জীবন মানেই দ্বন্দ্ব সংঘাতের সমন্বিত রূপ। একদিকে জীবনের প্রতি নিবিড় ভালোবাসাবোধ অন্যদিকে নৈকট্যজনিত পরিবেশ পরিস্থিতি বিঘ্নিত হলে তার জন্য বিরহ যন্ত্রণা—এই দ্বিবিধ দিক নিয়েই জীবনের সম্পূর্ণতা। রবীন্দ্রনাথ অনুভূতিপ্রবণ জীবনের মানবিক অনুভূতিকে যথেষ্ট মর্যাদা দিয়েছেন তার সৃষ্টি সম্ভারে। জীবন প্রীতিকে তিনি গভীর মূল্যের আসনে বসিয়েছেন বলেই বিরহ চেতনার অনুভূতি তাঁর চিত্তে এতখানি প্রকট হয়েছে। ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতায় বাস্তবিক পক্ষে জীবন প্রীতির সঙ্গে বিরহ চেতনার দ্বন্দ্ব সংঘাতময় প্রেক্ষাপট গড়ে উঠে হয়ে উঠেছে এক অসাধারণ শিল্প সৃষ্টি।

সুখ দুঃখ বিরহ মিলনপূর্ণ সেইসব মানব জীবন। জীবনের প্রতি ভালোবাসা প্রত্যকটি মানুষের অন্তরে অন্তরে অবস্থান করেছে। মরণপীড়িত চিরজীবী প্রেমের জয় ঘোষণায় কবি চিত্ত সোচ্চার। জীবন ক্ষণিক এবং এর অনিবার্য পরিণতি হল মৃত্যু। তবুও এই পৃথিবীতে মানবিক সম্পর্কের বন্ধন গড়ে ওঠে। মৃত্যু এসে তার নির্মম নিষ্ঠুর হাতে ছিন্ন করে দেয় ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা মানবিক সম্পর্ককে। সুখ ঐশ্বর্যপূর্ণ জীবনে তখন নেমে আসে শোকের কালো ছায়া। এ কবিতায় কবি সমগ্র বিশ্ব চরাচর জুড়ে পরিব্যাপ্ত বিষাদের কুয়াশাচ্ছন্ন দিককে যেন তুলে ধরতে চেয়েছেন। কবিতাটির মধ্যে প্রেম প্রকৃতি এবং মৃত্যুর অপরূপ রস সমৃদ্ধ এক দিক প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কবি ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতায় মৃত্যুকে দেখিয়েছেন জীবনের দিক থেকে। সেই কারণে কবিতাটির অভ্যন্তরলোকে জীবনপ্রীতির সঙ্গে বিরহচেতনা আত্মিক দ্বন্দ্ব সংঘাত প্রাধান্য পেয়েছে।

কাহিনি কেন্দ্রিক এ কবিতা। ক্ষুদ্র এক কাহিনিকে কেন্দ্র করে এখানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বৃহৎ বিশ্ব প্রকৃতির ব্যঞ্জনা। কাহিনির কেন্দ্রবিন্দুতে আছে মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের জীবন। কাহিনির নায়ক চাকুরিজীবী। সুখি বাঙালি গৃহস্থের প্রতীকি চরিত্র সে। পতিব্রতা তার স্ত্রী এবং অবুঝ বছর চারেকের একটি মেয়েকে নিয়ে গড়ে উঠেছে তার সুখের সংসার। সে সংসারে আর্থিক অভাব অনটনের কোনো চিত্র নেই। একাধিক ভৃত্য তাদের আছে। এহেন সংসারে একটি দুঃখের দিক বর্তমান তা হল পরিবারের কর্তাকে বহুদূরে পরিবার পরিজন ছেড়ে বাস করতে হয়। বাইরে চাকুরি করে সে। পূজা পার্বণ উপলক্ষ্যে মাঝে মধ্যে বাড়ি আসে। ছুটি শেষে আবার তাকে ফিরতে হয় কর্মস্থলে ; পূজার ছুটি শেষে কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার সময়েই কবিতার সূত্রপাত। একদিকে সুখি গৃহস্থ্য পরিবারের জীবনপ্রীতি এবং অন্যদিকে আত্মীয় পরিজনের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার বিরহ বেদনা এ কবিতার মধ্যে অভূতপূর্ব শিল্পসৌন্দর্য মণ্ডিত হয়ে পরিবেশিত।

