রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত রূপক-সাংকেতিক নাটকের পরিচয়
ভূমিকা: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ দ্রষ্টা ও স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের [১৮৬১-১৯৪১) সমগ্র নাট্যসাহিত্যে নাটক নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা লক্ষ করা যায়। আখ্যানবস্তুর সুনিপুণ বিন্যাস-কৌশলে, ঘটনার দ্রুত প্রবাহে, নাটকীয় চমৎকারিত্ব সৃষ্টিতে এবং পাত্র-পাত্রীর বাইরের ও মানসিকজগৎ উন্মোচনে তাঁর নাটকগুলো সার্থক। রবীন্দ্রনাট্যসাহিত্যে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে তাঁর রূপক-সাংকেতিক নাটকগুলো। এ জাতীয় নাটকের মধ্যে ‘অচলায়তন’ (১৯১২], ‘রক্তকরবী’ (১৯২৬), ‘রাজা’ [১৩১৭ বঙ্গাব্দ), ‘ডাকঘর’ [১৩১৮ বঙ্গাব্দ), ‘মুক্তধারা’ [১৩২৯] অন্যতম।
রূপক দ্ব্যর্থক অর্থাৎ দুটি অর্থ বহন করে। এর বাইরের কাঠামো এক অর্থ এবং ভিতরের কাঠামো আরেক অর্থ। এই জাতীয় নাটকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাইরের কাঠামো প্রকাশের চেয়ে ভিতরের কাঠামো প্রকাশে অধিকতর মনোনিবেশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের রূপক-সাংকেতিক নাটকের তত্ত্ববস্তু ও নাট্য-সংঘাতের মূলে আছে এক মৌলিক দ্বন্দ্ব, সেই দ্বন্দ্ব প্রাণধর্মের সাথে জড়ধর্মের। নিচে তাঁর রূপক-সাংকেতিক নাটকগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা উপস্থাপিত হলো।
‘রক্তকরবী’: বাংলা নাট্যসাহিত্যের ধারায় ‘রক্তকরবী’ আলোড়ন সৃষ্টিকারী নাটক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ধনবাদী সভ্যতার সর্বগ্রাসী রূপ এখানে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘রক্তকরবী’ নাটকে রূপকের মাধ্যমে ধনবাদী সভ্যতার প্রলয়ঙ্করী রূপটাকে বর্ণনা করেছেন।
‘রক্তকরবী’ নাটকটিতে রক্তকরবী নামক ফুলটির দ্বারা রবীন্দ্রনাথ বর্ণবাদী সভ্যতার অক্টোপাস থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ‘রক্তকরবী’র উজ্জ্বল আভায় তিনি যাবতীয় শোষণ মুক্ত হয়ে নতুন সমাজ সৃষ্টি কামনা করেছেন।
ব্যাঙ: রবীন্দ্রনাথ এই নাটকে ব্যাঙকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এর মাধ্যমে ধনবাদী সমাজ ব্যবস্থায় নিরন্তর টিকে থাকার সংগ্রামকে বুঝানোর প্রয়াস পেয়েছেন।
বাজপাখী : ‘রক্তকরবী’ নাটকে সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রতীক হিসেবে আগমন ঘটেছে বাজপাখীর প্রতীক টিকে। বাজপাখীর প্রতীকের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ধনবাদী সভ্যতার শোষণটিকে প্রকাশ করেছেন। ধনবাদী সভ্যতার মালিক শ্রেণি যেমন শ্রমিক শ্রেণিকে শোষণ করে নিজের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখে তেমনি বাজপাখী ক্ষুদ্র প্রাণীকে ভক্ষণ করে তার নিজের অস্তিত্ব করে তোলে মজবুত।
নীলকণ্ঠ: রবীন্দ্রনাথ এই নাটকে শিবের মূর্তিকে পরোক্ষভাবে আনয়ন করেছেন। যা রঞ্জনের চরিত্রের মাধ্যমে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। শিব যেমন বিষপান করেছিল রঞ্জনদত্ত তেমনি তেমনি সর্বগ্রাসী রূপ ধনবাদী সভ্যতার দুঃখ-যন্ত্রণা ধারণ করেছে।
পৌষের গান: ‘রক্তকরবী’ নাটকে একটি গানকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। গানটি চৈতালী ফসলের গান। এ গানের মাধ্যমে আধুনিক যন্ত্র সভ্যতা থেকে, শোষণ যুক্ত সমাজ ব্যবস্থা, ধনবাদী সমাজ ব্যবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে কৃষিভিত্তিক সভ্যতার শান্তির নীড়ে আসার অংকন করা হয়েছে।
জাল: এই নাটকে শোষণের কাণ্ডারী হিসেবে রাজা নামক চরিত্রটি এসেছে। রাজা জালের আড়ালে থেকে শোষণ প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে অবস্থান করছে। এ জালের রূপকের মাধ্যমে ধনবাদী সমাজের শোষণের চিত্র ফুটে ওঠে। এই রাজাকে ঘিরেই অত্যাচারের স্ট্রিম রোলার আবর্তিত হচ্ছে।
চরিত্র: এই নাটকে নাট্যকার দুই শ্রেণির চরিত্র সৃষ্টির মাধ্যমে তাঁর প্রকৃত মনোভাব ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রথম পক্ষে আছে যাবতীয় অত্যাচার ও অমঙ্গলের প্রতীকী চরিত্র যারা রাজা, সর্দার, অধ্যাপক ও তাদের সহযোগিরা। আবার দ্বিতীয় পক্ষে আছে শোষিত-বঞ্চিতদের চরিত্র যাদের মধ্যে এখনো প্রাণের ছোঁয়া বিদ্যমান। এরা হলো নন্দিনী, রঞ্জন, বিত্ত, কিশোর। আর রবীন্দ্রনাথ এই চরিত্রগুলোর মাধ্যমে ধনবাদী সভ্যতা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজেছেন। নাটকটির কোনো কোনো চরিত্রের সংলাপের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ পরোক্ষভাবে তার নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেছেন যেমন গজ্জু পালোয়ান। একবার সর্দারকে উদ্দেশ্য করে বলেছে:
“এরা কোথাকার দানব, জাদু জানে! শুধু জোর নয়, একেবারে ভরসা পর্যন্ত শুষে নেয়!- যদি কোনো উপায়ে একবার- হে কল্যাণময়ী হরি- আঃ যদি একবার দয়া হলে কী না হতে পারে- সর্দারের বুকে দাঁত বসাতে পারি।”
প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ধনবাদী সভ্যতার সাম্রাজ্যবাদী রূপ ও তাদের শোষণ প্রক্রিয়া থেকে মুক্তির। উপায় খুঁজেছেন এই নাটকে। যা রূপকের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এ পর্যায়ে তিনি কাহিনির পর্যায় ক্রমিক ধারায় রামায়ণের কাহিনিকেও কিছুটা স্মরণ করেছেন। রামায়ণের কাহিনিতে রাবণ যেমন শোষণের কেন্দ্রে অবস্থান করে শোষণ প্রক্রিয়া পরিচালনা করেছেন, রাজাও তেমনি এ নাটকের কেন্দ্রে অবস্থান করে যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। এই রাজা লঙ্কা রাজার মতোই ধনরত্ন দিয়ে পাহাড় গড়েছেন। নাটকটির পরিশেষে দেখা যায় অত্যাচারের প্রতীক রাজা শোষিতদের পৌষের গানে শরীক হয়েছে এবং শোষণের পতাকা ভেঙে দিয়েছে। এখানে রবীন্দ্রনাথ মূলত রূপকের মাধ্যমে ধনবাদী সভ্যতার নিঃশেষিত অবস্থাকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
‘রাজা’: ‘রাজা’ নাটক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অভিনব শিল্পসৃষ্টির এক অপূর্ব নিদর্শন। এ নাটকে রবীন্দ্র নাট্য প্রতিভার অনন্যতার পরিচয় পাওয়া যায়। ‘রাজা’ রবীন্দ্রনাথের রূপক সাংকেতিক নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিষয়বস্তুর অসাধারণত্বে, অনুভূতির তীব্রতায়, সংকেতের অব্যর্থ প্রয়োগে, অতীন্দ্রিয় রহস্যময় আবহ সৃষ্টিতে বিশ্বনাট্য সাহিত্যের ধারাও ‘রাজা’ নাটক অনন্য। মূলত অরূপ, অদৃশ্য পরমাত্মার সাথে জীবাত্মার প্রেম মিলনের কাহিনিই রাজা নাটকের মূল বিষয়বস্তু। ‘রাজা’ নাট্যরূপের কাহিনি বৌদ্ধ সাহিত্যের কুশজাতক অবলম্বনে পরিকল্পিত। এই মূলগল্পটিকে পরিবর্তন পরিবর্ধন ও সংযোজন করে নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘রাজা’ নাটকের আখ্যান ভাগ রচনা করেছেন।
