প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনে গ্রীক-রোমান বিবরণ:

গ্রীকবীর আলেকজাণ্ডারের উত্তর-পশ্চিম ভারতে অভিযানের উল্লেখ কোন ভারতীয় সাহিত্যে পাওয়া যায় না। মূলত গ্রীক লেখকদের মধ্যে তিনজন নিয়ারকাস, অ্যারিস্টোবুলাস এবং ওনেসিক্রিটাস আলেকজাণ্ডারের অভিযানের সঙ্গী ছিলেন। নিয়ারকাস সিন্ধু নদীর মোহনা থেকে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত পরিভ্রমণের একটি ভৌগোলিক বিবরণ লিখেছিলেন। তাঁর মূল পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় নি, তবে নিয়ারকাসের বিবরণীর কথা অ্যারিয়ান-এর লেখাতে পাওয়া যায়। অ্যারিস্টোবুলাস প্রায় আশি বছর বয়সকালে বিবরণী লিখেছিলেন। নিজে ভূগোলবিদ হলেও, স্মৃতিভ্রষ্টতার কারণে তাঁর রচনায় ভূলভ্রান্তি থাকার সম্ভাবনা আছে। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের শেষে ভারতবর্ষ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় মেগাস্থিনিসের ‘ইণ্ডিকা’ গ্রন্থে। এক্ষেত্রেও মূল গ্রন্থটি পাওয়া যায় নি। তবে উত্তরকালের একাধিক লেখক যেমন স্ট্রাবো, ডায়োডোরাস, অ্যারিয়ান প্রমুখের রচনায় ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থের উল্লেখ আছে। স্ট্র্যাবো’র ভূগোল, ডায়োডোরাসের বিবলিওথেকা হিস্টারিকা’ (ইতিহাসের গ্রন্থাগার), অ্যারিয়ানের ‘আনাবাসিস’ (অভিযান) গ্রন্থে বার বার মেগাস্থিনিসের গ্রন্থের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যর দরবারে আগত গ্রীক দূত মেগাস্থিনিসের বিবরণের নিরিখে সমকালীন ভারতের সমাজ, রাজনীতি, জাতি ভেদাভেদ, দাসপ্রথা, পাটলিপুত্র রাজপ্রাসাদের অভূতপূর্ব শিল্পসুষমা ইত্যাদির ধারণা পাওয়া যায়। অবশ্য ভাষাগত ও কৃষ্টিগত তারতম্যের কারণে মেগাস্থিনিস বহু ক্ষেত্রে প্রকৃত অবস্থার ভুল ব্যাখ্যা করেছেন। মৌর্য পরবর্তী যুগের সূত্র হিসেবে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে পলিবিয়াস-এর লেখা ‘জেনারেল হিস্ট্রি’ বইটি। এখান থেকে ব্যাকট্রিয় গ্রীকদের বহু তথ্য পাওয়া যায়।

খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের শেষ দিকে এক অজ্ঞাতনামা গ্রীক লেখক পেরিপ্লাস অফ দি ইরিথ্রিয়ান সী (Periplus tes Erythrun Thalasses) নামক গুরুত্বপূর্ণ একটি বই লেখেন। লেখক তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে এটি লেখেন। বাণিজ্য উপলক্ষ্যে লেখক বহুবার ভারতের পশ্চিম উপকূলে এসেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি ভারতের বন্দর, পোতাশ্রয়, প্রাকৃতিক সম্পদ, বৈদেশিক বাণিজ্য ইত্যাদির এক বিশ্বস্ত চিত্র তুলে ধরেছেন। ভৃগুচ্ছ থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত ভারতের পশ্চিম উপকূলের নির্ভরযোগ্য বিবরণ হিসেবে পেরিপ্লাস গ্রন্থের গুরুত্ব স্বীকৃত। ক্লডিয়াস টলেমি’র ভূগোল গ্রন্থটিও (২য় শতক) গুরুত্বপূর্ণ। তবে অপ্রধান উপাদান থেকে রচনার কারণে বইটির বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন হয়েছে। ত্রিকোণাকৃতি ভারতীয় উপমহাদেশ টলেমির ভূগোলে প্রায় আয়তাকার হয়ে গেছে। রোমান লেখকদের মধ্যে স্মরণীয় হলেন প্লিনি, প্লুটার্ক, জনকুইন্টাস প্রমুখ। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে প্লিনির লেখা ‘ন্যাচারাল হিস্ট্রি’, কুইন্টাস কার্টিয়াসের ‘আলেকজাণ্ডারের ইতিহাস’ গুরুত্বপূর্ণ। গ্রীক-রোমান (ল্যাটিন) রচনায় বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকলেও, ভারতীয় ভাষা, সমাজব্যবস্থা সম্বন্ধে অজ্ঞতার কারণে বহু ক্ষেত্রে কল্পনাশ্রিত বা অতিরঞ্জিত হয়েছে।

