বাংলা নাটকের ইতিহাস :-
আমরা সবাই কম-বেশি নাটক দেখেছি, কখনো মঞ্চে বা টেলিভিশনে, কখনো বা নাটক শুনেছি রেডিওতে। আপনিও নিশ্চয়ই নাটক দেখেছেন, কিংবা শুনেছেন। অতীতকালে নাটক কেবল দেখারই বিষয় ছিল।
প্রাচীন ভারতে নাটককে বলা হতো দৃশ্যকাব্য কিন্তু আধুনিককালে প্রচার মাধ্যমের স্মৃতির ফলে এখন নাটক শোনারও বিষয় হয়েছে। যেমন আমরা নাটক শুনি রেডিওতে, কখনো বা ক্যাসেট প্লেয়ারে। আপনিও তো নাটক দেখেছেন কিংবা শুনেছেন।
কিন্তু বলতে কি পারবেন, নাটক কাকে বলে? নাটকের বৈশিষ্ট্য কি? প্রশ্নটা একটু জটিল হলো, তাই না? তাহলে আলোচনার মাধ্যমে দেখাই যাক বিষয়টা কতটা সহজ সরল ভাবে আমরা কিভাবে বুঝতে পারি।
বাংলা সাহিত্যে বাংলা নাটক এর উদ্ভব ১৮৫২ খৃষ্টাব্দে। নাটক জীবনের দর্পণ। জীবনকে প্রত্যক্ষত দেখতে, জানতে, বুঝতে নাটকের বিকল্প নেই। দেশ কাল-সমাজ ও সমাজ-আশ্রিত জীবন নাটকে প্রতিফলিত হয়। নাটক মিশ্রকলা একাধারে যেমন পাঠ্য আবার অভিনয়েও বটে। প্রাচ্য নাট্যশাস্ত্রী ভরত-এর মতে, নাটক হল সর্ব শাস্ত্র, শিল্প, কর্ম ও বিদ্যার সমন্বয়ে রচিত। নাটক জীবন নিয়ে রচিত। তাই সমাজের জীবনের নানা সমস্যা ও সংকটের শিল্পীত রূপ নাটকে প্রতিফলিত হয়।
বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখা হচ্ছে বাংলা নাটক। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ, সাহিত্যের এইসব বিচিত্র শাখার মধ্যে নাটক এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পমাধ্যম। দেখা ও শোনার যুগপৎ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই গড়ে ওঠে একটি প্রকৃত নাটক। অর্থাৎ নাটক একই সঙ্গে দেখা ও শোনার বিষয়। এই দুটি মৌল বিষয় নাটকের প্রধান শিল্প বৈশিষ্ট্য হলেও, আমরা নাট্যগ্রন্থ পাঠ করেও সাহিত্য রস আস্বাদন করতে পারি।
নাটকের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য :-
আমরা নিন্মোক্ত ভাবে নাটকের সংজ্ঞা দিতে পারি –
রঙ্গমঞ্চে অভিনয়ের উপযোগী করে যে সাহিত্য রচিত হয়, তাকে সাধারণত: নাটক বলে।
ইংরেজিতে বলা হয় –
“Drama is the creation and representation of life in terms of theater”
আধুনিক সুপ্রসিদ্ধ নাট্যকার Granville Barker নাটকের সংজ্ঞা নির্দেশ করিতে গিয়ে বলেছেন,—
“A play is anything that can be made effective upon the stage of a theater by human agency. And I am not sure. that this definition is not too narrow”.