‘রাজা’ নাটকটি বিশটি দৃশ্যে সুবিন্যস্ত। কোনো অঙ্ক বিভাজন নেই। এ নাটক রবীন্দ্রনাথ প্রথাগত নাট্যরীতি অনুসরণ করেননি। স্থান, কাল ও ঘটনা অনুসারে তিনি এ নাটকের দৃশ্য সংযোজন করেছেন। রাজা নাটকের আখ্যানভাগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলনের আধ্যাত্মিক তত্ত্বকে রূপায়িত করেছেন। সে কারণে রবীন্দ্রনাথ এ নাটকের ঘটনাসংস্থানে সাংকেতিক শিল্পকৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন।
এ নাটকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাংগীতিক, সংকেতময় ও ব্যঞ্জনাধর্মী পরিচর্যা কৌশল ব্যবহার করেছেন। রাজা নাটকের কাহিনিতে ২৬টি রূপক সাংকেতিক ধর্মী গীতসমাবেশ ঘটিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। এই গানগুলো উপযোগিতা দৃশ্যাদির সূত্র নির্ধারণে যেমন ভূমিকা রেখেছে তেমনি গানগুলো পরস্পরের সঙ্গে একটা ভাবের ঐক্য ও নাটকীয় চমক সৃষ্টির বিষয়ত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ। এ নাটকের একাধিক গান বিভিন্ন চরিত্রের সংলাপের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত। যেমন-
ক. ‘খোলো খোলো দ্বার, রাখিয়োনা আর
বাহিরে আমায় দাঁড়িয়ে।’ (১ম দৃশ্য)
খ. ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে
নইলে মোদের রাজার সনে মিলবো কি সত্ত্বে।’ (২য় দৃশ্য)
‘রাজা’ নাটকের পরিব্যাপ্তি সবকিছুই রঙের খেলা। এ নাটকের পরিচর্যা কৌশলে নাট্যকার রঙের ব্যবহার করেছেন প্রতীকী অর্থে। রাজাবাদে সব পাত্রপাত্রীকেই রঙে রাঙিয়েছেন। কারণ স্রষ্টার সৃষ্টি আলোকময়, সৌন্দর্যময়। শুধু রাজা অন্ধকারের প্রতীক। এ নাটকের সর্বত্রই প্রতীকী, সংকেতময় ও রূপকাশ্রয়ী পরিচর্যা কৌশলই প্রধান হয়েছে।
‘অচলায়তন’: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের রূপস্রষ্টা এবং রূপদক্ষ শিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অচলায়তন’ নাটকটি তাঁর অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর। রবীন্দ্রনাথের রূপক সাংকেতিক নাটকগুলোর মধ্যে ‘অচলায়তন’ এক অপরূপ সৃষ্টি। বিষয়বস্তুর অসাধারণত্বে ও গৌরবে, অনুভূতির তীব্রতায়, সংকেতের অব্যক্ত প্রয়োগে বিশ্ব নাট্য সাহিত্যের ধারায় ‘অচলায়তন’ নাটকটি অনন্য।
‘অচলায়তন’ নাটকে রবীন্দ্রনাথ মূলত ধর্মের মর্মবাণী তত্ত্বকথায় প্রকাশ না করে হৃদয়ের একটি প্রত্যক্ষ অনুভূতি, একটি সূক্ষ্ম অপরূপ স্পর্শের মতো দেখতে প্রয়াস পেয়েছেন। সমন্বয় প্রত্যাশী রবীন্দ্র চেতনায় জ্ঞান, প্রেম ও কর্ম একীভূত হয়েছে। উপনিষদের সত্যসাধনা, বৌদ্ধধর্মের মৈত্রী করুণা এবং বৈষ্ণব ও খিষ্টধর্মের প্রেমভক্তি একত্রে সমন্বিত হয়েছে রবীন্দ্রচেতনায়। অর্থৎ সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ ও আচার পদ্ধতির আনুষ্ঠানিকতার বিপরীতে রবীন্দ্রনাথ অচলায়তনে জ্ঞান, কর্ম ও প্রেমের পরিপূর্ণ মিলনে আধ্যাত্মিক সাধনার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধর্মসাধনায় দেখতে চেয়েছেন গতির বাধাহীনতা, ভাবের বৈচিত্র্য এবং অক্ষুণ মাধুর্যের নিত্যবিকাশ, ভারতবর্ষ জ্ঞান, প্রেম ও কর্মের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে আধ্যাত্মিকতা অভিব্যক্ত করেছেন। প্রাটীন ভারতবর্ষের আদর্শই ‘অচলায়তন’ নাটকে উপস্থাপিত হয়েছে। সমন্বয়পন্থি ভারতবর্ষের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হলে তার পরিণতি কী হয় ‘অচলায়তন-এ তাও প্রদর্শিত হয়েছে।