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনে চৈনিক বিবরণ :

খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে চীনদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচার শুরু হলে বহু চৈনিক পরিব্রাজক ভারত পরিভ্রমণে আসেন। এঁদের কেউ কেউ ভারতে অভিজ্ঞতার কথা লিপিবদ্ধ করেছেন, যা ভারতে সমাজ, সংস্কৃতি অনুধাবনে সহায়ক হয়। প্রাচীন ভারতের প্রথম দিকের ইতিহাস পুনর্গঠনের জন্য গ্রীকদের রচনা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি শেষের দিকের তথ্যাদির জন্য চৈনিক পরিব্রাজকদের বিবরণগুলি বিশেষ সহায়ক। মৌর্যোত্তরকালের ইতিহাস পুনর্গঠনের কাজে চৈনিক বিবরণ গুরত্বপূর্ণ। চৈনিক পর্যটকদের মধ্যে নিঃসন্দেহে অগ্রগণ্য ব্যক্তি ফা-হিয়েন। ৩৯৯ থেকে ৪১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ভারতের বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণকালে উত্তর-পশ্চিম ভারত এবং মধ্য ভারত অতিক্রম করে তিনি গাঙ্গেয় উপত্যকা পর্যন্ত এসেছিলেন। ফিরেছিলেন সমুদ্রপথে। ভারতের অভিজ্ঞতা তিনি তাঁর ‘ফো-কুয়ো-কি’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন। পাটলিপুত্র নগরে প্রায় ছয় বছর অবস্থান করেছিলেন। তবে তিনি মূলত বৌদ্ধধর্মের সাথে যুক্ত স্থান ও ঘটনাবলীর কথা উল্লেখ করেছেন। চৈনিক পরিব্রাজকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী সময় ভারতে ছিলেন হিউয়েন সাঙ । প্রায় ষোল বছর (৬২৯-৬৪৫ খ্রিঃ) ভারতে অবস্থানকালে তিনি প্রায় সারা ভারত পরিভ্রমণ করেন। বৌদ্ধমঠ ও সন্ন্যাসীদের জীবনচর্চা এবং বৌদ্ধ দর্শন সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা ছিল তাঁর প্রধান লক্ষ্য। তবে বৌদ্ধধর্ম ছাড়াও তৎকালীন ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা, সমাজ, সংস্কৃতি, জলবায়ু সম্পর্কেও তিনি অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর ‘সি-ইউ-কি’ (পশ্চিমদেশের স্মৃতি) নামক ভ্রমণবৃত্তান্তে। পুষ্যভূতি বংশীয় রাজা হর্ষবর্ধনের রাজত্ব ও জীবনচর্চার নানাদিক তিনি এই গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। তবে সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, হিউয়েন সাঙ তাঁর রচনায় হর্ষবর্ধনের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেছেন। সপ্তম শতকের শেষদিকে ভারতে আগত ই-সিং (৬৭১-৬৯৫ খ্রিঃ)-এর বিবরণী থেকে তৎকালীন বৌদ্ধধর্ম ও সংঘ সম্পর্কে বহু তথ্য পাওয়া যায়। তিনি সংস্কৃত সাহিত্যের বিষয়েও আলোকপাত করেছেন। অষ্টম শতকের অপর এক পরিব্রাজক হুই চাও (৭২০ খ্রিঃ) তাঁর লেখায় কনৌজের যশোবর্ধন এবং কাশ্মীরের মুক্তাপীড় সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়েছেন।

