বিংশ শতকের ভাষাবিজ্ঞান ও আধুনিক সমালোচনা পদ্ধতির যৌথ ফসল শৈলী বিজ্ঞান। সাহিত্যে আমাদের ভাবের প্রকাশ ঘটে থাকে ভাষা তার অনুসারী হয়। কিন্তু দৈনন্দিন কথাবার্তার ভাষাতে শুধুমাত্র communication ঘটে সাহিত্যে লক্ষ্য Expression কবিগণ ভাষায় Foregrounding ঘটান সচেতন, অচেতন ভাবেই, মূল লক্ষ ভাবের বিস্তার ঘটানো। টার্নারের মতে— “Stylistics is that part of Linguistics which concentrates on veriation in the use of language with special attention to the most conscious and complex uses in literature. আসলে সাহিত্য Organized massage. শৈলী নির্ণয় করতে গেলে আগে সেই বার্তাটা জানা জরুরী। তারপর সেই বৈশিষ্ট্যকে খুঁজে বার করা, যার দ্বারা কাব্য সাহিত্যের ভিত্তি প্রস্থর সংস্থাপিত হয়েছে। কাব্যের শৈলী আলোচনা কালে তাই আমরা গঠনতান্ত্রিক বিষয় ও খেয়াল রেখে অগ্রসর হব।

“দশরথের প্রতি কৈকয়ী” পত্রটির উৎসসূত্র রামায়ণ। মূল রামায়ণে উল্লেখ আছে যে রাজা দশরথ একবার কেকয়ী-র কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি কেকয়ীপুত্র ভরতকে অযোধ্যা রাজ্যের যুবরাজপদে অভিষিক্ত করবেন। কিন্তু যথাসময়ে রাজা এই প্রতিজ্ঞার করা বিস্তৃত হয়ে কৌশল্যানন্দন রামচন্দ্রকেই যুবরাজ পথ প্রদানের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। মন্থরা দাসীর মুখে এই সংবাদ জানতে পেরেই কেকয়ী দশরথের উদ্দেশ্য এই পত্রটি লিখেছিলেন।

রামায়ণে কেকয় রাজকন্যার নাম ছিল ‘কৈকেয়ী’, কিন্তু মধুদূধন তার নাম দিয়েছেন কেকয়ী। এ পত্রে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে প্রতিশ্রুতিভঙ্গের জন্য স্বামীর প্রতি স্ত্রীর যে ক্ষোভ তা অনুযোগও অভিযোগের আকারে প্রকাশ পেয়েছে। স্বামীর অনুচিত আচরণে বিবাহিতা রমণীর ক্ষুদ্ধ হৃদয়কেই কবি এখানে প্রাধান্য দিয়েছেন। কৈকয়ী দশরথের তিন রাণীর মধ্যে অন্যতমা এক নারী। কেকয়ী সাধারণ স্ত্রী নন; রাজকূলবধূ, আর দশরথও রঘুবংশের অন্যতম রাজা । পত্রটিকে স্বাভাবিকভাবেই কৈকয়ী ও দশরথের দাম্পত্য পারস্পরিক, সম্পর্কের মধ্যে আভাসিত হয়েছে দশরথের নৃপতিসত্তা, রাজমহিষী রূপে কৈকয়ীর অস্তিত্ব ও রাজ পরিবারের অন্দরমহলের নানা ঘটনা। কেবলমাত্র একজন স্বামী হিসেবেই নয়, রঘুকুলপতি হিসেবে রাজা দশরথের আচরণের সমালোচনায় মুখর হয়েছে কৈকয়ী। এজন্যই বোধ হয় রঘুকুলবধূ রাজা দশরথকে ‘স্বামী’ বলে সম্বোধন না করে ‘রঘুরাজ’ সম্বোধনে এই পত্রিকাটি আরম্ভ করেছেন। সমগ্র পত্রে তার অভিযোগটি অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায়, অসম সাহসিকতার সঙ্গে ব্যক্ত হয়েছে। তার প্রতিবাদী সরব ভূমিকা আমাদের দৃষ্টি এড়ায় না।

