গ্রাম্য মেলা

সূচনা : ‘মেলা’র আক্ষরিক অর্থ “মিলন’’। মেলার নামে সবার মন এক অভূতপূর্ব আনন্দে নেচে ওঠে। মেলার আনন্দের স্মৃতি সবার মনেই থাকে গভীরভাবে মুদ্রিত। মেলা পরস্পরের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও ভাব-বিনিময়ের সংযােগ সেতু। প্রাচীনকাল থেকেই গ্রাম্য মেলার গুরুত্ব তাই অসীম। মেলার প্রচলন । বিশেষ কোন পর্ব উপলক্ষে মেলার প্রচলন হলেও এখন গ্রামীণ-জীবনে এটি একটি স্বাভাবিক উৎসবে রূপ নিয়েছে। সাধারণত বছরের শেষে অথবা বছরের শরতে এই মেলা বসে অথবা বিশেষ কোন পব উপলক্ষেও মেলার আয়ােজন করা হয়ে থাকে। 

মেলার স্থান ও সময় : বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাতেই নানা ধরনের মেলার প্রচলন রয়েছে। স্থান বিশেষে রয়েছে কিছু বিখ্যাত মেলা। যা ওই স্থানের নামেই সুপরিচিত। সাধারণত মেলা বসার জন্য হাট-বাজারের ন্যায় নিদিষ্ট কোনাে স্থান নির্ধারিত থাকে না। গ্রামের কেন্দ্রস্থলে খােলা মাঠে, মন্দির প্রাঙ্গণে, নদীর তীরে অথবা বড়াে বৃক্ষের নিচে গ্রাম্য মেলা বসতে দেখা যায়। পূর্ব ঐতিহ্য অনুযায়ী এসব স্থানে মেলার আয়ােজন করা হয়। মেলার প্যানে সাময়িকভাবে দোকানপাট বসার মত চালা নির্মাণ করা হয়। মেলা শেষ হওয়ার পর এগুলাে ভেঙে ফেলা হয়। বছরের শেষে মেলার আনন্দে আবারও মুখর হয়ে ওঠে মেলার সে স্থান। বাংলাদেশে প্রচলিত মেলাগুলাের কোনােটি একদিন, কোনােটি এক সপ্তাহ, কোনােটি পনের দিন আবার কোনাে কোনাে মেলা এক মাসব্যাপী চলতে থাকে। আজকাল শুধু গ্রাম নয়, শহর বা আধা শহরেও মেলার আসর বসে। তবে গ্রামই মেলার উপযুক্ত পটভূমি। 

মেলার উপলক্ষ : আমাদের দেশে গ্রামে সাধারণত ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। পয়লা বৈশাখ, রথযাত্রা, জন্মাষ্টমী, বিজয়া দশমী, দশই মহরম, চৈত্র সংক্রান্তি এসব উৎসবকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ মেলা বসে। থাকে। তবে উপলক্ষ যাই হােক না কেন বাঙালি সমাজ ও মানুষের কাছে মেলা খুব জনপ্রিয়। মেলায় সমাজের সব শ্রেণির মানুষ, ধনী-নির্ধন, উচ্চ-নীচ নির্বিশেষে সবাই এসে মিলিত হয়। বিভেদের পার্থক্য ভুলে গিয়ে সবাই এক আনন্দের জোয়ারে গা ভাসায়। মেলাকে আশ্রয় করেই গ্রামীণ মানুষের আনন্দ-উৎসবের রুদ্ধ দুয়ার খুলে যায়। এর মধ্যেই সে খুঁজে পায় বেঁচে থাকার সার্থকতা। খুঁজে পায় মুক্তির আনন্দ। 

মেলার প্রস্তুতি : কোন্ দিন মেলা বসবে তা এলাকার লােকেরা আগে থেকেই জানে এবং সে অনুসারে তাদের । প্রস্তুতি চলে। গ্রামের ছােটো ছােটো ছেলে-মেয়েরা আগে থেকেই মেলায় খরচ করার জন্য তাদের বাবা-মার কাছ থেকে নিয়ে টাকা-পয়সা জমা করতে থাকে। এছাড়া, আশেপাশের কারিগরেরা মেলায় বিক্রির জন্য আগে থেকেই বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করতে থাকে।

মেলার বর্ণনা ও মেলার সাধারণ চিত্র : প্রত্যেক মেলারই একটা সাধারণ চিত্র আছে। যেন চলমান এক ছবি। চেচামেচি, হট্টগােল, ঠেলাঠেলি, হাসি-কান্না, ছােটো ছােটো ছেলেমেয়েদের বিস্ময়-বিমুগ্ধ দৃষ্টি, খুশির উচ্ছাস, মঙবেরঙের পােশাক-আশাক। নাগরদোলা, কাটামুণ্ডু জোড়া লাগার জাদবিদ্যা, তালপাতার বাঁশির আওয়াজ, রকমারি খেলনা, মন্ডা-মিঠাইয়ের দোকান, জিলিপি খাওয়ার ধুম, পাপড়-তেলেভাজার ঘ্রাণ, জামা-কাপড়, হাড়িকুড়ি নানা রকমের পণ্য-পসরা, এমনি একের পর এক আরও কত জীবন্ত চিত্র।

