সামগ্রিক বিচারে বিশ্বায়নের ধারণাটি মূলত আর্থনীতিক। প্রধানতঃ একটি আর্থনীতিক ধারণা ও ব্যবস্থা হিসাবে বিশ্বায়নের আবির্ভাব ও বিকাশ ঘটেছে। প্রকৃত প্রস্তাবে সমাজের মূল ভিত্তিই হল অর্থনীতি। আর্থনীতিক বিশ্বায়নের ধারণা অনুযায়ী কোন জাতীয় অর্থনীতিকে বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপের মত কোন বিচ্ছিন্ন বিষয় হিসাবে বিবেচনা করা হয় না। সকল দেশের অর্থনীতিই পরস্পর সংবদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে জাতীয় অর্থনীতির এই সংযোগ-সম্পর্ক ব্যাপকতর ক্ষেত্রে হতে পারে, আবার সংক্ষিপ্ত ক্ষেত্রেও হতে পারে। এদিক থেকে বিচার করলে আর্থনীতিক বিশ্বায়ন হল স্বতন্ত্র জাতীয় অর্থনীতিসমূহের দুনিয়া ছেড়ে বিশ্ব অর্থনীতির দুনিয়ায় চলে আসা। বিশ্ব আর্থনীতিক ব্যবস্থায় উৎপাদনের আন্তর্জাতিকীকরণ ঘটে এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে বৈত্তিক মূলধন (financial capital) উন্মুক্ত ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলাচল করে। আর্থনীতিক বিশ্বায়নের একটি বড় বিষয় হল যে, নিজেদের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার ক্ষেত্রে জাতীয় সরকারসমূহের সামর্থ্য হ্রাস পায়; উন্মুক্ত বাজার ব্যবস্থার পথে নিজেদের অর্থনীতির পুনর্বিন্যাসকে জাতীয় সরকারসমূহ আটকাতে পারে না।

আর্থনীতিক বিশ্বায়ন হল বিশ্ব আর্থনীতিক ব্যবস্থার সঙ্গে কোন দেশের আর্থনীতিক সংযোগ সাধন। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন হল মুক্ত অর্থনীতির দ্যোতক। এ হল একটি দেশের আর্থনীতিক বিষয়াদির উপর আরোপিত নিয়ন্ত্রণমূলক বিধি-ব্যবস্থাগুলিকে অপসারিত করা এবং দেশীয় অর্থনীতিকে বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত করা।

বিশ্বব্যাপী সাম্যবাদী ব্যবস্থার অবক্ষয়-অবসান আর্থনীতিক বিশ্বায়নের ধারাকে বিশেষভাবে উজ্জীবিত করেছে। যে রাষ্ট্রগুলি পুঁজিবাদী দুনিয়ার বাইরে ছিল সেগুলিও বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সাম্যবাদী ব্যবস্থার বিলুপ্তির ব্যাপারে আর্থনীতিক বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সদর্থক অবদান আছে বলে মনে করা হয়।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড্রাকার (Peter Drucker) তাঁর New Realities শীর্ষক গ্রন্থে বিশ্বায়নের আর্থনীতিক দিকগুলির উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রকাশ হিসাবে তিনি কতকগুলি আর্থনীতিক বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করেছেন। এই বৈশিষ্ট্যগুলিকে নিম্নলিখিতভাবে বিন্যস্ত করা যায়।

  • (ক) বিশ্বায়নের সুবাদে অতিজাতিক সংস্থাসমূহ (Transnational corporations) সমগ্র পৃথিবীকে একটি মাত্র উৎপাদন ও পণ্য-পরিষেবার বাজার হিসাবে গড়ে তোলার ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী বিস্তার লাভ করেছে। 

  • (খ) বিশ্বায়নের অর্থনীতির মূল উদ্দেশ্য হল বাজারের সর্বাধিক বিস্তার; মুনাফার সর্বাধিককরণ নয়। 

  • (গ) বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগই বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে, বাণিজ্যে বিনিয়োগ নয়। 

