপ পড়তে শুরু করল তাই আসল পটুয়া শিল্প আর রহিল না কিন্তু এর ভাষা ছিল আটপৌরে। তাই লেখকের বক্তব্য “এর ভাষা হয়ে গেল গ্রাম্য এর বক্তব্যে এল শহর।” এইভাবে আটপৌরে ভাষার মধ্য দিয়ে শিল্প জগতে অপূর্ব বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হল।

ভাষা শিল্পের ইতিহাসে আর ও একটি দিক ছিল তা হল সাধুভাষার শিল্প বা পোশাকি ভাষার শিল্প। কোনো আনন্দ অনুষ্ঠান বা ধর্মীয় উৎসবে মানুষ নিজেকে সজ্জিত রাখে। বিভিন্ন মানুষের সামাজিকতাকে দিয়ে উৎসব সৃষ্টি হয়, তার পেছনে মানুষের মুক্তির প্রেরণা থাকে। নগর সভ্যতার আধুনিকতায় এসে আটপৌরে ঘরোয়া সাজের পরিবর্তে নরনারী সেদিন সাজতে বাধ্য হয়। এই বিষয়টা একেবারে সহজ সরল নয় একটু মেকী। সাধুভাষার শিল্পও অনুরূপ। প্রতিদিনের ভাষা দিয়ে এই শিল্পকে সাজানো হয় না তা আড়ম্বর ও চাকচিক্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রকাশিত হয়। এমন এক অবস্থা থেকে সাধু ভাষার প্রচলন হয়। ভাষার নিগূঢ় বন্ধন শিল্পকে সাজিয়ে গুছিয়ে প্রকাশ করে তখন শিল্পীদের দৃষ্টি থাকে ‘খণ্ডনকলা’র দিকে। পোশাকি শিল্প মানুষ কেবল সৃষ্টি করে গেল সব জায়গাতে তার প্রভাব প্রত্যক্ষ করা যায় না। কিন্তু পটুয়া ছবিতে ঘরোয়া শিল্প সর্বদা জেগে আছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগে শিল্প লুপ্ত হয়ে গেলেও ঘরোয়া ছবি মরেনি। পোশাকি ভাষার পরিবর্তে মানুষ দীর্ঘদিন পটুয়া শিল্পের দেশজ ভাষাকে ব্যবহার করে চলেছে কারণ পালপার্বণের আনন্দ অনুষ্ঠান ছাড়া এই শিল্প ব্যবহার করা সম্ভব নয়। তাই বলা যায় সাধু ভাষায় শিল্পের আড়ম্বর, চাকচিক্যে মেকি মানুষের ভাবভঙ্গির কৃত্রিমরূপ ধরা পড়ে।

‘পটুয়া শিল্প’ প্রবন্ধ পাঠে লেখক যামিনী রায় ছবির ভাষা এবং কথা বলার ভঙ্গিমাকে একই সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। ভাষা সৃষ্টি করে মানুষ। মানুষের কথা বলার ভঙ্গিমার মধ্য দিয়ে যে ভাষা প্রকাশিত হয় তা মূলত ভাষার লিখিত রূপ হলেও লেখার মধ্যে একটা সৌন্দর্যবোধ সৃষ্টি করতে হয়। ছবি প্রথমে ঘরোয়া শিল্পের গ্রাম ভাষাতে নিজেকে মেলে ধরেছিল। সেই ভাষার মধ্যে জটিলতা ছিল না। একেবারে পরিষ্কার সহজ ভাষায় লিখিত হয়েছিল। কিন্তু ছবির মধ্যে যখন পালিশ করার কাজ প্রবেশ করল তখন গ্রাম্য ভাষার পাশে এল রঙিন আলো। আর সেই রঙিন আলোর স্বপ্ন নিয়ে শহরতলীর গ্রাম্য শিল্পীরা সভ্যতার চাহিদা মেটাতে গ্রাম্যতা ভুলে শহরের আদব কায়দায় নিজেদের মেলে ধরল। নাগরিক সভ্যতার অগ্রগতিতে এগিয়ে গিয়ে শিল্পীর দল যে ভাষায় কথা বলল তা ছবির পট সৃষ্টিতে লিখতে পারলো না কারণ তা একেবারে গ্রাম্যঢঙে উচ্চারিত। শিল্পীমন শহরে এসে উপস্থিত হলেও গ্রাম্যতাকে একেবারে ছাড়তে পারেনি।

শিল্পীর দল ছবি আঁকার সময় কথা বলল এক ভাষাতে আর ছবির জন্য লিখল অন্য ভাষা। সে ভাষা গ্রাম্য ভাষা হলেও তাতে একটু নিখুঁত বৈচিত্র্য এসেছে। ইউরোপীয় শিল্পমহলেও পটুয়া শিল্পের পথ অনুসৃত হলেও ছবির ভাষার অবশ্যই পরিবর্তন এসেছিল। আধুনিকতার আলোকে পৌঁছে শিল্পকে তাই বলা চলে সুসংস্কৃত শিল্প। শিল্প সাধনার অঙ্গ হিসেবে ছবির ভাষা ও কথা বলা ভঙ্গিমা এইভাবে পৃথক হতে শুরু করে। আদিমতাকে অনুসরণ করে যখন নতুন শিল্প সৃষ্টি হয়েছিল তখন শিল্পীর কথা এবং লেখার ভাষা এক ছিল কিন্তু বিবর্তনের ইতিহাসে তার একটু পরিবর্তন হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই ধীরে ধীরে দেশজ শিল্পের ছবি ও ভাষা অবহেলার অন্ধকারে হারিয়ে যেতে থাকল। লেখকের মতে বলা যায় মৌখিক ভাষা ও ছবির ভাষা প্রকৃত এক হলেও উপার্জনের তাগিদে শহরতলীর চাহিদা মেটাতে শিল্পীর দল কৃত্রিমতাকে আশ্রয় করে শিল্পকে এক অভিনবত্ব দান করেছেন। এখানেই শিল্পমহলের অসামান্যতা এবং লেখকের অসাম্যতা।

Rate this post