চর্যাপদে বর্ণিত সমাজচিত্রে নারীদের অবস্থান কী ছিল?
চর্যার সমাজচিত্রে নারীদের অবস্থান তুলে ধর।
উত্তর: চর্যাগীতিকাগুলো বৌদ্ধ, সহজিয়াদের পদ্ধতিমূলক গান। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সন্ধ্যাভাষায় ত্রিপকের মাধ্যমে সাধকদের গুড় ধর্মসাধনার কথা প্রচার করটি ঐতিহাসিক পটভূমিকায় চর্যাগীতিগুলো রচিত। চর্যাপদকর্তাগণ নিজ নিজ অবস্থায় নিজেদের ধর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তৎকালীন সমাজের বাস্তব জীবনযাত্রার যে সমস্ত রূপকল্প ব্যবহার করেছেন তা বিস্ময়ের বটে। মূলত ঐতিহাসিক পটভূমিকায় চর্যাগীতিগুলো রচিত। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, এটি ৬৫০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রচিত। সুতরাং চর্যাপদের মাধ্যমে প্রাচীন যুগের সামাজিক অবস্থার পরিচয় পাই। এ যুগে নারীরা খুবই স্বাধীন ছিল।
চর্যাপদের নারীরা নানা পেশায় নিযুক্ত ছিল তবে সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে অধিকার রাখতো। কাহ্নপা ১০নং পদে বলেছেন, এক ডোমিনী নগরে তাত ও চাঙারি বিক্রি করতো। কাহ্নপার ১৮নং পদে ডোমিনীয় ছিনালী করার কথা আছে। কুকুলী পা ২নং পদে লিখেছেন, গৃহবধূটি বেশ ছল জানে। সে দিনের বেলায় কাকের ডাক শুনেই ভয় পায় অথচ রাত্রে প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করন্দ্রেযায়। চর্যাপদকর্তার ভাষায়-
দিবসাহি বহুড়ী জাগই
রাতি ভইলে কামবু জাইয়’
১০ ও ১৪ নং পদে ভোর রমণীর তাঁত চাঙারি বিক্রি করার কথা বলা হয়েছে, নৌকা চালানো, লোক পারাপার, নৌকার জল সেচনসহ প্রভৃতি কর্মে নিযুক্ত থাকার কথা আমরা জানতে পাই। চর্যাপদের নারীরা সমাজের নিচু স্তরের বাসিন্দাগিছিল। ডোম্বী, শবর “মেয়েরা খোঁপায় ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জরের মালা পরতো। তারা সমাজের অভিজাত মানুষ থেকে দূরে বাস করতো গ্রামের প্রান্তে, পর্বত গাত্রে কিংবা টিলায়। ২৮ নং চর্যায় বলা হয়েছে এভাবে-
“উষ্ণা উষ্ণা পাবত তহি বসই সবরী বালী।
মোরাঙ্গ পীচ্ছ পরিহাণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।”
১০ চর্যায় নগরের বাইরে ডোম্বি নারীর বসবাসের কথা বলা হয়েছে- ‘নগর বাহিরিত্রে ডোম্বি তোহোরি কুড়িআ’- আবার টিলায় বাস করার কথাও বলা হয়েছে ‘টালত মোর ঘর নাহি পড়বেসী’। চর্যাপদে কিছু নারীর স্বামীদের কাপালিক হয়ে বেরিয়ে পড়ার কথা আছে। কাপালিক হয়ে একটি পুরুষ সংসার-বিরাগী হলে তার পরিবারের নারী বেরিয়ে গেলে দুঃখের শেষ থাকেনা। একটি চর্যায় এমনি দরিদ্রেরা সংসারে গর্ভিণী রমণীর হৃদয়-বেদনার চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। কাপালিক স্ত্রী হিসেবে নারীরা যে অসহায় ছিল তা চর্যায় নারীদের কথা স্পষ্ট। আসলে চর্যাগীতির মধ্যে ইতস্তত যে সব খণ্ড ও পরিপূর্ণ চিত্র ছড়ানো রয়েছে তার আলোচনা করলে একটা গভীর শূন্যতাবোধ এবং দারিদ্র্যের ছবিই ফুটে ওঠে। যেমন-
ফিটিলিউ গো মাই অন্তউডি চাহি।
জা এথু চাহম সো এঘু নাহি।
পহিলে বিআণ মোর বাসন পুড়া।
নাড়ি বিআরস্তে সে বাপুড়া।”
পরিশেষে বলা যায় যে, চর্যাপদে নারীদের যে-চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে তাতে সেকালের নারীদের বিভিন্ন-বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। অধিকাংশ পদে অন্ত্যজশ্রেণির নারীদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার বেদনাবিধূর চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এভাবে চর্যাপদের পদকর্তাদের পদ বিশ্লেষণ করলে নারীদের অবস্থা এবং ভূমিকার চমৎকার বিবরণ পাওয়া যায়। সুতরাং প্রাচীন যুগে নারীরা সমাজে বিশেষ স্থান দখল করেছিল। সর্বোপরি চর্যাপদে প্রাচীন বাংলার রমণী তথা গার্হস্থ্য জীবনের চিত্র ফুটে উঠেছে।