সূচনা : আজ থেকে প্রায় পাঁচশ’ বছর আগে অমর কবি চণ্ডীদাসের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল-
‘শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’
এই বাণী একান্তই শব্দ নির্ভর নিছক কবিত্ব নয়, -তা শাশ্বত সত্যেরই এক মোহনীয় বলিষ্ঠ উচ্চারণ। মানুষ যে সর্বশ্রেষ্ঠ তাতে আজ আর সন্দেহ নেই। ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’। কবির এই বাণী মানুষের কর্ম বিচার করে সত্য বলে গ্রহণ করা যায়। আল্লাহ্ও মানুষকে বলেছেন- ‘আশরাফুল মুখলুকাত।’ অর্থাৎ সৃষ্টির সেরা। মানুষের এই গৌরব বা শ্রেষ্ঠত্ব মানুষের দীর্ঘপথ পরিক্রমার ইতিহাসসিদ্ধ সত্য। মানুষ বর্তমানে জ্ঞানে- বিজ্ঞানে, আত্মমহিমায় পূর্ণতার ঐশ্বর্যে গরীয়ান।
জীবজগতে মানুষের স্বাতন্ত্র্য : বিশ্বপালক তাঁর মহান সৃষ্টির বৈচিত্র্য সাধন করে এক অনন্য মহিমার অধিকারী হয়েছেন। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি যে মানুষ তা তাঁর নিজ উক্তিতে যেমন প্রকাশ পেয়েছে তেমনি প্রকাশ পেয়েছে মানুষের আচার- ব্যবহারে, তার কর্মে। মানুষ কর্ম করেই বেঁচে আছে। আর সে কর্ম শুধু তাঁর নিজের বেঁচে থাকাকে নিশ্চয়তা দেয়নি, সৃষ্টিকেও বাঁকিয়ে রাখার ব্যবস্থা বিধান করেছে। প্রাণিজগতের মাঝে মানুষই একমাত্র বিবেকের দ্বারা পরিচালিত হয়। তাতেই তার স্বাতন্ত্র্য।
জ্ঞান সাধনায় মানুষ : মানুষ আপন সাধনা দিয়ে গড়ে তুলেছে তার সভ্যতা। আদিম রূপ পাল্টে সে মহান জীবনের পাদপীঠ রচনা করেছে। জ্ঞানসাধনার ভেতর দিয়ে সৃষ্টিকে সে করেছে সচল, প্রকৃতিকে করেছে বশীভূত। তার বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা, শ্রম ও সাধনা এক অনন্য কীর্তি সংস্থাপন করতে সে কাজে লাগিয়েছে। তার বিজ্ঞান বুদ্ধি শুধু মাটির ধরা জয় করার কাজেই ব্যয়িত হয়নি, নক্ষত্রালোক বিজয়ে সে দুঃসাহসী পদক্ষেপ রেখেছে। নতুন নতুন আবিষ্কারে সে সৃষ্টিকে দিয়েছে শিরোপা, অসম্ভবকে সম্ভব করেছে সম্মিলিত শক্তি ও মেধার বিকিরণ ঘটিয়ে। মানুষের এই অগ্রগতি বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। মানুষের মেধা, শ্রম, চিন্তাশক্তির বিকাশ মানুষকে সবার উপরে স্থান দিয়েছে। অন্য কোন প্রাণী মানুষের মত ক্রম বিকাশের পথ ধরে সাফফ্যের সোনার দ্বারা পৌঁছতে পারেনি। আক্রান্ত মানুষকে রক্ষা করার জন্য সে আবিষ্কার করেছে যন্ত্রের। যন্ত্র আজ মানুষের অভাব পূরণ করছে নানাভাবে। উৎপাদন যন্ত্র ব্যবহার হচ্ছে, ব্যবহার হচ্ছে রোগ ব্যাধি থেকে নিরাময় করার কাজে। মানুষ তার বুদ্ধির বিকাশ ঘটিয়ে নিজেকে দিয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা।
সংবেদনশীল মানুষ : মানুষের প্রতি মানুষের দরদ আছে। সে প্রেমপ্রীতিময় এক স্নিগ্ধভূবন গড়তে চায়, চায়াময় জীবন চায়। মানুষের এই বোধ অন্য কোন প্রাণীর নেই। মানুষ সুকুমার শিল্পের চর্চা করে। সাহিত্য সংগীতে, সেবায়, কল্যাণে তার দান অতুলনীয়। প্রকৃত মনুষ্যত্ব নিয়ে যখন একটি মানুষ মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় তখন তার অমল দ্যুতি জীবনের সব অন্ধকারকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। অন্যায়, অবিচার থেকে মুক্ত হতে পারলে মানুষের মহিমা আকাশস্পর্শী হয়ে দাঁড়ায়। তখনই মনে হয় সবার উপরে মানুষ সত্য তার উপরে নাই। অক্রুর আনন্দময় জগৎ মানুষ গড়ে তোলে সংবেদনশীল হৃদয় বিস্তারকরে সকল মানুষকে ভালবাসার ভেতর দিয়ে।
