Style কী?—এ প্রশ্নের এককথায় উত্তর নেই। তাই কখনো কখনো লেখকের ব্যক্তিত্ব, কখনো বিষয়ের গুরুত্ব, কখনো উদ্দেশ্য, কখনো বা লেখক-পাঠকের মেলবন্ধন এককভাবে মীমাংসার মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়। কোনো সাহিত্যের উপাদান যখন পাঠকের অনুভবে অনুসরণ সৃষ্টি করে তখন তার নির্মোহ ব্যাখ্যান বোধ হয় আর সম্ভব হয় না— অনুভব তখন একান্ত ব্যক্তিক—সে আর তখন বুদ্ধিবৃত্তির অনুগত নয়—পাঠক চৈতন্যের সঙ্গে একীভূ ত, সমস্ত চৈতন্যে সে অনুভূতি ব্যাপৃত। তাই হয়ত কালোত্তীর্ণ কোনো ছবি শুধুই দেখার, সমস্ত চৈতন্য দিয়ে অনুভবের, বর্ণনার নয়। তেমনই লেখকের অনুভূতির জারকরসে পিত্ত হয়ে কোনো বর্ণিত বস্তু যখন পাঠক মনে অনুসরণ সৃষ্টি করে তখনও তা পাঠকের অনুভূ তির কিন্তু সম্পদ হয়ে থাকে—হারিয়ে যায় তার বর্ণনার ভাষা। তাই শ্রেষ্ঠ লেখকের অনুভূ তি ঋদ্ধ রচনা চোখ দিয়ে দেখা যায়, হয়ত স্পর্শও করা যায়, রসদৃষ্টির কোনো নির্দিষ্ট মাপকের আওতায় আনা যায় না। তবুও Style বা রীতির সংজ্ঞা নিরূপণের চেষ্টা অব্যাহত।

তবে স্টাইলের স্বরূপ নির্ধারণে একথা বলা যায়—“অতিকথন বর্জন করে মিত ভাষণে অসংযত ভাবোচ্ছ্বাস বর্জন করে আত্মসংযত পরিমিত বক্তব্যে উপনীত হবার সাধনাই স্টাইলের ঘটনা।” বিষয়ের ওপর Control Ultimate না হক Maximum Control না থাকলে যেমন রচনায় স্বচ্ছতা আসে না, তেমনই সংযমের অভাব রচনাকে অসংহত করে। তৃতীয় গুণ অর্থাৎ বৈচিত্র্য পরিমিতির পরবর্তী স্তর। আর সে বৈচিত্র্য কেবল প্রকাশভঙ্গির নয় লেখকের মেজাজের বৈচিত্র্য, অনুভূতির বৈচিত্র্য। লেখকের কণ্ঠস্বরের বৈচিত্র্য, বৈচিত্র্যও তাই ব্যক্তি লেখক নির্ভর। পরবর্তী গুণ অর্থাৎ নাগরিকতা ও লেখক চিত্তের উদারতা, দৃষ্টির প্রসারতা, যে-কোনো পরিবর্তনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা, নিরভিমান প্রভৃতি গুণ তার ওপর নির্ভরশীল। সহাস্য রসিকতা, মার্জিত বুদ্ধি, পরিচ্ছন্ন চিন্তা, শব্দ ব্যবহারে ‘ত্রুটিহীনতা, বৈদগ্ধ্য ও চিত্তের উদারতা নাগরিকতার নামান্তর সংযতা ব্যক্ত—লেখকের সহাস্য রসিকতায় উদার জীবন দৃষ্টিতে জীবন সম্ভোগের আনন্দে। উক্ত সবকটি গুণের উৎস লেখক ব্যক্তিত্ব, সে কারণেই তা স্টাইলের অঙ্গীভূত, বাইরে থেকে আরোপিত নয়।