মেলায় দূর-দূরান্ত থেকে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী নিয়ে দোকানদাররা আসে। মেলায় দোকানগুলাে সুশৃঙ্খলভাবে সাজানাে থাকে। মেলায় কোথাও খেলনা, কোথাও ডালা-কুলা-চালুনি, কোথাও কাঠের জিনিসপত্র, কোথাও মাটির জিনিসপত্র, কোথাও ঘুড়ি এবং কোথাও খাবারের জিনিসের দোকান বসে। এছাড়া মেলার একপাশে নাগরদোলা ও সার্কাস বসে। চলে বানরের নাচ, পুতুল নাচ, তার সঙ্গে চলে ছােটো ছেলেমেয়েদের নাচানাচি। অনেক কৃষক তাদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে মেলায় হাজির হয়। কুটির শিল্পের অসংখ্য নমুনা এখানে আনা হয়ে থাকে। আশেপাশের এলাকার বিভিন্ন শ্রেণির কারিগরেরা যেসব জিনিস তৈরি করে, তা তারা বিক্রয়ের জন্য মেলায় নিয়ে আসে। এভাবে সুন্দর সুন্দর জিনিসের সমারােহে সারা মেলা পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। কোনাে কোনাে মেলায় কিছু খেলাধুলার প্রতিযােগিতাও চলে। এর মধ্যে হা-ডু-ডু ও কুস্তি প্রতিযােগিতা দর্শকদের বিশেষ আনন্দ দেয়। কোনাে কোনাে মেলায় উপভােগ করার মত থাকে ম্যাজিক, যাত্রা, থিয়েটার ইত্যাদি বিনােদনমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন। 

মেলার তাৎপর্য : মেলার আছে দুটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক : মনস্তাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক। মনস্তাত্ত্বিক দিক হলো : ভাবের আদান-প্রদান, অর্থনৈতিক দিকটি হলাে পণ্য বিকিকিনি। গ্রামীণ জীবনে মেলা গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবনে অনাবিল আনন্দের উৎস হিসেবে উদযাপিত হয়। মেলা গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি। গ্রামের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী, নানা শিল্প সভার মেলায় প্রদর্শিত হয়ে গ্রামীণ জীবনের ছবি স্পষ্ট করে তােলে। গ্রামীণ জীবনের কৃতিত্বের পরিচয় রূপায়িত হয় গ্রাম্য মেলার মাধ্যমে। গ্রামের নানা খেলা ও আমােদ-প্রমােদের উপকরণ দেখতে পাওয়া যায় গ্রাম্য মেলায়। বস্তুত গ্রামের মানুষের সৃষ্টিশীলতার পরিচয় ফুটে ওঠে গ্রাম্য মেলার মাধ্যমে। 

মেলার উপকারিতা : আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে গ্রাম্য মেলা শুধু আনন্দ চিত্তের শান্তিই দেয় না, বিত্তের শক্তিও জোগায়। মেলায় কৃষি ও কুটির শিল্পজাত দ্রব্যাদি বেচাকেনা হয়। মেলাকে কেন্দ্র করে গ্রামের কামার-কুমার, তাঁতি, সুতারদের মধ্যে বিভিন্ন জিনিস বানানাের হিড়িক পড়ে যায়। তাই দেখা যাচ্ছে, মেলার মাধ্যমে গ্রামীণ অনেক মানুষের কিছু উপার্জনের পথও প্রশস্ত হয়। এছাড়া সার্কাস ও যাত্রাদলসহ আরও অনেকেই মেলায় ব্যবসায় করে। থাকে। এতে করে বহু লােকের কিছুটা হলেও অন্ন সংস্থান হয়। 

মেলার অপকারিতা : মেলায় উপকারের পাশাপাশি অপকারও আছে। মেলায় বিচিত্র লােকের সমাগম ঘটে। জুয়া, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, সন্ত্রাসীসহ বিভিন্ন অসামাজিক ও অন্যায় অবৈধ কাজ মেলায় সংঘটিত হতে পারে বা হয়। । তাছাড়া, যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগের ফলে পরিবেশ দূষিত হয় এবং নানা রকম রােগের প্রাদুর্ভাব হয়। অনেক সময় পচাবাসি খাবার খাওয়ার ফলে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। 

উপসংহার : মেলা হচ্ছে গ্রামীণ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পরিচায়ক। মেলা লােক সংস্কৃতিরই এক বিশেষ ধমনী। এই ধমনীতেই জীবনের পন্দন। এরই মধ্যে বাঙালি খুঁজে পায় নিজেকে। মেলা তাে নিছক আনন্দ-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্র নয়। এর সঙ্গে যুক্ত আছে তার দীর্ঘকালের ধর্ম-সাধনা। আছে তার জীবন-লীলার নানা তরঙ্গের ঘাত-প্রতিঘাত। এরই মধ্যে আছে তার অর্থনৈতিক নিশ্চয়তার আশ্বাস। আছে জীবনের অফুরান প্রাণশক্তির প্রকাশ। মেলাই তার বেঁচে থাকার প্রতিশ্রুতি। তার অস্তিত্ব। তার দর্পণ।

Rate this post