গ্রীক রচনার সাথে চৈনিক রচনাগুলির একটি মৌলিক পার্থক্য হল, যে গ্রীক লেখকদের অনেকেই শোনা কাহিনীর ভিত্তিতে ভারত বিষয়ে নিবন্ধ লিখেছেন। কিন্তু চৈনিক লেখকদের সকলেই ভারত-ভ্রমণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে ভারত সম্পর্কে বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। ভারতীয় ভাষা ও কৃষ্টি সম্পর্কেও তাঁরা অবহিত হতে আন্তরিক ছিলেন। কিন্তু তাঁদের কাছে ভারতবর্ষ ছিল তীর্থক্ষেত্র, বৌদ্ধধর্মের পীঠস্থান। তাই ধর্মভাবনা ও ধর্মজীবন, নির্দিষ্টভাবে বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কেই তাঁদের আগ্রহ ছিল বেশী। রাষ্ট্রবিষয়ে অনীহা এবং পক্ষপাতিত্ব ইতিহাসের উপাদান হিসেবে তাঁদের বৃত্তান্তগুলিকে দুর্বল করে রেখেছে। তবে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস পুনর্গঠনের কাজে চৈনিক বিবরণগুলির অবদান অবশ্যই স্বীকার্য। এই প্রসঙ্গে তিব্বতীয় পণ্ডিত লামা তারানাথের ‘ভারতে বৌদ্ধধর্মের জন্ম’ গ্রন্থটি স্মরণীয়। এই গ্রন্থে তিনি অজাতশত্রুর সময় থেকে মগধে মুকুন্দদেবের সময় পর্যন্ত ঘটনাবলী উল্লেখ করেছেন। বাংলার পালরাজাদের বিষয়েও কিছু তথ্য এই বই থেকে পাওয়া যায়।

অষ্টম শতকে মহম্মদ বিন কাশিমের সিন্ধুদেশ বিজয়ের সূত্রে আরবদেশের সাথে ভারতের যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। প্রাচীন ও আদি মধ্যযুগের ইতিহাস পুনর্গঠনের দিক থেকে ঘটনাটি গুরুত্বপূর্ণ। অতঃপর নবম শতক থেকে আরবী-ফার্সী রচনায় ভারতের প্রসঙ্গ গুরুত্ব পেতে থাকে। এই সকল রচনায় সন-তারিখ উল্লেখিত হওয়ায় ইতিহাসগতভাবে এগুলি পৃথক গুরুত্ব দাবি করে। মহম্মদ বিন কাশিমের সিন্ধু অভিযানের বিবরণ পাওয়া যায় ‘চাচ্‌নামা’ গ্রন্থে এবং অল-বিলাদুরি’র রচনায়। ৮৫১ খ্রিস্টাব্দে সুলেমান বণিক হিসেবে ভারতে এসে ভারতের রাজনৈতিক বিভাজন এবং প্রধান প্রধান রাজবংশগুলি সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। ইবন খুরদাদবা’র লেখায় ভারতে জাতিভেদ প্রথার উল্লেখ দেখা যায়। অল মাসুদি মহীপালের রাজত্বকালে প্রতিহার রাজ্যে এসেছিলেন (৯১৫ খ্রিঃ)। তাঁর রচনায় প্রতিহার-রাজের ঘোড়া ও উটের বিশাল সংগ্রহের তথ্য জানা যায়। আল ইন্ত্রিসির বিবরণে (দশম শতক) পশ্চিমে সমুদ্র উপকূলের বন্দর ও শহরগুলির বিবরণ পাওয়া যায়। আবুল কাশেম লিখিত ‘তবকত্‌-অল-উমাস্’ গ্রন্থে প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞানচর্চার সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাওয়া যায়। এছাড়া শাহরিয়ার (৯০০ খ্রিঃ), ইবন রুস্তা (৯০২-৩ খ্রিঃ), ইবন নাজিম (৯৯৫ খ্রিঃ) প্রমুখ ভারতবর্ষ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। অজ্ঞাত লেখকের পারসিক গ্রন্থ ‘হুড্‌ড্-অল-আলম’ (৯৮২ খ্রিঃ) থেকে ভারতীয় ভূখণ্ড ও ভারতের নানা বন্দর/শহর সম্পর্কে জানা যায়। তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী তথ্যসমৃদ্ধ, নিরপেক্ষ ও অন্তর্দৃষ্টিমূলক রচনা পাওয়া যায় আরবীয় পণ্ডিত অলবেরুনির ‘কিতাব-উল-হিন্দ’ গ্রন্থে। বিজ্ঞানমনস্ক এবং সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত অলবেরুনি সংকীর্ণ ধর্মীয় সংস্কার বা পক্ষপাতিত্বমূলক সাহিত্য সৃষ্টির বিরোধী ছিলেন। ১০৩০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এই গ্রন্থ থেকে তৎকালীন ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু ধর্ম ও সমাজব্যবস্থার কথা জানা যায়। তবে ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি প্রায় সম্পূর্ণ উদাসীনতা দেখিয়েছেন।