সাহিত্য সমালোচনা যদি সমালোচকের একান্ত ব্যক্তিগত যথেচ্ছাচারিতার নৈরাজ্য থেকে সাহিত্যকর্মের মূল্যায়নকে যুক্তিগ্রাহ্য করে তুলতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই তার অবসরভিত্তিক ভাষার ওপর যথোচিত গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। আর সেখানেই এসে যায় শৈলীবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যা সাহিত্যের ভাষা বিশ্লেষণের মধ্যেই তার আলোচনাকে সীমাবদ্ধ রাখে—সাহিত্যের ভালোমন্দত্ব নিরুপণের মধ্যে নয়। সাহিত্য সমালোচনা অবশ্যই সাহিত্যের মূল্যায়ন করবে এবং সেই মূল্যায়নের ব্যাপারে পাঠক সমালোচকের সাহিত্যবোধের ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু মনে রাখা দরকার এই সমগ্র প্রক্রিয়াটাই একটা স্বয়ং সম্পূর্ণ বস্তুনিষ্ট সাহিত্য মনের ভাষা অবয়ব থেকেই উৎসারিত। শৈলীবিজ্ঞান সাহিত্যের এই ভাষা অবয়বকেই বিজ্ঞানসম্মত ভাবেই বিশ্লেষণের পদ্ধতিটা সাহিত্য লোচকের হাতে তুলে দিলে সাহিত্য সমালোচনাকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করে। তাই শৈলীবিজ্ঞান সাহিত্য সমালেচনার বিকল্প নয়, সহায়ক।

সাহিত্যিক মাত্রই তাঁর সাহিত্য ভাবনাকে শব্দে সমর্পিত করেই তাঁর কাজ শেষ করেন। তাই তাঁর অভিপ্রেত ভাবনাকে তার অবয়বভিত্তি ভাষার সাহায্যেই ধরতে হবে। সুতরাং সমালোচক সাহিত্যে কর্মের ভাষা অবয়বের সঠিক বিশ্লেষণ কবি ভাবনায় ও কবি মনের সঠিক স্পর্শ পেতে পারেন। না হলে তাঁর ব্যক্তিগত সমারোহ ঘটায় সাহিত্য কর্মের বিকৃতি উপস্থাপনার সম্ভাবনা দেখা দেয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ জনৈক প্রখ্যাত সমালোচকের ‘সোনার তরী’ সম্পর্কে মূল্যায়িত বক্তব্য উদ্ধার করা যেতে পারে—“ বিতাটি চিত্ররস প্রধান। পদ্মাতীরের অতি পুরাতন একটি ঘটনাকে অপূর্ব শব্দসঙ্গতি ও ছন্দ মাহাত্ম্যে আশ্চর্য নিখুঁত চিত্র, ইহাতে যে করুণ রস আছে তাহা আমাদের চিত্তে সঞ্চারিত হইয়া গিয়া সেখানে এক অলৌকিক মায়াময় করুণ ব্যঞ্জনা জাগাইয়া দেয়।” এখানে সমালোচক বস্তুনিষ্ঠভাবে কবিতার অবয়ব পূর্বগৃহীত ধারণা অনুসারে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে শুরুতেই সমগ্রকাব্য গ্রন্থটির পটভূমিকায় কবিতাটিকে উপস্থাপন করেছেন। এতে অবশ্য আপত্তির কোনো কারণ থাকত না যদি তিনি পূর্বে তথ্যনির্ভরভাবে প্রতিটি কবিতার স্বতন্ত্র বা নিরপেক্ষ ভাবে মূল্যায়ন করতেন।

একথাও বলতে হয়—শৈলীবিজ্ঞান সাহিত্যে কর্মের ভাষা বিশ্লেষণের মাধ্যমে সাহিত্যের মূল্যায়ন পদ্ধতি নির্দেশ করে বলেই, অর্থাৎ পদ্ধতি হিসেবে—“আরোহণকে গ্রহণ করে বলেই, সমালোচকের পূর্বগৃহীত ধারণা প্রসৃত ‘অবরোহণ ধর্মী’ পদ্ধতির নৈরাজ্য থেকে সাহিত্যে সমালোচনাকে মুক্ত করতে সহায়কেরই ভূমিকা গ্রহণ করে, অতঃপর যে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক তাহল, সাহিত্য সমালোচনার সহায়ক হিসেবে শৈলীবিজ্ঞান-এর আলোচনা পদ্ধতির বিশেষত্ব কোথায় ? এর প্রশ্নের সঠিক উত্তর মিলবে শৈলীবিজ্ঞানের আলোচনা পদ্ধতি অনুসরণ করেন।