  • (ঘ) বিশ্বায়নের কারণে সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণের ক্ষমতা জাতীয় রাষ্ট্রের কাছ থেকে আঞ্চলিক জোট- সমূহের কাছে হস্তান্তরিত হয়। 

  • (ঙ) বিশ্বায়নের অর্থনীতিতে ‘পরিচালন ব্যবস্থা’ উৎপাদনের উপাদান হিসাবে প্রাধান্য পায়। জমি, শ্রম প্রভৃতি উৎপাদনের প্রচলিত উপাদানসমূহ প্রাধান্য হারায়। 

  • (চ) প্রধানত অর্থের লেনদেনের মাধ্যমে বিশ্বায়নের অর্থনীতি বর্তমানে পরিচালিত হচ্ছে। আবার এই আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। অনুৎপাদক বিদেশী পুঁজি জাতিরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিকূল প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। 

  • (ছ) বিশ্বায়নের অর্থনীতিতে সমগ্র পৃথিবী জুড়ে প্রায় স্বতস্ফূর্ত ঋণ, অর্থ ও বিনিয়োগের এক প্রক্রিয়া চলতে থাকে। জাতীয় রাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রমী তথ্যাদি এই প্রক্রিয়াকে সংগঠিত করে থাকে।

বিগত কয়েক দশকের সময়কালে প্রযুক্তিগত কৌশলসমূহের অভাবিত উন্নতি সাধিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নাটকীয় রূপান্তর সংঘটিত হয়েছে। কমিউনিজমের পতন ঘটেছে। উদারনীতিবাদের বিস্তার ঘটেছে। তার ফলে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং আর্থনীতিক সম্পর্কসমূহের অভাবনীয় বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে। সাম্প্রতিককালে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এবং বাজারের উদারনীতিকরণ ঘটেছে। তার ফলে অধিকতর মুনাফা অর্জনের প্রয়াসে বিভিন্ন বিনিয়োগকারী সংস্থা মূলধনসহ দুনিয়ার বাজারে হাজির হচ্ছে। স্বভাবতই বিনিয়োগের আন্তর্জাতিকীকরণ ঘটছে ক্রমবর্ধমান হারে। তা ছাড়া বেশ কিছু বহুজাতিক করপোরেশনের উত্থানের সঙ্গে বাণিজ্য ও বাজার সম্পর্কিত হয়ে পড়েছে। এই সমস্ত বহুজাতিক করপোরেশন বিশ্ববাজারের উপর প্রভাব-প্রতিক্রিয়া কায়েম করে। অধিকতর উন্মুক্ত বাজার ব্যবস্থা, পরিবহনজনিত ব্যয় হ্রাস প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে বৃহদাকৃতির বহুজাতিক কোম্পানিসমূহ কোটি কোটি টাকা মুনাফা করে এবং বিশ্ববাজারের সম্পদসমূহ নিয়ন্ত্রণ করে। এ রকম বহুজাতিক করপোরেশনের উদাহরণ হিসাবে উল্লেখযোগ্য হল : আই.বি.এম. (IBM), ম্যাকডোনাল্ডস (McDonald’s), জনসন ও জনসন (Johnson & Johnson), ইউনিলিভার (Uniliver), হন্ডা (Honda) প্রভৃতি।

