সূচনা: ইন্দোনেশিয়া হল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দ্বীপরাষ্ট্র। প্রায় ৫ হাজার দ্বীপের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। উনবিংশ শতকের শুরুতে ইন্দোনেশিয়া বা পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে ইউরােপের হল্যান্ডের ডাচ বা ওলন্দাজদের চূড়ান্ত ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে তারা ইন্দোনেশিয়ার সাধারণ মানুষের ওপর তীব্র শােষণ-পীড়ন চালাতে থাকে। ফলে সেখানকার সাধারণ মানুষের মনে ডাচ শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ জমে।

ডাচদের তীব্র শােষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিংশ শতকের শুরুতে, বিশেষ করে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ইন্দোনেশিয়ায় মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়। এই বছরটি ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাসে জাতীয় জাগরণের বছর নামে পরিচিত। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ডাচদের বিরুদ্ধে ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলন ক্রমে শক্তিশালী হতে থাকে।

স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি হল্যান্ড দখল করে নিলে ইন্দোনেশিয়া হল্যান্ডের হাতছাড়া হয় এবং জাপান ইন্দোনেশিয়া দখল করে নেয়। বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর হল্যান্ড আবার ইন্দোনেশিয়ার দখলদরি কায়েম করতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে ইন্দোনেশিয়ার মানুষ ডাচদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে।

আন্দোলনের অগ্রগতি: ইন্দোনেশিয়ার বিদ্রোহীরা ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা ঘােষণা করে। সেখানকার জাতীয়তাবাদী নেতা ড. সুকর্ণ ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। জাপান এই সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। তার প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল পার্টি (National Party)-র উদ্যোগে ডাচ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে ইন্দোনেশিয়ায় মুক্তিসংগ্রাম তীব্রতর হয়ে ওঠে।

স্বাধীনতা লাভ: ইন্দোনেশিয়ার মানুষের প্রবল আন্দোলনের চাপে হল্যান্ড বাধ্য হয়ে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে (২৭ ডিসেম্বর) ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা স্বীকার করে নেয়। স্বাধীন ইন্দোনেশিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ড. সুকর্ণ। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পরবর্তীকালে বহু জাতি ও ধর্ম অধ্যুষিত ইন্দোনেশিয়ায় জাতীয় ঐক্য সংকটের সম্মুখীন হয়। ফলে রাষ্ট্রপতি সুকর্ণ ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে সেখানকার সংবিধান নাকচ করে ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’ প্রবর্তনে বাধ্য হন।

১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে আধুনিক ইন্দোনেশিয়ার দ্রুত বিকাশ ঘটে। স্বাধীন ইন্দোনেশিয়ার বিকাশ ও জাতি সংগঠনের ধারাকে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়, যথা—

  • [1] প্রথম পর্যায় (১৯০০-১৯৪৫ খ্রি.), 

  • [2] দ্বিতীয় পর্যায় (১৯৪৫-১৯৫০ খ্রি.) এবং 

  • [3] তৃতীয় পর্যায় (১৯৫০ খ্রি. থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত)।

প্রথম পর্যায় (১৯০০-১৯৪৫ খ্রি.): প্রথম পর্যায়ে মােটামুটিভাবে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে জাতি হিসেবে ইন্দোনেশিয়ার মানুষ সচেতন হতে থাকে। এই সময় ডাচ নিয়ন্ত্রণমুক্ত পৃথক ইন্দোনেশিয়া ধারণাটি গড়ে ওঠে এবং স্বাধীনতার দাবিতে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে হল্যান্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে জাকার্তা শহরের যুবকদের এক সভায় পৃথক জাতি হিসেবে ইন্দোনেশিয়ার ধারণা প্রচার করা হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যুবকরা এই সভায় মিলিত হলে তাদের মধ্যে ভাবের আদানপ্রদান ঘটে এবং ঐক্যবদ্ধ জাতীয় চেতনা গড়ে ওঠে। এভাবে বহুধাবিচ্ছিন্ন ইন্দোনেশিয়া ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রবল স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করে। ড. সুকর্ণ ও হাত্তা ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে (১৭ আগস্ট) ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা ঘােষণা করেন।

দ্বিতীয় পর্যায় (১৯৪৫-১৯৫০ খ্রি.): দ্বিতীয় পর্যায়ে হল্যান্ডের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ইন্দোনেশিয়ার ব্যাপক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এই সময় দেশে জাতীয় সংহতি ও জাতীয়তাবাদ অত্যন্ত শক্তিশালী হয়। ইন্দোনেশিয়ার মানুষ বিদেশি শাসনের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের উদ্দেশ্যে মরণপণ লড়াই শুরু করে। তীব্র লড়াইয়ের ফলে ইন্দোনেশিয়ায় ডাচ শক্তির চূড়ান্ত পতন ঘটে এবং ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ঐক্যবদ্ধ, স্বাধীন, সার্বভৌম প্রজাতান্ত্রিক ইন্দোনেশিয়ার আত্মপ্রকাশ ঘটে। এর রাজধানী হয় জাকার্তা।

তৃতীয় পর্যায় (১৯৫০ খ্রি. থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত): তৃতীয় পর্যায়ে ইন্দোনেশিয়া একটি সুসংগঠিত জাতি ও সুপ্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ড. সুকর্ণ র নেতৃত্বে দেশে প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্য সুকর্ণ ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সেদেশে একনায়কতান্ত্রিক শাসন চালান। ইতিমধ্যে ইন্দোনেশিয়া, সােভিয়েত রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে সংঘটিত ঠান্ডা লড়াইয়ের আবর্তে জড়িয়ে পড়ে। রাশিয়ার প্রভাবে ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির আন্দোলনের যথেষ্ট প্রসার ঘটে। এই দল ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে (৩০ সেপ্টেম্বর) ইন্দোনেশিয়ার ক্ষমতা দখল করে। এই সময় থেকে কমিউনিস্ট নেতা সুহার্তো র আমলে (১৯৬৫-১৯৯৮ খ্রি.) ইন্দোনেশিয়ায় যথেষ্ট শিল্পায়নের প্রসার ও অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটে। গ্রামীণ ক্ষেত্রেও যথেষ্ট উন্নয়ন সম্ভব হয়। অবশ্য ইন্দোনেশিয়ার সংস্কার আন্দোলনের চাপে সুহার্তো-র পতন (১৯৯৮ খ্রি.) ঘটে এবং হাব্বিবি ক্ষমতা দখল করেন।

উপসংহার: একদা রাষ্ট্রপতি সুকর্ণ ১৯৬৫-৬৬ খ্রিস্টাব্দে নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলাফলস্বরূপ স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা সুকর্ণ ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত গৃহবন্দি অবস্থায় কাটান।

Rate this post