‘বীরাঙ্গনা’-র অন্যান্য পত্রের তুলনায় এপত্রটির উপস্থাপন ভঙ্গীটি অনেক বেশি তির্যক। রামচন্দ্রকে যুবরাজ পদে অভিষেকের সময় ভরত-এর কথা বিস্মৃত হওয়া ও প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার ঘটনাটিকে কেকয়ীর কাছে একটি বিরাট অভিঘাত যা তাকে পত্র রচনায় বাধ্য করেছে, তবে পত্রের সূচনা থেকে যতই শেষ দিকে অগ্রসর হই ততই দেখি যে এই ঘটনাটি শেষপর্যন্ত হয়ে উঠেছে গৌণ, বরং তাকে উপলক্ষ করে কৈকয়ী দশরথের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রতি কটাক্ষ হেনেছেন, একে একে প্রকাশ পেয়েছে কেকয়ীর মনের নানা অন্তর্দ্বন্দ্ব। মোট ১৩টি স্তবকে রচিত এ পত্রের সূচনাই হয়েছে প্রশ্নবাক্যে। রাজা দশরথকে বারংবার প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছেন কৈকয়ী। সমগ্র অযোধ্যা রাজ্য জুড়ে যে সাজসাজ রব পড়েছে তা যে রাজা দশরথের জ্যেষ্ঠপুত্র রামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেকেরই বিপুল আয়োজন তা কৈকয়ীর অজ্ঞাত নয়, কিন্তু প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের সংবাদ ন্যায়পরায়ণ রাজা নিজমুখে স্বীকার করুন, পরোক্ষভাবে এটাই চান তিনি। স্বয়ং দশরথের কাছ থেকে উত্তর প্রত্যাশাতেই যেন এই প্রশ্নবাণগুলি তার দিকে ক্রমাগত ধেয়ে এসেছে। কবিতার সূচনায় তাই প্রথম স্তবকের চৌত্রিশটি পঙক্তি-র শেষে রয়েছে বাইশটি প্রশ্নচিহ্ন। আলোচ্য অংশে আবেগের উত্তাপ প্রগাঢ় বলে সংলাপত্ত দীর্ঘ। এই অংশে কৈকয়ী রাজা দশরথের দিকে যেভাবে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন তাতে ‘রঘু-কুল-শ্রেষ্ঠ ও ‘রাজ-ঋষি’-এই শব্দগুলি কৈকয়ীর মুখে খুব বেশি মানানসই নয়। তবে মনে হয় রাজাকে তার কৃতকর্মের জন্য কোনোভাবেই যে রাজর্ষির মর্যাদা দেওয়া যায় না, তা বোঝাতেই প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপের ভঙ্গিতে কবি কেকয়ীর মুখে এ শব্দটি বসিয়েছেন। এ শব্দের ব্যবহারে যেন অভিনব কৌশলে দশরথের অস্তরকে তীব্রভাবে বিদ্ধ করে কেকয়ী তার মনের জ্বালা মেটাতে চেয়েছেন। (রাজ্য জুড়ে যে আনন্দমুখর উৎসব তার প্রতি ও বৃদ্ধ রাজার প্রতি তার কটাক্ষ ও বিদ্রূপপূর্ণ মনোভাব ক্রমশই বেড়ে উঠেছে। ‘জন্মিল কি পুত্র আর?’ এই জিজ্ঞাসার মধ্যে যে কোনো কোমলতা, মাধুর্য্য্য নেই, তা বলাই বাহুল্য। শুধু এ ধরনের তির্যক ভাষণই নয়, নাটকীয় দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত আস্বাদত্ত আমরা পেয়ে যাই এ অংশে, যখন কেকয়ী বলে—

“পাইলা কি পুন এ বয়সে 

রসময়ী নারী ধনে, কহ রাজঋষি?”

স্বামীকে উপহাসের পাত্র করে তুললেও দ্বিতীয় স্তবক পর্যন্ত কৈকয়ীর সম্ভ্রমবোধ কিছুটা হলেও কবি বজায় রেখেছেন। তার প্রমাণ এই সংলাপটি—‘হা ধিক! কি কবে দাসী—গুরুজন তুমি ?/নতুবা কেকয়ী, দেব, মুক্তকণ্ঠে আজি/কহিত অসত্যবাদী রঘু-কুলপতি !/নিলজ্জ ! প্রতিজ্ঞা তিনি ভাঙেন সহজে !/ধৰ্ম্ম শব্দ মুখে, গতি অধর্ম্মের পথে! কিন্তু তৃতীয় স্তবক থেকেই দেখি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী রাজার জন্য বিন্দুমাত্র সম্ভ্রমবোধ দেখাতেও তিনি রাজীনন, তিনি রাজাকে সরাসরি ধিক্কার জানিয়েছেন।

পঞ্চম স্তবক থেকে কৈকয়ীর মনের উত্তাপ ক্রমশ সংযম হারিয়েছে। মর্মপীড়িতা নারীর অন্তরের অভিমান যেন অবশেষে চূড়ান্ত তীব্রতা নিয়ে ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে, দুঃখ, ব্যঙ্গ ও তিরস্কারের মধ্যে দিয়ে পত্রটি বিশেষভাবে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। কোথাও ফুটে উঠেছে প্রবল সপত্নী বিদ্বেষ, আবার কোথাও দেখা গেছে অবগত যৌবনের এক নারীর বঞ্চিত জীবনের সুক্ষ্ম মমস্তাত্ত্বিক বেদনা। কৈকয়ী যেভাবে রাজাকে অভিযুক্ত করেছেন তাতে দশরথকে একজন সত্যভঙ্গকারীরূপেই নয়, তাকে ব্যক্তিত্বহীন এক কামাচারী দুশ্চরিত্র রাজা বলেই প্রতীয়মান হয়। কৈকয়ীর আত্মমর্যাদাবোধ প্রখর। সে কেবল ভোগ্য রমণী নয়, তাঁর রূপযৌবনকে ভোগ করে রাজা যদি তাকে প্রতারিত করতে চান, ছলনা করেন, সে ছলনা, প্রতারণা মেনে নেওয়া তার পক্ষে কোনোমতেই সম্ভব নয়। দশরথের রূপমুগ্ধতা ও কামুক আচরণ-এর প্রতি যেন গ্রিক দেবতা ‘নেমেসিস’-এর প্রতিহিংসা ফুটে উঠেছে কৈকয়ীর বক্তব্যে।

‘বীরাঙ্গনা’ নারীরা পৌরাণিক চরিত্র হলেও মনোধর্মে তারা যে ঊনিশ শতকের আলোকপ্রাপ্তা রমণী, আত্মসম্মানবোধই তার জীবনের প্রধান ধর্ম, সে যে নিছক পুরুষের ভোগ্যা নয়—মধুসূদন-এর মানসিকতাই প্রকাশ পেয়েছে কৈকয়ীর প্রতিটি বক্তব্যের মধ্যে! কবি কেকয়ীকে দিয়েছেন আপন মনের সমস্ত জ্বালা যন্ত্রণাকে অপূর্ব সত্যবোধের সঙ্গে প্রকাশ করবার মতো সাহস ও মানসিক দৃঢ়তা। কৈকয়ীর যে ক্ষোভ সমগ্র পত্র জুড়ে প্রকাশিত, তা কোনো পৌরাণিক অবলা রমণীর ক্ষোভ নয়। এই ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারেন একমাত্র সেই নারী যে নিজের অধিকারী বোধ সম্পর্কে পূর্ণমাত্রায় সচেতন।

আমরা যাকে, ‘Dramatic monologue’ বা নাটকীয় একোক্তি বলে থাকি, তা পত্রটিকে খুবই সুন্দরভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। একোক্তিগুলি দীর্ঘ আকারের, স্বভাবতই তার নিজস্ব ধর্ম অনুযায়ী এগুলি প্রত্যুত্তরের প্রত্যাশা থেকেও মুক্ত। কৈকয়ীর প্রযুক্ত একোক্তি থেকে প্রচুর Dramatic conflict ফুটে উঠেছে। কৈকয়ী ও দশরথের চারিত্রটিও স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে এর মাধ্যমে। তাছাড়া, কেকয়ীর মনের অনেক সূক্ষ্ম টানা পোড়েন গুলি ফুটে উঠেছে এর মধ্যে দিয়ে।