আত্মগর্বী মানুষ : মানুষ সভ্যতা গড়েছে বহু বছরের সাধনায়। আবার সভ্যতা সে ধ্বংসও করেছে আপন শক্তির অন্ধ অহমিকায়। সৃজনে বিনাশে মানুষ এক অপরাজেয় শক্তি। মানুষের শুভ বুদ্ধি যেমন কল্যাণকে আবাহন করে এনেছে তেমনি তার অশুভ বুদ্ধি হিংস্র ও কুটিল ছোবলে সভ্যতাকে করে বিক্ষত, রক্তাক্ত। মানুষের এই দুইরূপ সৃষ্টির মৌল, শক্তিরূপেরই অনুরূপ। একদিকে সৃজন, অন্যদিকে ধ্বংস। শুভ আর অশুভ নিয়েই এই সৃষ্টি। আর মানুষের যাতায়াত এই উভয় বৃত্তে। সে জীবন দেয় তবু পরাভব মানে না। আত্মগর্বী মানুষ অনেক সময় সীমা ছাড়িয়ে যায়, শক্তির মোহ তাকে ধ্বংসের দুন্দুভি বাজাতে অনুপ্রাণিত করে। তাই সে মারণাস্ত্র তৈরি করে। যুদ্ধের বিভীষিকা সৃষ্টি করে লক্ষ কোটি মানুষের জীবনকে করে তোলে অশান্ত। এই চরম শক্তিমত্ততা ধ্বংসের হলেও তার শ্রেষ্ঠত্বেরই স্বীকৃতি দেয়।
তবে মানুষ যখন বিবেকহীন হয়ে পড়ে তখন তার মহিমা মেঘলুপ্ত সূর্যের মত উত্তাপহীন হয়ে পড়ে। আজ পৃথিবীর মানুষ সভ্যতার বড়াই করছে আপন সৃষ্টির সৌকর্য সাধন করে। কিন্তু তার জীবন বিকাশে মানসিক যে শান্তি, যে স্থৈর্য ধৈর্যতা নষ্ট হচ্ছে অন্ধ অহমিকায়। মানুষের সংস্কৃতি আজ সভ্যতার গর্বতলে পিষ্ট। তাই দুঃস্থ মানবতা ফাঁদে ফাঁদে মনুষ্যত্বের মহিমাদীপ্ত অতীত ঐতিহ্য, যা প্রেমময় ভুবন গড়ে তোলার শপথে ছিল প্রত্যয়ী। সংশয় আর অবিশ্বাস এসে দাঁড়ায় সুন্দর ভুবনের সমার্পিত আত্মার অনিন্দ্যলোকে। এ হানাহানি মানুষেরই পাপ। এই পাপ ক্ষয় হলেই তার গৌরব।
কল্যাণকামী মানুষ : মানুষের শুভবুদ্ধি তবু জেগে আছে। তাই তার সাংস্কৃতিক অগ্রগতি তাকে নব মহিমা দিচ্ছে। মানুষের কর্মপ্রবাহ এক সুখময়, শান্তিময় ভুবন গড়ার কাজে নিয়োজিত। মানুষ প্রকৃতিকে বশে এনে জড়জগতের উপর প্রভাব বিস্তার করে যে মনীষার পরিচয় দিয়েছে তার তুলনা কোথায়। মানুষ যুগে যুগে সত্যের সাধনায় জীবন দিয়েছে, মানুষের মঙ্গলে দুঃখবরণ করেছে। মানুষের কল্যাণ কামনায় সে তার শ্রম, মেধা, সৃষ্টি সব কাজে লাগিয়েছে।
মহিমাদীপ্ত জীবনাচরণ : সেবায়, ত্যাগে, কর্মে, সৃষ্টিতে একমাত্র মানুষই বিধাতার দেয়া শক্তিকে কাজে লাগিয়েছে। ত্রুটি তার যেটুকু সেটুকু অক্ষম ভাবনার, অশুভ অন্ধকারের ফসল। আলোকময় জীবন বৃত্তে সে যখন বিচরণ করে তখন এক বিমল দ্যুতি তার চলার পথকে করে তোলে উজ্জ্বল। সেই উজ্জ্বল আলোকিত পথেই মহৎ মানুষের অভিসার। মহৎমানুষের কীর্তি দেখেই কবিকণ্ঠ সোচ্চার হয় এই বাণী উচ্চকিত করে-
‘তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ।’
সত্যি মানুষ তার কীর্তির চেয়ে মহৎ। তার সৃষ্টি কল্যাণের দীপ জ্বালায়, তার জীবন সাধনা সুন্দরকে আবাহন করে। এই মহিমাদীপ্ত জীবনাচরণে মানুষের মহত্ব, তার শ্রেষ্ঠত্ব। তার চেয়ে বড় আর কিছু এই সৃষ্টিতে নেই।
উপসংহার : মানুষের জয় হোক, জয় হোক কল্যাণ বুদ্ধির। এই কল্যাণ বুদ্ধির অনুশীলন করেই মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্বকে সবার উপরে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে।