প্রশ্নঃ সামাজিক পদমর্যাদা কীভাবে সমাজে অসমতা সৃষ্টি করে আলোচনা কর।

অথবা, সামাজিক অসমতার ক্ষেত্রে পদমর্যাদার ভূমিকা আলোচনা কর।

ভূমিকাঃ মানবজীবনের সাথে জড়িত যেসকল মৌল প্রত্যয় রয়েছে তার মধ্যে পদমর্যাদা অন্যতম। কোনো সমাজের সদস্যের আয় মর্যাদা, শিক্ষা, প্রতিপত্তি বা ক্ষমতার ভিত্তিতে কতকগুলো ক্রমোচ্চপদ বা স্তরে ভাগ করা সম্ভবপর। এসবের ভিত্তিতে কোনো ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান বা পদের স্তরকে আর্থ-সামাজিক পদমর্যাদা বা Status বলা হয়। মূলত পদমর্যাদা বা Status বলতে সাধারণত আর্থ-সামাজিক পদমর্যাদাকেই বুঝায়। এই পদমর্যাদার মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান কেননা সব মর্যাদাই এক স্তরের অন্তর্ভুক্ত নয়। এক কথায় ব্যক্তির সামাজিক পরিচিতির মাত্রাকেই পদমর্যাদা বলা হয়ে থাকে।

সামাজিক পদমর্যাদার উপর ভিত্তি করে সামাজিক অসমতার মূল্যায়নঃ বৈশিষ্ট্য বা গুণের ভিত্তিতে কোনো ব্যক্তিকে সমাজে একটি বিশেষ স্তর বা অবস্থানে গণ্য করা হয় তাকে পদমর্যাদা বলে। বয়স, স্ত্রী-পুরুষ ভেদ, সেক্স, জন্ম, পেশা, বিবাহ বা পারদর্শিতার ভিত্তিতে আখ্যা দেয়া চলে। ব্যক্তির কাজ বা ভূমিকাকে যে মাত্রায় গুরুত্ব দেয়া হয় তাই তার পদমর্যাদা।

কোনো দূতাবাসে আয়োজিত অনুষ্ঠানে পদমর্যাদানুযায়ী বসবার ব্যবস্থা থাকে। কোনো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত অতিথিরা তাদের পদমর্যাদানুযায়ী আসন গ্রহণ করেন। কিসের ভিত্তিতে একজন উঁচু বা নীচু মর্যাদার অধিকারী হয়ে থাকে, অর্থাৎ কীসের ভিত্তিতে সামাজিক মর্যাদা নিয়ন্ত্রিত হয়? ব্যক্তির ভূমিকা বা কার্যাবলির ভিত্তিতে তার মর্যাদা নির্ণীত হয়। কিছু মর্যাদা অন্যান্য মর্যাদার চেয়ে উচ্চতর বলে মনে করা হয় এবং উচ্চতর মর্যাদার জন্য কিছু সুযোগ-সুবিধে নির্ধারিত থাকে। এতে দেখা যায় যে, সামাজিক পদমর্যাদার ভূমিকা বেশ সুস্পষ্ট। সমাজবিজ্ঞানীরা যে বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী তা হলো ব্যক্তির জন্য সমাজ প্রদেয় মর্যাদার ওপর ব্যক্তির কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে কিনা।

সব সমাজেই আরোপিত এবং উপার্জিত মর্যাদা রয়েছে। সাধারণভাবে বলা চলে, প্রাক শিল্পযুগে আরোপিত মর্যাদা এবং শিল্প যুগে উপার্জিত মর্যাদাই বেশি লক্ষ্য করা যায়। অনেকেই মনক্ষুণ্ণ হন- যখন তারা দেখেন সে একজন ব্যক্তি তার যোগ্যতা বলে কিছু অর্জন না করেও বেশি সুযোগ-সুবিধে পেয়ে যায়। তবুও এ কথা স্বীকার না করে পারা যায় না যে, আমাদের জীবনে আরোপিত মর্যাদা অনেকসময় অলক্ষ্যে কাজ করে যায় । পুরুষ হোক বা মেয়ে হোক আকর্ষণীয় চেহারা বা দৈহিক উচ্চতা ও গড়ন কেউই ইচ্ছে করে অর্জন করেন না। অথচ বাস্তব জীবনে আকর্ষণীয় চেহারা, সুঠাম ও বলিষ্ঠ দেহের একটি মূল্য রয়েছে। আবার সাধারণভাবে মেয়েদের তুলনায় পুরুষদেরই প্রায় সবসময় নেতা হিসেবে মেনে নেয়া হয়। অতএব সামাজিক অসমতার ক্ষেত্রে আরোপিত এবং উপার্জিত পদমর্যাদা এক তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব রাখে।

যা হোক, শ্রম শিল্পযুগে মানুষ তার কাজ ও পারদর্শিতার দ্বারা মর্যাদা অর্জন করছে। সবাই যদি একই মেধা ও দক্ষতার অধিকারী হতো, তাহলে কে কোন কাজ করতো? অতএব আজকের যুগে মানুষ তার ভূমিকা, মেধা বা দক্ষতা বলে মর্যাদা অর্জন করবে সেটাই অধিকাংশের কাম্য। সে কে তা নয়, সে কি কাজ করে তা দিয়েই তার মর্যাদা নিরূপিত হচ্ছে।

কখনো বা পদমর্যাদার অসংলগ্নতা দেখা যায়। যেমনঃ একজন উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তি যদি কম আয় করেন বা একজন অতি উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি যদি এমন কাজ করেন যা করতে তেমন শিক্ষার প্রয়োজনই নেই তবে তা হবে পদমর্যাদার অসংলগ্নতা। আবার দেখা যায়, সমাজ নিন্দিত বা বেআইনী উৎস থেকে অধিক আয় করেও কেউ হয়তো আকাঙ্ক্ষিত পদমর্যাদা পায় না। বস্তুত, সামাজিক অসমতার ক্ষেত্রে পদমর্যাদার প্রকৃতিও এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, পদমর্যাদা প্রত্যেক মানুষের জন্য সামাজিক স্বীকৃতিস্বরূপ। এই পদমর্যাদার বলেই মানুষ তার স্বীয় সমাজ থেকে সম্মান পেয়ে থাকে। মানুষ দুটি দিক দিয়ে পদমর্যাদার অধিকারী হয়ে থাকে। তবে সমাজ সাধারণত অর্জিত মর্যাদা অর্থাৎ মানবিক গুণাবলি দ্বারা অর্জিত মর্যাদাকেই বেশি মূল্যায়ন করে থাকে। প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থা ও আধুনিক মননশীলতার জন্য অর্জিত মর্যাদা প্রত্যেক মানুষের পদমর্যাদার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে।

Rate this post