প্রশ্নঃ নৈতিক প্রগতির শর্তাবলি লিখ। নৈতিক প্রগতি অর্জন কি সম্ভব? আলোচনা কর। 

অথবা, নৈতিক প্রগতির শর্তাবলি ব্যাখ্যা কর।

অথবা, নৈতিক প্রগতির সম্ভাব্যতা লিখ৷

ভূমিকাঃ প্রত্যেক মানুষের জীবনে একটি লক্ষ্য থাকে। যে লক্ষ্যকে উদ্দেশ্য করে ব্যক্তি সামনে এগিয়ে যায় এবং লক্ষ অর্জনের জন্য অক্লান্ত কাজ করে যায়। এ লক্ষ অর্জনই হলো তার জীবনের নৈতিক আদর্শ। আর এটিই মানুষকে ধীরে ধীরে নৈতিক অগ্রগতির দিকে নিয়ে যায়।

নৈতিক প্রগতির শর্তাবলিঃ নীতিবিদ ম্যাকেঞ্জির মতে নৈতিক প্রগতির তিনটি শর্ত রয়েছে। যথা- ১. নৈতিক জগৎ, ২. নৈতিক জগতের অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও ৩. অপূর্ণতার উপলব্ধি।

১. নৈতিক জগৎঃ মানুষ সামাজিক জীব এবং সে সমাজে বাস করে। প্রত্যেকটি সমাজেই এক একটি নৈতিক জগৎ থাকে। যেখানে নৈতিক আদর্শ এবং নানা ধরনের বিধি নিষেধ ক্রিয়াশীল থাকে। এ নৈতিক আদর্শ ও বিধি নিষেধ প্রকাশ পায় সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও মানুষের অভ্যাসের মাধ্যমে। কোনো কোনো সমাজের নৈতিক আদর্শ ঐ সমাজের প্রতিষ্ঠান ও মানুষের অভ্যাসের সাথে অসংগতও হতে পারে। তখন নৈতিক আদর্শ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়।

২. নৈতিক জগতের অভ্যন্তরীণ বিরোধঃ যখন সমাজের নৈতিক আদর্শ সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও মানুষের অভ্যাসের অসংগতি দেখা দেয়। তখন এগুলোর মধ্যে সংগতি স্থাপন করা জরুরি হয়ে পড়ে। তখন নৈতিকতার অগ্রগতির প্রয়োজন হয়ে পড়ে এবং তখন সমাজে নৈতিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয়।

৩. অপূর্ণতার উপলব্ধিঃ সমাজের বিভিন্ন নৈতিক উপাদানের মধ্যে অন্তঃবিরোধই যে শুধু নৈতিক প্রগতিকে ত্বরান্বিত করবে এমনটা নয়। বরং কখনো কখনো নৈতিক অপূর্ণতার উপলব্ধিও নৈতিক প্রগতিকে ত্বরান্বিত করে।

নৈতিক প্রগতির সম্ভাব্যতাঃ মানুষের জীবনে নৈতিক প্রগতি অর্জন সম্ভব কি-না, সে সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলোঃ 

১. নীতি বিরোধের চাহিদা বৃদ্ধিঃ বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কারের ফলে মানুষের জীবন যেমন সহজ হয়েছে তেমনি মানুষের নীতিবোধ দুর্বল হয়ে পড়েছে। বর্তমান সমাজকে তাই সমাজবিজ্ঞানী উলরিস বেক (Ulric Beck) ‘Risk Society’ বলে সম্পাদন করেছেন। তাই সকল ক্ষেত্রে এখন নৈতিক শিক্ষার উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এই গুরুত্ববোধই নৈতিক প্রগতি অর্জনের প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

২. শিক্ষার ক্রমোন্নতিঃ বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। মানুষের উদ্ভাবনের পরিসীমাও বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া নৈতিক শিক্ষার প্রসার ও পঠন পাঠন বৃদ্ধি পাওয়ায় নৈতিক প্রগতি অর্জনের সম্ভাব্যতাও বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।

৩. নৈতিক উৎকর্ষের ধীর গতিতে বৃদ্ধিঃ নৈতিক প্রগতির উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পায় ধীরে ধীরে এবং স্তরে স্তরে। নৈতিক প্রগতির উৎকর্ষের সাথে সাথে মানুষ নিজেকে ছাড়িয়ে পুরো সমাজ তথা পৃথিবীর কল্যাণের কথাও ভাবতে শুরু করে। সুতরাং নৈতিক প্রগতির উৎকর্ষের হার ধীর হলেও তা অর্জন করা অসম্ভব নয়।

৪. আত্মসচেতনতা ও বিচার-বিবেচনা করার শক্তি বৃদ্ধিঃ বর্তমানে মানুষ পূর্বের যে কোনো সময়ের তুলায় বেশি আত্মসচেতন হয়েছে। মানুষের বুদ্ধি তথা বিচার বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা বাড়ছে। তাই নৈতিক প্রগতি অর্জনের সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

৫. নৈতিক প্রগতি মানুষের নৈতিক আদর্শ সম্পর্কিত জ্ঞানকে স্পষ্ট করেঃ বর্তমানে মানুষকে সকল ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এভাবে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জন করতে গিয়ে মানুষ নৈতিকতা সম্পর্কিত জ্ঞানের অভাববোধ করে। এ অভাববোধই মানুষকে নৈতিকতা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করে। সুতরাং প্রতিনিয়তই নৈতিক প্রগতির দ্বার খুলছে।

উপসংহারঃ উপরোক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, নীতিবিদ্যায় অন্যতম আলোচ্য বিষয় হলো নৈতিক প্রগতি। যদিও এটি একটি ধীর প্রক্রিয়া। তথাপি মানবজীবনে এর গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমানে আধুনিক যুগে নৈতিক অবক্ষয় রোধ করার জন্য নৈতিক শিক্ষার চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই এখন একথা বলা যায় যে, নৈতিক প্রগতি অবশ্যই সম্ভব।