‘অচলায়তন’ নাটকের শিল্পমূল্য বিচার করতে গিয়ে সুকুমার সেন বলেছিলেন: ‘এটি হলো রবীন্দ্রনাথের নাট্যরচনার মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুসংহত, সর্বাপেক্ষা সুমিত এবং সর্বাধিক শিল্পোজ্জ্বল একটি নাটক।’ সমাজতাত্ত্বিক মূল্যেও নাটকটি অসাধারণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ে সমাজ ও ধর্মচিন্তায় যে পরিণতবুদ্ধি অর্জন করেছিলেন ‘অচলায়তন’ নাটকে তার সূচনা হয়। নাটকটি যে বাঙালি সমাজকে বিশেষভাবে নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছে, ‘অচলায়তন’ শব্দও তার প্রমাণ। ‘অচলায়তন’ এখন বাংলা ভাষার বাগধারার অংশ এবং তা অন্ধ শাস্ত্রানুগত্য ও রক্ষণশীলতাকে বোঝায়। নাটকটি সম্পর্কে অধিকাংশ রবীন্দ্র-সমালোচকই একমত যে, এখানে হিন্দু-সমাজের রক্ষণশীলতাকে আঘাত করা হয়েছে এবং উদার ও মুক্ত একটি সমাজ গঠনের ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ নাটকে রবীন্দ্রনাথ রক্ষণশীলতা থেকে সমাজকে এবং প্রতিষ্ঠানিকতা থেকে ধর্মকে মুক্ত করে দেখার শুভবুদ্ধি থেকে চালিত হয়েছিলেন।
‘ডাকঘর’: রবীন্দ্রনাথের রূপক-সাংকেতিক নাটকগুলোর মধ্যে ‘ডাকঘর’ সর্বাধিক জনপ্রিয় নাটক। একটি সৌন্দর্যপিয়াসী, সুদূরবিলাসী চিত্তের আর্তি ও বেদনা নাটকখানির মধ্যে বাস্তব রূপ লাভ করেছে। অমল যেন রুদ্ধগৃহবাসী বালক রবীন্দ্রনাথেরই প্রতিরূপ। সৌন্দর্যময়, রহস্যময় বাহির শত লক্ষ বাহু প্রসার করে আকুল আহবান জানাচ্ছে- সেই আহবানে সাড়া দিয়ে অমল যেন বলে ওঠে-
“আমি চঞ্চল হে,
আমি সুদূরের পিয়াসী,
দিন চলে যায়, আমি আনমনে
তারি আশা চেয়ে থাকি বাতায়নে।”
অমলের আকুতি ও ব্যাকুলতার একটা গভীর তত্ত্বব্যঞ্জক হলেও শিশু-চরিত্রের কৌতূহলী রহস্যপ্রিয়তা তার ভূমিকাকে বিশেষ সরস করেছে। সে একদিকে মাধব, মোড়ল, কবিরাজ প্রভৃতির দ্বারা এবং অন্যদিকে ঠাকুরদা ও সুধার দ্বারা আকর্ষিত হয়েছে। এই সব চরিত্রের দ্বন্দ্বে নাটকখানি রূপকতত্ত্ব সত্ত্বেও যথেষ্ট নাট্যরসাত্মক হয়েছে।
‘মুক্তধারা’: রবীন্দ্রনাথের রূপক-সাংকেতিক নাটকের মধ্যে মুক্তধারা বিশেষ স্থান দখল করে আছে। নাট্যকার যান্ত্রিকতা এবং হিংসাত্মকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন এ নাটকে। যন্ত্র ও জীবনের সংঘাতই ‘মুক্তধারা’ নাটকের মুখ্য প্রাণবস্তু। এই দুই শক্তির রূপায়ণ হয়েছে বিভূতি ও অভিজিৎ চরিত্রে। এ নাটকে যন্ত্রশক্তির পাশাপাশি আরেকটি শক্তি প্রধান হয়ে উঠেছে তা হচ্ছে দেবশক্তি। যন্ত্র মানুষকে করেছে অবহেলা আর দেবতা করেছে অপমান- আর এ কারণেই মানুষ মুক্তধারা থেকে দূরে বন্দি হয়েছে অচলায়নে।
সুতরাং উপর্যুক্ত সার্বিক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, প্রগতিশীল চিন্তক নাট্যকার অন্তরবাস্তবতা ও দ্বন্দ্বময়তা এবং ভাষা ও সংলাপের নিপুণ চয়নে রূপক-সাংকেতিক নাটক-রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। আর এ কারণেই এ জাতীয় নাটকগুলোতে যেমন একটি ভিন্নবোধ লক্ষ করা যায়- তেমনি নাটকগুলো হয়ে উঠেছে সর্বাপেক্ষা সুসংহত, সর্বাপেক্ষা সুমিত এবং সর্বাধিক শিল্পোজ্জ্বল-সার্থক।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment