বাংলা ছোটগল্প রচনায় কাজী নজরুল ইসলামের অবদান

কাজী নজরুল ইসলাম [১৮৯৯-১৯৭৬] বাংলা কবিতার ধারায় যতটা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন তা ছোটো গল্পকার হিসেবে ততটা অবদান রাখতে পারেননি। তাঁর রচিত গল্পগুলোতে সমাজচিত্র অনুপস্থিত এবং মানুষের জীবন সংকটের প্রকাশ নেই। গল্পগুলোতে পাকাপোক্ত Plot নেই মাঝে মাঝে ক্ষীণ রেখা ফুটে উঠেছে। মূলত গল্পগুলোতে একজন আবেগী কবি প্রেমের ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরেছেন। তবে মানবীর প্রেম তথা নর-নারীর মনোময় হৃদয়বৃত্তির বর্ণাঢ্য
উল্লাসে নজরুল ইসলামের ছোটোগল্পগুলোতে উজ্জ্বল।

কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সাহিত্যিক জীবনে মাত্র তিনখানি গল্পগ্রন্থে ‘ব্যাথার দান’ ১৯১২, ‘রিক্তের বেদন’ ১৯২৪, ‘শিউলিমালা’ ১৯৩১.  আঠারোটি ছোটোগল্প রচনা করেছিলেন। পৃথক পৃথক গ্রন্থে গল্পগুলো গ্রন্থিত হলেও তাঁর প্রতিটি গল্পের সুর যেন এক। সব গল্পের মূলেই রয়েছে অকথিত এক ব্যথার কাহিনি, প্রত্যেকটি গল্পই যেন আন্তরিক বেদনার রক্তে রঙিন। তন্মধ্যে ‘রিক্তের বেদন’ গল্পগ্রন্থটিকে বেদনাময় উপাখ্যানের সমাহার বলা যায়।

‘রিক্তের বেদন’ গল্পগ্রন্থে মোট আটটি গল্প আছে। প্রথম গল্প ‘রিক্তের বেদন’ এ অচরিতার্থ মানবীয় প্রেমের এক বেদনাময় ইতিবৃত্ত অঙ্কিত হয়েছে। কর্মের আহবানে বহির্গত যুবক হাসিন তার প্রেমাস্পদা শহিদার প্রেমকে উপেক্ষা করে যুদ্ধে গিয়ে সেখানে এক বেদুইন রমণী গুলের প্রতি প্রেমাসক্ত হয়। গল্পে প্রেম অপেক্ষা কর্তব্য অনেক বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছে। যখন গুল একজন সাস্ত্রীকে হত্যা করে তার রাইফেল নিয়ে পালাতে চেষ্টা করেছে, তখন হাসিনই সৈনিকের কর্তব্যবোধে পিস্তলের গুলিতে তার জীবননাট্যের যবনিকা টেনে দিয়েছে। যুদ্ধভূমির পটভূমিকায় মুমূর্ষু গুলের সঙ্গে হাসিনের শেষ মিলন বড়ো করুণ, বড়ো মধুর। গল্পটির মধ্যে মানব প্রেমের একটি বেদনাদীপ্ত রূপ প্রস্ফুটিত।

“ছুটে গিয়ে গুলের এলিয়ে পড়া দেহলতা আমার চির তৃষিত অতৃপ্ত বুকে বিপুল বলে চেপে ধরলুম। তারপর তার বেদনাঙ্কুরিত ওষ্ঠধরে আমার পিপাসী ওষ্ঠ নিবিড়ভাবে সংলগ্ন করে আর্ত-কণ্ঠে ডাকলুম, গুল-গুল-গুল। … অনেকক্ষণ পরে সে আস্তে চোখ খুলে আমার মুখের পানে চেয়েই চোখ বুজে বললে, “এই আশেকের” হাতে “মাশুকের” মরণ বড় বাঞ্ছনীয় আর মধুর নয় হাসিন।”

‘বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী’ গল্পে বাঙালি পল্টনের একটি বখাটে যুবক, যে বাগদাদে গিয়ে মারা পড়ে, নেশার ঝোঁকে তার আত্মস্মৃতি রোমন্থনের বৃত্তান্ত। এ কাহিনিতে গল্পকারের ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিফলন ঘটেছে বলে অনেকে মনে করেন। এ গল্পের নায়ক তার প্রেয়সী রাবেয়া এবং সখিনার বেদনাময় ইতিহাসের কথা তুলে ধরেছেন।

“সখিনা আমার নিষ্ঠুর উপহাস করে অজানার রাজ্যে চলে গেছে, মরবার সময়ও নাকি, হতভাগিনী আমার মত পাপিষ্ঠের চরণ ধুলোর জন্য কেঁদেছে, আমার ছেঁড়া পুরানো একটা ফটো বুকে ধরে মরেছে।”

