প্রশ্নঃ সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ বর্ণনা কর।

সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্যঃ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অধিকার ভোগের বিনিময়ে নাগরিককে বেশ কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। একজন নাগরিক যখনই কোনো অধিকার ভোগ করতে চায় তখনই এর সাথে কিছু কিছু কর্তব্য পালনের বিষয়ও চলে আসে। অধিকার ও কর্তব্য সমাজবোধ থেকে এসেছে।

সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে শুধু সরকারকেই সচেষ্ট হতে হবে তা নয়। এজন্য নাগরিকেরও অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। কেননা কর্তব্যবিমুখ জাতি কখনো উন্নতি লাভ করতে পারে না, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে না।

সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিম্নরূপঃ

১. সামাজিক দায়িত্ব পালন (To Perform Social Duties): সুশাসন প্রতিষ্ঠার ভিত্তিভূমি গড়ে ওঠে নাগরিকের সামাজিক দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে। এগুলো হলো- সামাজিক সম্প্রীতি গড়ে তোলা এবং তা বজায় রাখা, সামাজিক প্রতিষ্ঠান গঠন বা নির্মাণ এবং তা পরিচালনা করা, সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজন এবং এতে অংশগ্রহণ করা, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা, সমাজে বসবাসকারী মানুষকে কুসংস্কার মুক্ত, পরমতসহিষ্ণু ও সংস্কৃতিবান করে গড়ে তোলা ইত্যাদি হলো নাগরিকের সামাজিক দায়িত্ব।

২. রাষ্ট্রের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রদর্শন (Unconditional allegiance to the State): রাষ্ট্রের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রদর্শন করা সকল নাগরিকের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য। রাষ্ট্রের আদেশ ও নির্দেশ মেনে চলতে হবে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য প্রত্যেক নাগরিককে চরম ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থের জন্য ব্যক্তির ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দিতে হবে।

৩. আইন মান্য করা (Obedience to Law): রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন মেনে চলা প্রত্যেক নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। আইন তৈরি হয় রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষা ও উন্নততর সমাজজীবন প্রতিষ্ঠার জন্য। আইন অমান্য করলে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষা কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা বাধাগ্রস্ত হয়। আইন শুধু নিজে মানলেই হবে না, অন্যেরাও যেন আইন মেনে চলে সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

৪. সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচন (Selection of honest and qualified leadership): নির্বাচনে ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে সততা ও বিজ্ঞতার সাথে যোগ্য ও উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচিত করা উচিত। সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচিত হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে।

৫. নিয়মিত কর প্রদান (Regular Payment of Taxes): রাষ্ট্র নাগরিকদের ওপর বিভিন্ন ধরনের কর আরোপ করে। কর থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে রাষ্ট্রীয় কাজ সুসম্পন্ন হয়। নাগরিকগণ যদি স্বেচ্ছায় যথাসময়ে কর প্রদান না করে তাহলে রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে এবং সুশাসন বাধাগ্রস্ত হবে।

৬. রাষ্ট্রের সেবা করা (Public Service): রাষ্ট্রের সেবা করা, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে এবং রাষ্ট্রকর্তৃক প্রদত্ত অবৈতনিক দায়িত্ব পালন, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জনগণের সেবা করা, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে যে কোনো রাষ্ট্রীয় কাজে সহায়তা করা, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রকে সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করা নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব।

৭. সন্তানদের শিক্ষাদান (To Educate the Children): শিক্ষা ব্যতীত নাগরিক ও মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটে না। শিক্ষা নাগরিককে কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে সচেতন করে। উপযুক্ত শিক্ষা সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে। পিতামাতার উচিত সন্তানকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত এবং কুসংস্কার মুক্ত, পরমতসহিষ্ণু ও সংস্কৃতিবান করে গড়ে তোলা, যেন তারা বড় হয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় উপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে পারে।

৮. রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ (Participation in Development Activities): জনগণের জন্যই রাষ্ট্র। কাজেই রাষ্ট্রের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জনগণকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে। যে কোনো দুর্যোগে, আপদে- বিপদে জনগণকে তা মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।

৯. জাতীয় সম্পদ রক্ষা (Protect Public Property): রাষ্ট্রের সকল সম্পদই জনগণের সম্পদ (Public Property)। কাজেই জন সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব পালন করতে হবে জনগণকেই। হরতালের সময় আবেগবশত কিংবা দুষ্কৃতিকারী ও অসৎ নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিত হয়ে কেউ যেন রাষ্ট্রীয় তথা জনসম্পদ ভাংচুর বা বিনষ্ট করতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ধ্বংসাত্মক কাজে নিজে বিরত থাকতে হবে এবং অন্যদেরকেও বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

১০. আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় সাহায্য করা (To help law and order and Discipline): দেশে যদি আইনশৃঙ্খলা দুর্বল হয় বা ভেঙে পড়ে তাহলে রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়। এর ফলে সুশাসন বাধাগ্রস্ত হয়। এজন্যই সকল নাগরিককে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় সচেষ্ট হতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে স্বেচ্ছায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে চোর-ডাকাত-দুষ্কৃতিকারী, উগ্র, হিংস্র, জঙ্গীদের সন্ধান বা অবস্থান জানাতে হবে।

১১. সচেতন ও সজাগ হতে হবে (Be Conscious and Alert): সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিকগণকে সচেতন ও সজাগ হতে হবে। নাগরিকগণ সজাগ ও সচেতন হলে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা তাদের অধিকার হরণ করতে পারবে না, স্বেচ্ছাচারী হতে পারবে না, সরকার দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক আচরণ করতে বাধ্য হবে।

১২. সংবিধান মেনে চলা (To abide by Constitution): সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। সুতরাং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে সকল নাগরিককে সংবিধান মেনে চলতে হবে; সবকিছুর ওপর সংবিধানকে স্থান দিতে হবে।

১৩. সুশাসনের আগ্রহ (Eagerness to Good governance): সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিকদের আগ্রহ থাকতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় একজন নাগরিককে প্রশাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশে দাঁড়াতে হবে, দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করতে হবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে হবে, দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে।

১৪. উদার ও প্রগতিশীল দলের প্রতি সমর্থন (Selection of Liberal & Progressive Political Party): সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিককে উদার ও প্রগতিশীল দলের প্রতি সমর্থন জানাতে হবে, সন্ত্রাসী ও সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয়দানকারী দল ও ব্যক্তিকে এড়িয়ে চলতে হবে এবং ঘৃণা জানাতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যেন হরতাল, ধর্মঘট, জ্বালাও-পোড়াও নীতি পরিহার করে এজন্য চাপ প্রয়োগ করতে হবে।

Rate this post