সাম্প্রতিককালে প্রযুক্তিগত প্রকৌশলের ক্ষেত্রে অভাবনীয় বিকাশ সাধিত হয়েছে। তারফলে আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সাবেকি বিবিধ প্রতিবন্ধকতা অপসারিত হয়েছে। বিভিন্ন ফার্ম এবং সাধারণ মানুষজন মধ্যবর্তী কোন বাজারি শক্তি বা সংস্থার সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়াই বা নামমাত্র মধ্যবর্তী পরিষেবা নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বাজার থেকে দ্রব্য সামগ্রী ও পরিষেবা ক্রয় করতে পারে। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রক্রিয়া বর্তমানে বৈদ্যুতিন প্রকৃতিপ্রাপ্ত হয়েছে। বিশ্বের দূরদূরান্তরের ব্যবসাবাণিজ্যের সঙ্গে বৈদ্যুতিন পথে সংযোগ-সম্পর্ক সাধিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবিত বিকাশ ও বিস্তারের সুবাদে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ববাজার অধিকতর উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে এবং ফার্মসমূহের মধ্যে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিনিয়োগ প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রযুক্তিগত বৈপ্লবিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। কম্পিউটারের কয়েকটি মাউস ক্লিকের মাধ্যমেই মানুষ অধুনা আন্তর্জাতিকভাবে পরিচালিত হতে ও বিনিয়োগ করতে পারে। আজকাল অনলাইন ব্যাঙ্কিং পরিষেবা ও বিনিয়োগের ব্যবস্থা আর্থনীতিক দুনিয়ায় বিপ্লব এনেছে। শ্রমের ক্ষেত্রেও আর্থনীতিক বিশ্বায়নের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া চমকপ্রদ। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার কারণে মানুষ কাজের বাজারে হাজির হয়। গ্রামাঞ্চলের মানুষ শহরাঞ্চলে আসে; দেশের ভিতরে এ রকম পরিযান প্রক্রিয়া চলতে থাকে। অনুরূপভাবে দেশের বাইরেও কাজের তাগিদে পরিযান পরিলক্ষিত হয়। এক দেশ থেকে অন্য দেশে শ্রমের বা শ্রমিকের পরিযান ঘটে।

আর্থনীতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া বা পরিণাম প্রসঙ্গে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয়বিধ বক্তব্যই বর্তমান। প্রথমে বিরুদ্ধবাদীদের বিরূপ মতামতসমূহ উল্লেখ করা যেতে পারে।

(ক) বিরুদ্ধবাদীদের অভিযোগ অনুযায়ী আর্থনীতিক বিশ্বায়ন রাষ্ট্রের সামর্থ্য ও স্বাতন্ত্র্যকে বিপন্ন করে তোলে। রাষ্ট্রীয় আইনের অনুশাসন হীনবল হয়ে পড়ে। অথচ সে জায়গায় আন্তর্জাতিক আইনের অনুশাসন কায়েম হয়, তাও নয়। কার্যত বৃহৎ ও শক্তিশালী করপোরেশনসমূহের সম্মিলিত সংস্থাই দুনিয়া জুড়ে এক ধরনের আর্থনীতিক কর্তৃত্ব কায়েম করে। সংশ্লিষ্ট শক্তিশালী করপোরেশনসমূহের উপর জাতীয় বা গণতান্ত্রিক কোন রকম নিয়ন্ত্রণ কার্যকর হয় না। বৃহদাকারের করপোরেশনগুলির মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিশ্বায়ন ঘটে। এ রকম অবস্থায় ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর সরকারের নজরদারি থাকে না এবং জনসাধারণের কাছে কোন রকম দায়বদ্ধতাও থাকে না।

(খ) বিনিয়োগ এবং শ্রমবাজারের বিশ্বায়নও বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। এ রকম ব্যবস্থায় অধিকতর মুনাফা অর্জনের অভিপ্রায়ে সেই সমস্ত দেশে অধিক বিনিয়োগ করে, যেখানে সস্তায় শ্রমিক পাওয়া যায় এবং শ্রম-নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত দুর্বল। সংশ্লিষ্ট উদ্যোগ আয়োজনের কারণে উন্নত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাসমূহে উৎপাদনমূলক কাজকর্ম অপসারিত হতে থাকে। এই ব্যবস্থায় কাজকর্ম বা চাকরিবাকরির অবস্থান দূরবর্তী হয়ে পড়ে। তারফলে বিশ্বব্যাপী শ্রমিকরা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যায়। সমাজবিজ্ঞানী প্যাট্রিক ওনীল তাঁর Essentials of Comparative Politics শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “For societies with developed social democratic systems in particular, globalization is seen as a huge threat, demanding fewer social expenditures in the name of increased competitiveness.”