‘মেহের নেগার’ গল্পে মুসলমান যুবক ইয়ুসুফের সঙ্গে মেহের নেগার ও গুলশানের প্রণয় কাহিনি কাব্যময় ভাষার আন্তরিকতার সঙ্গে চিত্রিত। নায়িকা গুলশান রূপোজীবনীর কন্যা। গল্পের নায়ক ইয়ুসুফ ভবঘুরে যুবক, নায়িকা গুলশানের মধ্যে সে প্রত্যক্ষ করে তার স্বপ্নপ্রিয়া মেহের নিগারকে। কিন্তু দুজনের মিলনের পথে দুর্লঙ্ঘ্য বাধার সৃষ্টি করে গুলশানের অশুচি জন্ম পরিচয়। সে বাঈজীর মেয়ে। এই সমাজ বিকৃত আত্মপরিচয়ের গ্লানি বহনে অক্ষম গুলশান শেষ পর্যন্ত আত্মহনন করে। গুলশানের কবরে নির্মম ফলকে লেখা থাকে-

“অপবিত্র জঠরে জন্ম নিলেও, ওগো পথিক, আমায় ঘৃণা করো না। এক বিন্দু অশ্রু ফেলো আমার কল্যাণ কামনা করে। আমি অপবিত্র কিনা জানি না, কিন্তু পবিত্র ভালোবাসা আমার এই বুকে তার পরশ দিয়েছিল।”

‘সাঝের তারা’ গল্পে আরব সাগর তীরে সাঝের বেলায় একটি ছোট্ট পাহাড়ের উপর ‘সাঝের তারার প্রিয়ার মধ্যে কবি মানস প্রিয়ার সন্ধান করেছেন এবং তার বধূ হলো ‘অস্তপারের সন্ধ্যালক্ষ্মী’। এর সাথে ‘ছায়ানট’ কাব্যের ‘সন্ধ্যাতারা’ কবিতার সাদৃশ্য লক্ষণীয়। ‘অস্তপারের সন্ধ্যা-লক্ষ্মী’ সাঁজের তারার সঙ্গে মানব মনের প্রণয় কাহিনিকেই লেখক বেদনার্দ্র ভাষায় জীবন্ত করে তুলেছেন।

“ভাবীজানের ডাগর আঁখি পল্লব সিক্ত হয়ে উঠলো, দৃষ্টিটুকু অব্যক্ত ব্যথায় নত হয়ে এলো। কালো সন্ধ্যা নিবিড় হয়ে নেমে এলো।”

‘রাক্ষুসী’ ও ‘স্বামীহারা’ গল্প দুটিতে দুটি নারীর যন্ত্রণাবিদ্ধ আত্মকাহিনী বিবৃত হয়েছে।
‘স্বামীহারা’ গল্পে আজিজ ও বেগমের আবেগময় দাম্পত্য জীবন এবং কলেরায় আজিজের মৃত্যুর পরও বেগমের একনিষ্ঠ স্বামী প্রেম কাব্যময় ভাষায় চিত্রিত হয়েছে। উত্তম পুরুষে উক্ত এগল্পে কারুণ্য ও পরিজন হারানোর বেদনা গভীর লালিত্যে বর্ণিত হয়েছে।

‘রাক্ষুসী’ গল্পে এক বাগদাদী (বিন্দি) নারীর নিপীড়িত জীবন যন্ত্রণার ইতিবৃত্ত বর্ণিত হয়েছে। বিন্দির স্বামী অন্য নারীতে আসক্ত হলে বাগদাদী নারীটি তার স্বামীকে খুন করে এবং বিচারে তার সাত বছরের জেল হয়। জেলের সাজা শেষে গ্রামে ফিরে গেলে গ্রামের মানুষ তাকে রাক্ষুসী আখ্যা দেয় এবং তার সঙ্গ পরিত্যাগ করে।

“রিক্তের বেদন” গল্পগ্রন্থের ‘সালেক’ এবং ‘দুরন্ত পথিক’ গল্প দুটি একটু ভিন্নধর্মী গল্প। ‘খালেক’ গল্পটিতে ‘লিপিকার’ প্রভাব বিদ্যমান গভীরভাবে এবং গল্পে দেখানো হয়েছে যে, মর্ত্যপ্রেম নয় অধ্যাত্ম প্রেমই রূপ লাভ করে। ‘দুরন্ত পথিক’ গল্পটি মূলত কথিকা, এ কথিকায় মানবাত্মার শাশ্বত সত্যের পথে এক মুক্তদেশের উদ্বোধন বাঁশির সুর ধরে চিরযৌবনের প্রতীক এক দুরন্ত পথিকের জয়যাত্রার ইতিহাস কীর্তিতে।

সুতরাং উপর্যুক্ত সার্বিক আলোচনা থেকে বলা যায়- বাংলা ছোটোগল্পে কাজী নজরুল ইসলামও বিশেষ অবদান রেখে গেছেন- যদিও তাঁর রচিত গল্পে ভাবাবেগের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়- তারপরেও তাঁর অধিকাংশ গল্প শিল্পসার্থক হিসেবে বিশেষভাবে চিহ্নিত।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।

Rate this post