সাধারণ অর্থে সাম্যঃ সাধারণ অর্থে সাম্য বলতে বুঝায় সকল মানুষই সমান। তাই প্রত্যেকে সমান সুযােগ-সুবিধা, সমান অধিকার ও স্বাধীনতা ভােগ করবে। বাস্তবে মানুষে মানুষে শারীরিক, মানসিক গঠন ও গুণগত যােগ্যতার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক পার্থক্য বর্তমান। রাষ্ট্র যদি একজন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও একজন সাধারণ শ্রমিককে একই মূল্যায়ন করে, তাহলে সমাজে প্রতিভার বিকাশ হবে না। কিন্তু বর্তমানে চতুর্দিকে সাম্যের জয়গান শােনা যায়। তবে এ সাম্য ভিন্ন অর্থে।
সাম্যের সংজ্ঞাঃ সাম্যের সংজ্ঞা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ আছে। একেকজন একেকভাবে সাম্যের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।
অধ্যাপক লাস্কি বলেন, সাম্য হলাে সেরূপ সুযােগ-সুবিধার ব্যবস্থা যাতে কোনাে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে অন্যের ব্যক্তিগত সুবিধার বেদীমূলে আত্মবিসর্জন দিতে না হয়।
Prof. Barker বলেন, “It is derived from the supreme value of the development of personality in each alike and equality, but each along its own different line and of its supreme motion.” (সাম্য বলতে ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে সকলের সুযােগ-সুবিধার সমতাকে বলা হয়।কিন্তু এর ফলে সকলের ব্যক্তিত্ব সমানভাবে বিকশিত হবে।)
পি সরােকিনের মতে, “মানবতার চরম উৎকর্ষসাধনের জন্য ব্যক্তিস্বার্থসমতের বন্টন প্রক্রিয়াকে সাম্য বলে।”
সাম্যের তিনটি বিশেষ দিক রয়েছে যথা- (১) বিশেষ সুযােগ-সুবিধার অনপস্থিতি (১) যথার্থ ও যথেষ্ট সুযােগ-সুবিধাদির সৃষ্টি এবং (৩) বেচে থাকার জন্য প্রয়ােজনীয় সম্পদ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমভাবে বন্টন।
সাম্য কত প্রকার?
সাম্য কত প্রকার সে সম্পর্কে আর্নেস্ট বার্কার (Earnest Barker) বলেছেন, সাম্য দুই প্রকার। যথা- আইনগত সাম্য ও সামাজিক সাম্য। তাঁর মতে, আইনগত সাম্য আবার দু-প্রকার হতে পারে। যথা- রাজনৈতিক সাম্য ও অর্থনৈতিক সাম্য।
প্রাচীনকাল থেকে জ্যাঁ জাঁক বুশোর সময়কাল পর্যন্ত প্রাকৃতিক সাম্যের ধারণাটি প্রচলিত ছিল। বর্তমানে সাম্যকে প্রধানত চার ভাগে ভাগ করা হয়। যথা- প্রাকৃতিক সাম্য, সামাজিক সাম্য, আইনগত সাম্য এবং আন্তর্জাতিক সাম্য। আবার আইনগত সাম্যকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- ব্যক্তিগত সাম্য, রাজনৈতিক সাম্য এবং অর্থনৈতিক সাম্য। নিম্নে বিভিন্ন প্রকার সাম্য সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১. প্রাকৃতিক সাম্য
‘জন্মগতভাবে সব মানুষ সমান’ এ ধারণা প্রাকৃতিক সাম্য নামে অভিহিত। প্রাচীন গ্রিসের স্টোয়িক দার্শনিকগণই সর্বপ্রথম মানুষের স্বাভাবিক সাম্য ও সমান অধিকারের কথা প্রচার করেন। তারা মনে করতেন, সব মানুষই ঈশ্বরের সন্তান, অতএব সবাই সমান। জন লক প্রকৃতির রাজ্যের সকল মানুষের সমান সুযোগ-সুবিধার কথা বলেছেন। রুশোও প্রকৃতির রাজত্বে স্বাভাবিক সাম্যের কথা বলেছেন। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের ঘোষণায় বলা হয়েছে, ‘মানুষ জন্ম থেকেই স্বাধীন ও সমঅধিকার সম্পন্ন।’ কিন্তু স্বাভাবিক সাম্যের ধারণাকে বর্তমানে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কারণ শক্তি, সামর্থ্য, বুদ্ধিবৃত্তি, গুণগত যোগ্যতা প্রভৃতিতে মানুষে মানুষে জন্মগত পার্থক্য রয়েছে। প্রাকৃতিক সাম্যের ধারণা থেকেই দাস প্রথার বিলুপ্তি ঘটেছে।
২. সামাজিক সাম্য
সামাজিক ক্ষেত্রে সবাই সমান। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে যখন সকল মানুষকে সমান সামাজিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয় তখনই সামাজিক সাম্যের উদ্ভব ঘটে। এটি এমন এক সামাজিক পরিবেশকে নির্দেশ করে যেখানে প্রত্যেকে স্বীয় যোগ্যতা অনুসারে সমান সামাজিক অধিকার ভোগ করে। দাস ও সামন্ত সমাজে সামাজিক সাম্যের অস্তিত্ব ছিল না। পরবর্তীকালে আইনের শাসনের প্রসার লাভের ফলে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
৩. রাজনৈতিক সাম্য
