ইনকিলাব জিন্দাবাদ শব্দের অর্থ কি
Sign up to join our community!
Please sign in to your account!
Lost your password? Please enter your email address. You will receive a link and will create a new password via email.
Please briefly explain why you feel this question should be reported.
Please briefly explain why you feel this answer should be reported.
Please briefly explain why you feel this user should be reported.
ইনকিলাব জিন্দাবাদ শব্দের অর্থ “বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক”।
ইনকিলাব জিন্দাবাদ (উর্দু: اِنقلاب زِنده باد; হিন্দি: इंक़लाब ज़िन्दाबाद) একটি উর্দু বাক্যাংশ, যার অনুবাদ “বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক”।
কিছু আইকনিক শব্দ অথবা অভিব্যক্তি আছে, যা অমর হয়ে যায় এবং চিরকাল আমাদের জীবনের সঙ্গে রয়ে যায়। ‘ইনকিলাব’ (বিপ্লব) সে রকম একটি শব্দ। শব্দটি ১৯২১ সালে মৌলানা হাসরাত মোহানি একটি স্লোগানে প্রথম ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ (বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক) কথাটিতে ব্যবহার করেছিলেন এবং এরপরই এটি আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের মিছিলের প্রধান স্লোগান হয়ে উঠেছিল। এখন স্লোগানটি দিল্লি হাইকোর্টের আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। ২০২০ সালের দিল্লির দাঙ্গায় অভিযুক্ত বাম নেতা উমর খালিদ কোন প্রেক্ষাপটে এ স্লোগান দিয়েছিলেন, তা জানতে চেয়েছেন উচ্চ আদালত। তাই নিয়ে জোর আলোচনা চলছে। জানতে চাওয়ার সময় একজন বিচারক বলেছিলেন ‘বিপ্লব’ যে ‘সব সময় রক্তপাতহীন হয় না’ তা এই শব্দের মধ্যেই নিহিত রয়েছে।
‘ইনকিলাব’ শব্দটির ওপর হাসরাতের জোর দেওয়ার এবং ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই করার এবং অবশ্যই ঔপনিবেশিক নিপীড়ন থেকে মুক্তির সংগ্রামে তার তাগিদ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। হাসরাত মোহানি এই স্লোগান লেখার অনেক আগেই রাশিয়ায় বলশেভিকদের বিপ্লব হয়েছিল এবং সেই বিপ্লব বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত জাতীয়তার সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। ভারতেও তার রেশ এসে পড়েছিল।
কয়েক দশক ধরে স্লোগানটির জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ন থাকার কারণ অনুসন্ধানের আগে এটির স্রষ্টা মৌলানা হাসরাত মোহানি সম্পর্কে আমাদের আরও কিছু জানা দরকার। হাসরাত মোহানি (১৮৭৫-১৯৫১) উত্তর প্রদেশের উন্নাও জেলার মোহন নামক একটি শহরে জন্ম নেন। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয় ফজলুল হাসান। ফজলুল হাসান নামেই তিনি বেড়ে ওঠেন। একজন বিপ্লবী উর্দু কবি হিসেবে ‘হাসরাত’ ছিল তাঁর কলমি নাম, যা একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবেও তাঁকে পরিচিতি দিয়েছিল। হাসরাত ছিলেন একজন শ্রমিকনেতা, একজন পণ্ডিত ও একজন সুপরিচিত উর্দু কবি। ১৯২৫ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদেরও অন্যতম ছিলেন তিনি।
ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের আরেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা স্বামী কুমারানন্দের সঙ্গে হাসরাত মোহানি প্রথম (১৯২১ সালে) ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আহমেদাবাদ অধিবেশনে ভারতের জন্য ‘সম্পূর্ণ স্বাধীনতা’ বা ‘পূর্ণ স্বরাজ’–এর দাবি উত্থাপন করেছিলেন। এই অধিবেশনে রামপ্রসাদ বিসমিল এবং আশফাকুল্লাহ খান (দুজনেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাধারণ পরিষদে রেজল্যুশন পাস করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন) উপস্থিত ছিলেন। হাসরাত মোহানি স্বাধীনতার পরে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং ড. বি আর আম্বেদকরের সঙ্গে সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির সদস্য ছিলেন।
‘ইনকিলাব’ শব্দটির ওপর হাসরাতের জোর দেওয়ার এবং ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই করার এবং অবশ্যই ঔপনিবেশিক নিপীড়ন থেকে মুক্তির সংগ্রামে তার তাগিদ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। হাসরাত মোহানি এই স্লোগান লেখার অনেক আগেই রাশিয়ায় বলশেভিকদের বিপ্লব হয়েছিল এবং সেই বিপ্লব বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত জাতীয়তার সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। ভারতেও তার রেশ এসে পড়েছিল।