পত্রলেখিকা কৈকয়ী দশরথের প্রথম থেকেই বিচিত্র বিশেষ ও অভিধায় ভূষিত করেছে। এ রীতিটি অবশ্য ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের সমস্ত পত্রের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। একই চরিত্রকে একাধিক বিশেষণে চিহ্নিত করার এই প্রক্রিয়াটিকে ‘সমসূচক প্রয়োগ’ আখ্যা দেওয়া হয়। নায়ক চরিত্রে বিবিধ সত্তার প্রকাশের জন্য, কাব্যে নাটকীয়তার মাত্রা ও বৈচিত্র্য বাড়াবার জন্য সাধারণত এ জাতীয় পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া, পত্রলেখিকার মনস্তাত্ত্বিক প্রতিফলনও, এর মাধ্যমে ঘটে। ‘দশরথের প্রতি কৈকয়ী’ পত্রে ‘রঘুরাজ’, ‘রঘুকুল শ্রেষ্ঠ’ ‘রাজ-ঋষি’ ইত্যাদি শ্রেষ্ঠতাজ্ঞাপক অভিধা দিয়ে কৈকয়ী তার বক্তব্য শুরু করলেও, তার প্রযুক্ত বিশেষণগুলি যে দ্ব্যর্থবোধক তা বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না। পত্রের শুরু এই ইতিবাচক অভিধার সম্ভাবনাগুলিই পত্রের সমাপ্তি অংশের দিকে ক্রমশ নেতিবাচক হীনতাসূচক সম্ভাষণে পরিণত হয়েছে। তাই ‘অসত্যবাদী’, ‘নির্লজ্জ’ প্রভৃতি বিশেষণ কৈকয়ী ব্যবহার করেছেন রাজার উদ্দেশ্যে। আর একেবারে শেষ পর্যায়ে ‘পরম অধর্ম্মাচারী রঘু কুলপতি’ চরণটি ধ্রুবপদের মতো আবর্তিত হয়েছে বারংবার। এর ভেতরে যে কৈকয়ীর সুপ্ত অস্তজ্বালা তীব্রভাবে প্রকাশ পেয়েছে তা নিঃসন্দেহেই বলা যায়।

সংলাপের নাটকীয়তা বাড়াতে ভাগের প্রয়োগ করেছেন কবি। বীরাঙ্গনার অনেক নায়িকাই রহস্যপ্রিয়া, মূল বিষয়টি জেনেও না জানার ভান করেন। যার ফলে প্রকৃত সত্যের উন্মোচনে একটু বিলম্ব হয় আর পাঠকের নাটকীয় উৎকণ্ঠা তাতে বৃদ্ধি পায়। কৈকয়ী পত্রিকাতেও কৈকয়ীকে দেখেছি সমস্ত ঘটনা অবগত হওয়া সত্ত্বেও পত্রের সূচনা অংশে ভানের মধ্যে দিয়ে তিনি যেন পাঠকের সঙ্গে নিজেকেও একই তলে অবস্থান করিয়েছেন যার প্রমাণ এই সংলাপটি—’কি মঙ্গলোৎসব আজি তব পুরে ?’…জন্মিল কি পুত্র আর….’ এরপর ধীরে ধীরে মূল বক্তব্য এসে পৌঁছান তিনি। এখানে অবশ্যই মনে রাখা প্রয়োজন, যে পত্রের সূচনাতেই তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন মন্থরার মুখে রামের রাজ্যাভিষেকের ঘটনা তিনি সমস্তই শুনেছেন।

নারীর ভাষা ব্যবহারে এমন অনেক নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে, যার উপস্থিতি পুরুষের ভাষায় কখনই প্রত্যাশিত নয়৷ বীরাঙ্গনাতে সবক্ষেত্রেই নারীই কথক। সেক্ষেত্রে নারীর একান্ত কিছু ভাষা ব্যবহারের প্রতিফলন ঘটেছে সংলাপে যাদের আমরা মেয়েলি ছাঁদের ভাষা বলতে পারি। ‘দশরথের প্রতি কেকয়ী’ পত্রিকারও কৈকয়ীর অভিযোগ উক্তি, সম্ভাষন রীতি বা বিশিষ্ট পদগুচ্ছের ব্যবহারে মেয়েলি ভাষার নিজস্ব টোনের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে। যেমন—

‘হা ধিক! কি কবে দাসী-গুরুজন তুমি।’

মধুসূদন বিশ্বাস করতেন একমাত্র অমিত্রাক্ষর ছন্দেই শ্রেষ্ঠ কবিতা লেখা সম্ভব। রাজনারায়ণকে তিনি লিখেছিলেন, ‘I acknowledge Blank Verse to be the noblest measure in the language.’ এই নতুন ছন্দ বিষয়ে কবির অদ্ভুত আত্মপ্রত্যয় ছিল। চৌদ্দ মাত্রার চরণ আশ্রয় করলেও এর প্রবহমানতা কখনও ব্যাহত হয় না। অলংকার শাস্ত্রে যাকে প্রসাদগুণ বলা হয় সেই গুণটি থেকে এ ছন্দের বর্জিত নয়। ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যে এই ছন্দ বস্তুনিষ্ঠ, উদাও ভাব প্রকাশ ও লিরিকের সুকোমল মাধুর্য্য প্রকাশের উপযোগী হয়েছে। এই ছন্দ কাব্যের বহিঃপ্রকৃতি রচনায় যেমন সহায়ক তেমনই এর দ্বারা মানব, প্রকৃতির তীব্র মানসিক দ্বন্দ্ব, সংঘাত, প্রেম, প্রতারণা, অভিমান, ক্রোধ-এর প্রকাশ ও সম্ভব। ‘দশরথের প্রতি কৈকয়ী’র পত্রে একই সঙ্গে নাটকীয়তা ও তীব্র শ্লেষ কেকয়ীর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে কাব্যটিকে ভাষা ও ছন্দে অপূর্ব গভীরতা এনে দিয়েছে।

“এ কি কথা শুনি আজি মন্থরার মুখে, 

রঘুরাজ ? কিন্তু দাসী নীচকুলোম্ভবা, 

সত্য মিথ্যাজ্ঞান তার কভু না সম্ভবে। 

বহু তুমি ;–কেন আজ পুরবাসী যত 

আনন্দ সলিলে মগ্ন ?”

ছন্দের পাশাপাশি অলংকার প্রয়োগেও কবির অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্য লক্ষিত। উপমা ও রূপক প্রয়োগের পাশাপাশি সমাসোক্তি, দৃষ্টান্ত প্রভৃতি অলংকারেরও প্রয়োগ তিনি করেছেন।

সমগ্র পত্রটি যেন কৈকয়ীর তীব্র মানসিকল টানাপোড়েনের ক্রমিক উত্থান-পতনে গড়া এক বিচিত্র তরঙ্গভঙ্গ ধীরে ধীরে তা সুর চড়িয়েছে, কখনও খাদ নেমেছে আবার কখনও বা উচ্চকিত কণ্ঠে সংলাপকে দিয়েছে তুঙ্গতা, কৈকয়ীর মনে জাত ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ, ঈর্ষা ও দ্বেষের চরম প্রকাশ ঘটেছে এভাবেই, কখনও তার লেখনীতে মিশেছে ভবিষ্যতের প্রতিশোধস্পৃহা। কবি বর্তমানের মধ্যে কাহিনিকে সীমাবদ্ধ না রেখে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের খণ্ড খণ্ড চিত্রকে একত্র জুড়ে দিয়ে উপস্থাপনায় বৈচিত্র্য এনেছেন। আর এবের মধ্যে দিয়েই রামায়ণের কৈকয়ী চরিত্র মধুসূদনে হয়ে উঠেছে গতানুগতিকতা বিসর্জিত এক আধুনিক নায়িকা। কবি যে ভাব ও ভঙ্গিতে এ কাব্যের পরিবেশনা করেছেন তা তার বিষয়বস্তু, চরিত্র ও আঙ্গিক-এর মধ্যে শৈল্পিক সুষমাকেও বজায় রেখেছে। রামায়ণ-এর ‘কৈকয়ী’ এভাবেই মধুসূদনের ‘কেকয়ী’ রূপে পাঠকের দৃষ্টিতে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেছে।

Rate this post