রাজনৈতিক সাম্য বলতে রাজনৈতিক অধিকার ভোগের ক্ষমতাকে বোঝায়। রাজনৈতিক অধিকার বলতে ভোটাধিকার, নির্বাচিত হওয়ার অধিকার, সরকারি চাকরি লাভের অধিকার, সরকারি কাজে অংশগ্রহণের অধিকার, সরকারের সমালোচনা করার অধিকার প্রভৃতি বোঝায়। নাবালক, দেউলিয়া, উন্মাদ ব্যতীত সবাই রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করার সুযোগ পেলে রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাকে রাজনৈতিক সাম্যের পরিচায়ক হিসেবে গণ্য করা হয়। রাজনৈতিক সাম্য হলো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূলভিত্তি।
৪. অর্থনৈতিক সাম্য
রাষ্ট্রের সকল ব্যক্তিকে সমানভাবে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান করাকে বলা হয় অর্থনৈতিক সাম্য। অর্থনৈতিক সাম্য বলতে অর্থ উৎপাদন ও অর্থ বণ্টনের ক্ষেত্রে সকল প্রকার বৈষম্য দূর করে সবাইকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমান সুযোগ প্রদান করাকে বোঝায়। বলা বাহুল্য, অর্থনৈতিক সাম্য ছাড়া রাজনৈতিক সাম্য মূল্যহীন হয়ে পড়ে।
৫. আইনগত সাম্য
আইনের দৃষ্টিতে সাম্য বা সমানাধিকার স্বীকৃত হলে আইনগত সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলা যায়। আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান এবং সবার প্রতি আইন সমানভাবে প্রযোজ্য, এ হলো আইনগত সাম্যের মর্মকথা। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সব নাগরিক আইনগত সমান সুযোগ-সুবিধা ও অভিন্ন অধিকার সমানভাবে ভোগ করতে পারবে। বস্তুত পৌর, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারগুলো বিধিবদ্ধ রূপ লাভ করে আইনগত সাম্য হিসেবে পরিণত হয়।
৬. ব্যক্তিগত সাম্য
রাষ্ট্রের নাগরিকের সমান অধিকারকে ব্যক্তিগত সাম্য বলা হয়। রাষ্ট্র কোনো ব্যক্তিকে বিশেষ কোনো সুবিধা প্রদান করা হতে বিরত থাকবে। বস্তুত সামাজিক অধিকার সমভাবে উপভোগ করার সুযোগকে বলা হয় ব্যক্তিগত সাম্য। রাষ্ট্রীয় আইন ও সংবিধান যখন সকলের সমান সামাজিক অধিকারকে স্বীকৃতি দান করে তখনই ব্যক্তিগত সাম্যের উৎপত্তি ঘটে। আইনের শাসনের মাধ্যমেই ব্যক্তিগত সাম্য বাস্তবতা লাভ করে। তবে অর্থনৈতিক বৈষম্য যে সমাজে চরম আকারে বিরাজমান সে সমাজে ব্যক্তিগত সাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। কারণ এরূপ সমাজে আইন, সংবিধান, আদালত প্রভৃতি ধনিক গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।
৭. আন্তর্জাতিক সাম্য
সাম্যের নীতিকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সম্প্রসারণ করাকে আন্তর্জাতিক সাম্য বলা হয়। ক্ষুদ্র-বৃহৎ শক্তিধর-কম শক্তিসম্পন্ন, সম্পদশালী-দরিদ্র রাষ্ট্রসমূহকে সমমর্যাদা প্রদান করা হলে এরূপ সাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। অর্থাৎ আয়তন, জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক সম্পদ, সামরিক শক্তি প্রভৃতি নির্বিশেষে সব রাষ্ট্রকে যখন সমমর্যাদাসম্পন্ন বলে গণ্য করা হয় তখন তাকে আন্তর্জাতিক সাম্য বলা হয়। আন্তর্জাতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য মূলত জাতিসংঘ গড়ে উঠেছে। কিন্তু জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক সাম্য প্রতিষ্ঠায় প্রায়ই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
৮. পৌর বা নাগরিক সাম্য
সকল নাগরিক যদি সমানভাবে একইরূপ পৌর বা নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করে তবে তাকে পৌর বা নাগরিক সাম্য বলা হয়। সবাই আইনের দৃষ্টিতে সমান। কোনো ব্যক্তি যদি সামাজিক মর্যাদা, সম্পদের ভিত্তিতে কিংবা রাজনৈতিক মত বা ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে বৈষম্যের শিকার হন তাহলে নাগরিক সাম্য থাকতে পারে না। রাষ্ট্রের কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করাও এ সাম্যের পরিপন্থি। বেশির ভাগ রাষ্ট্রই সাংবিধানিক উপায়ে নাগরিক অধিকারসমূহ সকলের জন্য সমানভাবে উপভোগ করার নিশ্চয়তা বিধান করে থাকে। এভাবেই সাংবিধানিক নিশ্চয়তার মাধ্যমে নাগরিক সাম্য নিশ্চিত করা যায়।
অতএব, উপরোক্ত আলোচনা থেকে আপনারা সাম্য কত প্রকার ও কি কি সে সম্পর্কে জানতে পারলেন। লেখাটি থেকে উপকৃত হলে অবশ্যই বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন।