প্রশ্নঃ মনের স্বরূপ ব্যাখ্যা কর।

অথবা, মন প্রত্যক্ষণের সমষ্টি- আলোচনা কর।

অথবা, আত্মা, মন সম্পর্কীয় মতবাদ হিসাবে অভিজ্ঞতাবাদী মতবাদ ব্যাখ্যা ও পরীক্ষা কর।

ভূমিকাঃ মন বা আত্মা হলো সেই অপরিবর্তিত স্থির সত্তা যা বিভিন্ন পরিবর্তনশীল মানসিক প্রক্রিয়ার মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে। এদের ঐক্যবদ্ধ করে আমাদের অভিজ্ঞতাকে সম্ভব করে তোলে। এটি একটি অদৃশ্য সত্তা। যেসকল দার্শনিক মন বা আত্মা সম্বন্ধে অভিজ্ঞতামূলক মতবাদ পোষণ করেন তাদের মধ্যে হিউম, মিল ও জেমস প্রধান। চরম সন্দেহবাদী দার্শনিক হিউম হচ্ছেন আত্মা সম্বন্ধে অভিজ্ঞতাবাদী ব্যাখ্যার জনক। হিউমের মতবাদ অনুসারে মন বা আত্মা হচ্ছে চিন্তা, অনুভূতি, ও ইচ্ছার সমষ্টি। মানসিক প্রক্রিয়ার পেছনে কোনো সমন্বয়কারী আত্মসত্তা নেই, তা ছাড়া মনের বৈশিষ্ট্য চেতনা। এ চেতনা মনকে জড় ও প্রাণ থেকে পৃথক করে।

আত্মা বা মনের স্বরূপঃ পাশ্চাত্য দর্শনের আলোচনা, মন ও আত্মাকে সমার্থক শব্দ এবং এদের মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই বলে দেখানো হয়েছে। কিন্তু ভারতীয় দর্শনে মন ও আত্মাকে স্বতন্ত্র্য সত্তা বলা হয়েছে। ভারতীয় দর্শনে মনকে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলা হয়েছে। নিম্নে মনের স্বরূপ আলোচিত হলো-

(i) চেতনা হলো মনের বৈশিষ্ট্যঃ চেতনা মনের প্রধান বৈশিষ্ট্য, যার সাহায্যে মনকে জড় এ প্রাণ থেকে আলাদা করা যায়। মনের তিনটি মানসিক প্রক্রিয়া বিদ্যমান। যথাঃ চিন্তা, অনুভূতি ও ইচ্ছা।

(ii) মন, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় বস্তুর সম্পর্কঃ মন মানেই চেতনা যার সাহায্যে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় বস্তুর মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা পায়। প্রত্যেক বস্তুর যেমন নিজস্ব একটি ধর্ম আছে তেমনি মনের ধর্ম চেতনা।

(iii) আচরণবাদীদের মতঃ আচরণবাদীদের মতে, মন একটি আদিম উপাদান থেকে সৃষ্টি হয়েছে। মন বাইরের বস্তুকে জানে চেতনার মাধ্যমে। এদের মনে বস্তুকে মন প্রত্যক্ষণ করে উপযুক্ত আচরণ সংযোগ করে থাকে।

বস্তুত, মনের স্বরূপ চেতনা যারা দ্বারা মনের সার্বিক কার্য সম্পাদন হয়।

হিউমের আত্মাসত্তা/অভিজ্ঞতাবাদী মতবাদঃ মন সম্পর্কিত সাবেকি ধ্যান-ধারণা হিউমের চিন্তায় আমূল পরিবর্তন ঘটে। অভিজ্ঞতাবাদের জনক হিউমের মতে, ইন্দ্ৰিয় অভিজ্ঞতাই জ্ঞান লাভের একমাত্র পন্থা। তাই যাকে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যাচাই করা যায় না, তার অস্তিত্বও স্বীকার করা অর্থহীন দার্শনিকেরা মন নামক এক স্থায়ী আধ্যাত্মিক দ্রব্যের কথা বলেছেন। কিন্তু হিউম বলেন, এরকম স্থায়ী কোনা দ্রব্যের ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা আমাদের কখনই হয় না। অভিজ্ঞতায় আমরা কোনো অপরিবর্তিত আত্মার সন্ধান পাই না। অভিজ্ঞতায় আমরা মন বলতে যা পাই তা হলো চিন্তা, অনুভূতি, ইচ্ছা প্রভৃতি মানসিক প্রক্রিয়াগুলোর পরিবর্তনশীল ধারা। যে আত্মচেতনা দার্শনিকদের মন নামক দ্রব্যটিকে স্বীকার করতে বাধ্য করে, তার উদ্দেশ্যে হিউম বলেন, গভীর ঘুমে আমার অভিজ্ঞতা দুরীভূত হয়ে যায় তখন কিন্তু আমিত্বের কোনো অস্তিত্ব থাকে না।

সমালোচনাঃ হিউম মনের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকার না করেই তার দর্শনে আমি, আমার প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করেছেন, যা মূলত অভিজ্ঞতার বাইরে স্থায়ী সত্তাকেই বোঝানো হয়ে থাকে। তা ছাড়া হিউমের রঙ্গমঞ্চের সাথে মনের তুলনা দিতে গিয়ে মনের স্বরূপগত ঐক্যকে অস্বীকার করেছেন। তাই তার মতানুসারে ব্যক্তি অভিন্নতাকে ব্যাখ্যা করা যায় না।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক হিউমের আত্মসত্তা সম্পর্কিত অভিজ্ঞতাবাদী মতটি মন বা আত্মার সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারে না। অভিজ্ঞতাবাদীরা মূলত জড়বাদী। তাই তাদের মতে, প্রত্যক্ষণই একমাত্র জ্ঞানের উৎস। এ মত অনুসারে, হিউমের মতবাদটি অভিজ্ঞতাবাদের সুনির্দিষ্ট পরিণাম। তাই এ মতবাদ সঠিক দিক ভুলে আত্মঘাতি নঞর্থক মতবাদে পরিণত হয়েছে। তারপরও আমরা হিউমের আত্মসত্তা বিষয়ক মতবাদকে গুরুত্বহীন বলতে পারি না। কেননা পাশ্চাত্য দর্শনের যাত্রাকালে এ মতবাদ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

Rate this post