১৯২৯–এর দশকের মাঝামাঝি থেকে এ স্লোগান ভগৎ সিং এবং তাঁর ‘নওজোয়ান ভারত সভা’–এবং একই সঙ্গে তাঁর হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের (এইচএসআরএ) রণহুংকার হয়ে ওঠে। ভগৎ সিং ‘ইনকিলাব’ বা বিপ্লবের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। তবে তাঁর লক্ষ্য শুধু রাজনৈতিক বিপ্লব ছিল না। তিনি যুগ যুগ ধরে চলা বৈষম্যমূলক প্রথা ভাঙতে একটি সামাজিক বিপ্লব চেয়েছিলেন। এই ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বিপ্লবীদের জন্য নিছক একটি আবেগময় রণহুংকার ছিল না বরং এর মধ্যে একটি উচ্চ আদর্শ নিহিত ছিল। এইচএসআরএ এটিকে ব্যাখ্যা করেছে এভাবে, ‘বিপ্লব পুঁজিবাদ এবং শ্রেণিবৈষম্য ও সুযোগ-সুবিধার মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দেবে…বিপ্লব এক নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দেবে।…এটি একটি নতুন সামাজিক ব্যবস্থা।’
ভগৎ সিং এবং তাঁর ‘নওজোয়ান ভারত সভা’ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে তাদের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচনা করেছিল। সাধারণ অনুশীলনের বিপরীতে গিয়ে, ‘নওজোয়ান ভারত সভা’ তাদের ধর্মনিরপেক্ষতা প্রমাণ করতে ও সব ধর্মের অনুসারীদের তুষ্টি নিশ্চিত করতে ‘আল্লাহু আকবর’, ‘সাত শ্রী আকাল’ এবং ‘হর হর মহাদেব’-এর মতো স্লোগানে বিশ্বাস করে না। তার বদলে তারা বিপ্লব ও দেশকে অভিবাদন জানিয়ে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ ও ‘হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ’ বলে দুটি স্লোগান দেয়। যাঁরা ভগৎ সিং-এর নামে জয়ধ্বনি দেন, তাঁদের সবার ভগৎ সিংয়ের রেখে যাওয়া চিন্তা ও দর্শনের উত্তরাধিকারকে ভালো করে বোঝা উচিত।
১৯২৯ সালের ৮ এপ্রিল ভগৎ সিং এবং বি কে দত্ত দিল্লির কেন্দ্রীয় আইনসভায় বোমা মারার সময় ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বলে স্লোগান দিয়েছিলেন। পরে একই বছরে প্রবীণ সাংবাদিক ও মডার্ন রিভিউ অব কলকাতার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’ (ইনকিলাব জিন্দাবাদ) স্লোগানকে বিদ্রূপ করে একটি লেখা লেখেন।
ভগৎ সিং এ লেখার বক্তব্যকে উপেক্ষা করতে পারেননি এবং এ স্লোগানের ব্যবহার ব্যাখ্যা করে প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, ‘যে অর্থে বিপ্লব (ইনকিলাব) শব্দটি “ইনকিলাব জিন্দাবাদ” ফ্রেজ বা শব্দগুচ্ছে ব্যবহৃত হয়েছে, তা হলো চেতনা এবং অগ্রগতির জন্য পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা। আমজনতা সাধারণত প্রতিষ্ঠিত নিয়মে অভ্যস্ত হয়ে যায় এবং পরিবর্তনের হাওয়া দেখলেই অজানা আশঙ্কায় কাঁপতে শুরু করে…পুরোনো শৃঙ্খলার পরিবর্তন হওয়া উচিত, অচলায়তন ভেঙে নতুনের জন্য স্থান করে দেওয়া অর্থেই আমরা “ইনকিলাব জিন্দাবাদ” ধ্বনি দিই।’
ভগৎ সিং ১৯২৯ সালের ৬ জুন আদালতে যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন, তাতে তিনি এ বিষয়কে আরও পরিষ্কার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ইনকিলাব বা বিপ্লব বোমা ও পিস্তলের সংস্কৃতি নয়। আমাদের বিপ্লবের অর্থ হলো প্রকাশ্য অন্যায়ের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে থাকা বর্তমান পরিস্থিতিকে আমূল বদলে দেওয়া।’ ভগৎ সিং তঁার জেলের ডায়েরিতে লিখেছিলেন, একটি আমূল বিপ্লব কোনো ইউটোপিয়ান (কল্পিত সমাজব্যবস্থা) নয়। তিনি সেখানে বলেছিলেন, ‘যা ইউটোপিয়ান, তা হলো একটি আংশিক ও একচেটিয়াভাবে রাজনৈতিক বিপ্লবের ধারণা যা ঘরের স্তম্ভগুলোকে দাঁড় করিয়ে রাখে।’
এইচএসআরএর লক্ষ্য ছিল এমন একটি বিপ্লব, (ইনকিলাব) যা ভারতীয় সমাজের বিদ্যমান আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোকে ভেঙে নতুন যুগের সূচনা করবে। তাদের বিপ্লব নৈরাজ্য বা অনাচারের জন্য নয়, বরং সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য ছিল। তাই আমাদের ইনকিলাব বা বিপ্লবের অর্থ এবং ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানকে এর ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বুঝতে হবে। যতক্ষণ জনগণ বিভিন্ন বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাবে, ততক্ষণ এ স্লোগানের প্রাসঙ্গিকতা জারি থাকবে।