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসচর্চার কাজ নিঃসন্দেহে কঠিন। কারণ নির্ভরযোগ্য একক তথ্যসূত্রের অভাব। সাধারণভাবে প্রাচীন ইতিহাস পুনর্গঠন বা পুনরুদ্ধারের জন্য স্বীকৃত দু’টি প্রধান উপাদান প্রত্নলেখ এবং সাহিত্যের ওপর নির্ভর করতেই হবে। তবে তুলনামূলকভাবে এই দু’টি উপাদানের গুরুত্বের মধ্যে প্রভেদ আছে। সাহিত্যিক সূত্র বিপুল ও বৈচিত্র্যময় হলেও, সেগুলির প্রায় সবগুলিই সহজাত সীমাবদ্ধতা দ্বারা আকীর্ণ। দেশীয় বা বৈদেশিক উভয় সাহিত্যেই দুর্বলতাগুলি বর্তমান। দেশীয় সাহিত্যের বিরাট একটি অংশ ধর্মীয় গ্রন্থ। এদের রচয়িতা বা সংকলক মূলত ব্রাহ্মণ শ্রেণী। স্বভাবতই আদিপর্বের এই সকল সাহিত্যে (ধর্মশাস্ত্র, ধর্মসূত্র ইত্যাদি) বর্ণভেদ ব্যবস্থার কুফলগুলি সঠিকভাবে উল্লিখিত বা মূল্যায়িত হয়নি। কারণ বর্ণভেদাভেদের উদ্গাতা ব্রাহ্মণশ্রেণী এবং এই ব্যবস্থায় তারাই বিশেষ সুবিধা ও অধিকার ভোগ করতে পারতেন। বর্ণভেদ থেকে জাতিভেদ প্রথার উত্তরণের ক্ষেত্রেও এ-কথা সত্য। জাতিভেদ ব্যবস্থা সামাজিক ঐক্যের পরিপন্থী এবং সার্বিক উন্নয়নের বিরোধী, এই সত্য প্রাচীন সাহিত্যে স্বীকৃত হয়নি। পুরাণ গ্রন্থ, জাতকের কাহিনী ইত্যাদি বহু সাহিত্য পরবর্তীকালের রচনা। লোকমুখে প্রচারিত কাহিনী এগুলিতে স্থান পেয়েছে। স্বভাবতই প্রকৃত ঘটনা বহুক্ষেত্রেই কল্পনার ছায়ায় আড়াল হয়ে গেছে। লেখকের ব্যক্তিগত বিশ্বাস অতীতের ঘটনা হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। এই প্রক্ষিপ্তকরণ প্রাচীন রচনাগুলিকে ইতিহাসের সূত্র হিসেবে দুর্বল করেছে। জীবনীসাহিত্যের ক্ষেত্রে শক্তিশালী বা ধনী পৃষ্ঠপোষকের গুণকীর্তনের প্রবণতা থাকা স্বাভাবিক। রাজকীয় জীবনচরিতগুলিতে রাজাকে এবং তাঁর কর্মধারাকে মহত্তমরূপে তুলে ধরার প্রয়াস, এদের ইতিহাসমূল্য ক্ষুণ্ণ করেছে। বানভট্টের ‘হর্ষচরিত’ কিংবা সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’ বিশ্লেষণ করলে এই অভিযোগের সত্যতা স্পষ্ট হয়।