(গ) উদারনীতিক রাজনীতিক অর্থনীতিকে যাঁরা বড় একটা স্বীকার বা সমর্থন করেন না, তাঁরাও আর্থনীতিক বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে বলেন। এই শ্রেণীর সমালোচকদের অনেকে অধিকতর ব্যবসা বাণিজ্যকে অধিকতর নির্ভরশীলতার সমগোত্রীয় হিসাবে প্রতিপন্ন করার পক্ষপাতী। ব্যাখ্যা করে তাঁরা বলেন যে, বিশ্বায়িত ব্যবসাবাণিজ্যের কারণে কিছু কিছু দেশ বিশেষ বিশেষ দ্রব্য সামগ্রীর উৎপাদনের উপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে এই সমস্ত দ্রব্যসামগ্রী অতিমাত্রায় তাৎপর্যবাহী। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ সামগ্রী বা প্রাণদায়ী ঔষধ উৎপাদনের রাসায়নিক পণ্য সামগ্রী, প্রাণপ্রযুক্তি, সফটওয়ার প্রভৃতি। বিপরীতক্রমে অন্য কিছু দেশের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ। তারফলে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় সম্পর্কের ক্ষেত্রে অসাম্যের সৃষ্টি হয়। তাৎপর্যপূর্ণ সম্পদ সামগ্রী নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি যে কয়েকটি দেশের হাতে থাকে তারা অন্যান্য দেশসমূহের উপর কর্তৃত্বমূলক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে।

আর্থনীতিক বিশ্বায়নের সমর্থকরা এ বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁরা আর্থনীতিক বিশ্বায়নের সদর্থক দিকগুলি তুলে ধরেন। তাঁদের বক্তব্য বিষয়াদিও সংক্ষেপে তুলে ধরা আবশ্যক।

(১) আর্থনীতিক বিশ্বায়ন সম্ভৃত নাটকীয় আর্থনীতিক পরিবর্তনসমূহ বিশেষভাবে সমর্থনযোগ্য। কারণ সংশ্লিষ্ট পরিবর্তনসমূহের সুবাদে সমগ্র দুনিয়ার সমৃদ্ধি সম্পাদিত হবে।

(২) আর্থনীতিক বিশ্বায়নের কল্যাণে দ্রব্য সামগ্রী ও শ্রমের জন্য অধিক সংখ্যক মানুষ বিশ্ববাজারে অংশগ্রহণ করতে পারে। আর্থনীতিক বিশ্বায়নের সদর্থক প্রবণতার সুবাদে অধিকতর সমৃদ্ধির সৃষ্টি হয়। অসংখ্য মানুষ দারিদ্র্যসীমার ঊর্ধ্বে উঠার সুযোগ পায়।

(৩) আর্থনীতিক বিশ্বায়নের আর একটি বড় ইতিবাচক দিক আছে। দ্রব্যসামগ্রী, শ্রম ও মূলধনের জন্য উন্মুক্ত বাজারের মাধ্যমে সম্পদ অধিকতর কার্যকরভাবে পৃথিবীব্যাপী সঞ্চারিত হয়। তারফলে বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনযাত্রার মান অধিকতর উন্নত হয়।

(৪) আর্থনীতিক বিশ্বায়ন অনেকাংশে উদারনীতিক আর্থনীতিক ব্যবস্থার আন্তর্জাতিকীকরণ হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। এই প্রক্রিয়ায় উন্মুক্ত বাজার ব্যবস্থা এবং দ্রব্যসামগ্রী এবং শ্রমের জন্য প্রতিযোগিতার উপর জোর দেওয়া হয়। 

(৫) আর্থনীতিক বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক আর্থনীতিক সংযোগসমূহ সম্প্রসারিত হয়। তার‌ ফলে বৃহত্তর বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে দ্রব্য সামগ্রী, বিবিধ পরিষেবা, শ্রম এবং অন্যান্য সম্পদসমূহ অধিকতর কার্যকরভাবে বিলি-বরাদ্দ করা সম্ভব হয়। সরকারি মাশুল ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় বিধি-নিষেধ এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারে না।