আশ্বিন মাসের শেষ। বেড়েছে রোদের ঝাঁঝ। জনহীন পথে উড়ে চলে ধূলি। চারিদিকে নিঝুম নিস্তব্ধ পরিবেশ। কবি নায়কের গৃহে কারো বিশ্রাম নেই। আজ তার যাবার দিন। সকাল থেকেই চলেছে প্রস্তুতি। দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি। জিনিসপত্র বাধাবাধির কাজে ব্যস্ত ভৃত্যরা। অতি ব্যস্ততার মধ্যে সময় কাটছে গৃহিণীর। এর মধ্যে ওর দুচোখ বেয়ে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে জলের ধারা। বিদায়ের আয়োজনে তবু তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। মাথা নিচু করে শাড়ির আঁচল টেনে কোনোক্রমে সে চোখের জল সামলায়। অমঙ্গলের প্রতীক এই চোখের জলকে সে বিদায় বেলায় কোনোক্রমে চেপে রাখতে চায়। চার বছরের একটা মেয়ে বাইরের দরজা আগলে বসে আছে। অন্যদিনে তার এতক্ষণ স্নান সারা হয়ে যায়; মুখে ভাত তুলে দিলেই চোখে আসে ঘুম। আজ নিয়মের বালাই নেই। তার দিকে কেউ দৃষ্টি দেয় না। চুপচাপ ক্লাস্ত দেহে সে দরজার গোড়ায় গিয়ে বসে। তার বাবা যখন ‘মাগো আসি’ বলে বিষণ্ণ নয়নে বিদায় নিতে আসে তখন সে বিষাদ মাখা দৃষ্টি মেলে ম্লান মুখে বলে উঠে ‘যেতে আমি দিব না তোমায়’ কিন্তু বাস্তব বড়ো নিষ্ঠুর। জীবনপ্রীতির বন্ধনকে সেখানে ছিন্ন করতে হয়। যেতে হয় তাকে সময় ফুরানোর সঙ্গে সঙ্গে।

কাহিনি ধারার সমাপ্তি এখানেই। কিন্তু কবিতার সুরেলা ভাব পরিমণ্ডল শুরু হয়েছে এখান থেকেই। কবি নায়কের কাছে খুলে গেছে উপলব্ধির এক নতুন জগতের দ্বার। তার অন্তরে তখন কেবল বিষাদের ছায়া। সব সে ভুলতে পারে। কিন্তু কেমন করে ভুলবে এই অবুঝ মেয়েটির সকরুণ আবেদন। সে যে তাকে বেঁধেছে মায়ার বন্ধনে। গতিশীল জীবন ছন্দে বাঁধা পড়েছে সে। তাই সবার আবেদনকে নিষ্ঠুরের মতো উপেক্ষা করতে হয় তাকে। অসহায় মানুষ জীবনপ্রীতির বশবর্তী হয়ে প্রিয়জনকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়; বাস্তবে তা সম্ভবপর হয় না। তখনই দেখা দেয় নিরুপায় হাহাকার। এই হাহাকারের মধ্যেই বিরহ বেদনার করুণ সুর বড়ো হয়ে ওঠে। ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতায় সেই জীবনপ্রীতি এবং বিরহ বেদনার সুরের করুণ পরিণতি পরিস্ফুট।

বিশ্ব জননীর কাছে, বসুন্ধরার কাছে আমরাও যেন মা ও সন্তানের সম্পর্ক সূত্রে বাঁধা। পৃথিবীতে এসে আমরা শাশ্বতভাবে থাকতে পারি না। এমন একটা দিন আসে যেদিন সব ছেড়ে আমাদের চলে যেতে হবে। ধরিত্রী জননীর কাছে থেকে বিদায় নেওয়ার প্রসঙ্গটি ‘সমুদ্রের প্রতি’, ‘বসুন্ধরা’ প্রভৃতি কবিতায় ব্যক্ত হয়েছে। ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতাতেও সেই একই ভাবের প্রকাশ ঘটেছে ভিন্নরূপে। এখানে ধরিত্রী মানব-সস্তানের দুঃখে ব্যথিত। বিরহ যন্ত্রণা শুধু মানুষের নয়, তা ধরিত্রীরও আছে। তাই সেখানেও দুঃখ ব্যথা বেদনাপূর্ণ অনুভূতির অভিব্যক্তি। কবির কথায় তার প্রকাশ—

“চারিদিক হতে আজি

অবিশ্রাম কর্ণে মোর উঠিতেছে বাজি

সেই বিশ্ব মর্মভেদী করুণ ক্রন্দন 

মোর কন্যাকণ্ঠস্বরে শিশুর মতন

বিশ্বের অবোধ বাণী।”

তাই কবি আশাহীন চিত্তে বিষাদকুয়াশার বিশ্বময় ব্যাপ্তি অনুভব করেছেন। তরুর মর্মরে উপলব্ধি করেছেন ব্যাকুলতা ; বিশ্বের প্রান্তর মাঝে শুনেছেন মেঠো সুরে অনন্ত বাঁশির ক্রন্দন ধ্বনি ; চার বছরের মেয়েটির মতো বসুন্ধরাকে দেখেছেন উদাসী উদভ্রান্তের মতো।

ভাব গম্ভীর কবি রবীন্দ্রনাথ। জীবনকে তিনি উপলব্ধি করেছেন প্রগাঢ় অনুভূতির আলোকে। জীবনের দুর্নিবার আকর্ষণে তিনি আকৃষ্ট। সেই কারণে কবিচিত্তে বিরহ বিষাদময়তার সুরও হয়ে উঠেছে করুণ মর্মান্তিক। ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতা একই সাথে জীবনপ্রীতির সঙ্গে বিরহ বেদনার বিষাদ করুণ দিককে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দিয়েছে। সেই কারণে ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতায় জীবনপ্রীতির সঙ্গে বিরহচেতনার অঙ্গাঙ্গী যোগে সম্পর্কের দিকটি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

Rate this post