বৈদেশিক সাহিত্যসূত্রের সমস্যা কিছুটা স্বতন্ত্র। সেগুলি অধিকাংশই সমকালে লিখিত এবং লেখকরা প্রায়শই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু বিদেশী রচনাগুলিও ইতিহাসের সূত্র হিসেবে ত্রুটীমুক্ত নয়। বিদেশী লেখকরা ভারতীয় ভাষা এবং কৃষ্টি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। অলবেরুনি একটি ব্যতিক্রম। স্বভাবতই ভারতীয় সমাজ, ধর্মভাবনা ইত্যাদি সম্পর্কে তাঁরা বহু ক্ষেত্রেই ভুল ধারণার শিকার হয়েছেন। ভারতীয় কৃষ্টিকে তাঁরা নিজ নিজ কৃষ্টির কষ্টিপাথরে যাচাই করতে গিয়ে অনেক সময় ভ্রান্তভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। অবশ্য বিদেশী সাহিত্যে বহু ক্ষেত্রে সন, তারিখ উল্লেখ থাকায়, তার গ্রহণযোগ্যতা বেশী ছিল।

তুলনামূলক বিচারে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের গুরুত্ব কিছুটা বেশী। প্রাচীন ভারত-ইতিহাসের একটা পর্যায়ের কোন উল্লেখ সাহিত্যে পাওয়া যায় না। প্রাগৈতিহাসিক ভারতবর্ষের ইতিহাস পুনরুদ্ধারের একমাত্র মাধ্যম হল প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী। ভারতে আদিম মানবসভ্যতার সূচনা, বিকাশ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত সময়ের ইতিহাসের সাক্ষ্য একমাত্র প্রত্নতত্ত্ব থেকেই উদ্ধার করা যায়। বিজ্ঞানের বিবিধ শাখা যেমন—নৃতত্ত্ব, ভূতত্ত্ব, উদ্ভিদবিদ্যা, কার্বন-১৪ পরীক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলিকে সঠিকভাবে যাচাই করে নেওয়া সম্ভব হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানে প্রক্ষিপ্তকরণ সম্ভব নয়। যেমন গুপ্তযুগের অন্তিমপর্বের মুদ্রায় অতিরিক্ত খাদের ভিত্তিতে বোঝা সম্ভব যে তখন সোনার যোগানে ঘাটতি দেখা দিয়েছিল এবং বাণিজ্যিক লেনদেন নিম্নগামী হয়েছিল। ভূমিদান ব্যবস্থা (অগ্রহার ও অন্যান্য) যে ভারতের আর্থ-সামাজিক জীবনে ব্যাপক রূপান্তর এনেছিল, সেই ঘটনার প্রধান সাক্ষ্য হল অসংখ্য তাম্রশাসন। কেবল সাহিত্যসূত্র থেকে এত বড় রূপান্তরের ইতিহাস পুনর্গঠন সম্ভব ছিল না। বলাবাহুল্য, প্রত্নতাত্ত্বিক সূত্র সম্পূর্ণ ত্রুটীমুক্ত নয়। এক্ষেত্রেও ইতিহাস পুনর্গঠনের সময় সাবধানতা অবলম্বন করা আবশ্যিক।

সামগ্রিকভাবে বলা যায় যে, প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনের কাজে প্রত্নতত্ত্ব এবং সাহিত্য উপাদান, উভয়েরই প্রয়োজন আছে। এদের একটি অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, পরস্তু পরিপূরক। একটি তথ্যকে অপর সূত্র দ্বারা যাচাই করে নিতে পারলে ইতিহাস রচনায় প্রকৃত সত্যের কাছাকাছি পৌঁছানো সহজ ও সম্ভব হয়।