(৬) সকল দেশ সর্ববিধ উৎপাদনে সমভাবে পারদর্শী নয়। কিছু কিছু দেশ বিশেষভাবে পারদর্শী। আর্থনীতিক বিশ্বায়নের সুবাদে প্রতিটি দেশ তার পারদর্শিতা অনুযায়ী দ্রব্য সামগ্রী উৎপাদনের সুযোগ পায়। তারফলে উৎপাদন ব্যয় হ্রাস, বিশেষীকরণ, গবেষণা, উদ্ভাবন প্রভৃতির সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। 

(৭) বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ার প্রভাবে মূলধনের প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন নতুন বাজারের এবং আনুষঙ্গিক নতুন নতুন সুযোগ-সুবিধার যাবতীয় সদর্থক দিকগুলি বহুজাতিক করপোরেশনসমূহ গ্রহণ করে। এই সমস্ত কিছুর সুবাদে চাকরি-বাকরির সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পায়। মানুষজনও দেশের ভিতরে এবং বাইরে চাকরির সন্ধানে যাতায়াত করার সুযোগ-সুবিধা পায়।

আর্থনীতিক বিশ্বায়নের মূল্যায়ন সম্পর্কিত আলোচনা অনেকাংশে অস্পষ্ট। পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্যের অভাব নেই। তবে এ প্রসঙ্গে সাধারণভাবে বলা যায় যে, বিগত দু’দশকের অধিককাল ধরে বিশ্বায়নের সুবাদে দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারী জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের যে সমস্ত দেশে অধিক মাত্রায় বিশ্বায়ন ঘটেছে সেই সমস্ত দেশে জীবনযাপনের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে গণ-প্রজাতন্ত্রী চীন ও ভারতের কথা বলা যায়। বিপরীতক্রমে তৃতীয় বিশ্বের যে সমস্ত দেশে আর্থনীতিক বিশ্বায়ন বিশেষ একটা হয় নি, সেই সমস্ত দেশে এই সুফল সেভাবে পাওয়া যায় নি। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে আফ্রিকার কথা বলা যায়।

উপরিউক্ত পরিসংখ্যানমূলক সুফল আর্থনীতিক বিশ্বায়নের সমর্থনে একটি বড় বিষয়। এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। কিন্তু এ প্রসঙ্গে বিপরীত বক্তব্যও আছে। আর্থনীতিক বিশ্বায়নের পরিণামে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন দেশের মধ্যে আর্থিক সঙ্গতিসূচক ব্যবধানের কথা বাদ দিলেও, একই দেশের অধিবাসীদের বিত্তবান-বিত্তহীনদের মধ্যে ব্যবধান বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত ভারত এবং গণ-প্রজাতন্ত্রী চীনের কথা বলা যায়।

বিশ্বায়নের আর্থনীতিক সুফল-কুফল নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু এ কথা ঠিক যে আন্তর্জাতিক বিশ্বায়ন দুনিয়ার আর্থনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধন করেছে। সমর্থক-সমালোচক নির্বিশেষে সকলেই স্বীকার করেন যে, আর্থনীতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের সুবাদে বিভিন্ন দেশের আর্থনীতিক ব্যবস্থাসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সংযোগ-সম্পর্ক বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তারফলে স্থানীয় সমস্যা-সংকটসমূহ আন্তর্জাতিক সমস্যা-সংকট হিসাবে প্রতিপন্ন হওয়ার প্রবণতা ও সম্ভাবনা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সমাজবিজ্ঞানী প্যাট্রিক ও’নিল (Patrick H. Oneil) তাঁর Essentials of Comparative Politics শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন: “The growing linkages of finance, trade, and markets now increase the likelihood that local events will ripple throughout the system.”

Rate this post