‘নাটক’ শব্দটির মধ্যেই রয়েছে সত্যের ইঙ্গিত। নট, নাট্য, নাটক এ তিনটি শব্দেরই মূল হলো নট। আর নট্ এর অর্থ হলো নড়াচড়া করা, অঙ্গচালনা করা ইত্যাদি। নাটকের ইংরেজি প্রতিশব্দ Drama’-র মধ্যেও একই সত্য আমরা খুঁজে পাই Drama শব্দের মূলে রয়েছে গ্রীক শব্দ Dracin, যার অর্থ ‘to-do” অর্থাৎ কিছু করা।
নাটককে জীবনের দর্পণ বলা হয়। মানব জীবনের প্রতিদিনের ঘটনার শৈল্পিক অভিব্যক্তিই প্রকাশ পায় নাটকে। শৈল্পিক প্রকাশ এই অর্থে যে, প্রতিদিনের গতানুগতিক স্রোতধারায় ঘটে যাওয়া তুচ্ছ, অস্পষ্ট ঘটনাগুলোই সংলাপে মুখর হয়ে, সাহিত্যরসে সিঞ্চিত হয়ে, ভাববাঞ্ছনায় উদ্ভাসিত হয়ে নাটকে নবরূপ পায়। নাট্যকার মানব জীবনের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিরহ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরেন বলে- নাটককে বলা হয় জীবনের প্রতিচ্ছবি। শ্রেণি অনুযায়ী বিভিন্ন প্রকার নাটকের বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন রকম। তবে নাটকের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপ।
নাটকের বৈশিষ্ট্য :-
- নাটক জীবনেরই সুদৃশ্য রূপায়ণ। দর্শন এবং শ্রবণ-ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বলে নাটককে একই সাথে দৃশ্যকাব্য ও শ্রব্যকাব্য বলা হয়ে থাকে।
- নাটকের মধ্যে নাট্যকারের বলিষ্ঠ জীবনবোধ, জীবনদর্শন ও বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়।
- সংলাপ এবং নাটকীয়তা হলো নাটকের প্রাণ। নাটকের আখ্যানভাগকে ভিত্তি করে কুশীলবদের চরিত্র ও সংলাপের মধ্য দিয়ে নাটকের নাটকীয়তা সৃষ্টি করা হয়।
- একটি সার্থক নাটকে ৫টি অংক এবং প্রতি অংকে ৩টি করে সর্বমোট ১৫টি দৃশ্য থাকে।
- অংক ৫টিতে ঘটনা বিন্যাসের ৫টি বিশেষ পর্যায় বা অবস্থা সংস্থাপিত হয়। যেমন- প্রারম্ভ, প্রবাহ, উৎকর্ষ, গ্রন্থিমোচন এবং উপসংহার।
- নাটক অভিনয় নির্ভর। অভিনেতা নিজেকে রূপান্তরিত করে নির্দিষ্ট চরিত্রের সাথে এক হয়ে যান। তাই নাটক হচ্ছে Imitation of life.
- নাটককে Collective Art বলা হয়ে থাকে। কারণ, এতে একটি আখ্যানভাগের উপজীব্যে রঙ্গমঞ্চের পরিসরে পাত্র পাত্রীর সংলাপ ও অভিনয়ের মধ্যদিয়ে গতিমান মানব জীবনের শিল্পীত প্রকাশ ঘটে থাকে।
- নাটকে ঘটনার দ্বন্দ্ব নাটকীয় দ্বন্দ্বে রূপায়িত হয়। তখনই নাটকে আসে দুর্বার গতি।
নাটকের শ্রেনীবিভাগ :-
নাটকে বিভিন্ন ভাবে শ্রেনীবিভাগ করা যায় যেমন নাটকের বিষয়বস্তু অনুযায়ী, রূপ- রস পরিণতি এবং উপস্থাপনা রীতি অনুযায়ী
নাটকের বিষয়বস্তু অনুযায়ী পুরাণ ও ইতিহাস অবলম্বনে রচিত নাটক চার প্রকার যথা –
- পৌরাণিক
- ঐতিহাসিক
- সামাজিক
- রাজনৈতিক নাটক।
আবার রস পরিণতি অনুযায়ী :-
- ট্রাজেডি
- ক্ল্যাসিক্যাল
- রোমান্টিক
- কমেডি এবং
- প্রহসন।
রূপ অনুসারে শ্রেণীবিভাগ :-
- লোকনাট্য
- গীতিনাট্য
- নৃত্যনাট্য
- পথনাটক
উপস্থাপনা রীতি অনুসারে :-
- বাস্তবধর্মী,
- রূপক,
- সাংকেতিক প্রভৃতি।
আপনি ইচ্ছা করলে আরো কিছু মাপকাঠি প্রয়োগ করে নাটককে শ্রেণীবদ্ধ করতে পারেন। যেমন, প্রচারমাধ্যম বা অভিনয় স্থল অনুসারে আপনি নাটককে তিন ভাগে শ্রেণীবদ্ধ করতে পারেন- বেতার নাটক, টেলিভিশন নাটক, মঞ্চ নাটক ইত্যাদি।
বিভিন্ন নাটকের সংজ্ঞা :-
পৌরাণিক নাটক :-
পৌরাণিক কোন কাহিনী বা চরিত্রকে কেন্দ্র করে যখন কোন নাটক রচিত হয়, তখন তাকে পৌরাণিক নাটক বলে। রামায়ন, মহাভারত, ভাগবত পুরাণ বা অন্য কোন ধর্মমূলক কাহিনী অবলম্বনে পৌরাণিক নাটক লিখিত হয়।
ঐতিহাসিক নাটক :-
অতীতের কোন ঘটনা বা ইতিহাসের কোন চরিত্র অবলম্বনে যখন নাটক লিখিত হয়, তাকে ঐতিহাসিক নাটক বলে। শেক্সপীয়রের Henry IV, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘সাজাহান’, শচীন সেনগুপ্তের ‘সিরাজউদ্দৌলা’, সিকান্দার আবু জাফরের ‘সিরাজ-উ-দ্দৌলা’ প্রভৃতি ঐতিহাসিক নাটকের উদাহরণ।
সামাজিক নাটক কাকে বলে এবং এর বৈশিষ্ট্য :-
সমাজের কোন সমস্যা নিয়ে রচিত নাটককে সামাজিক নাটক বলা হয়। সামাজিক নাটকে সমাজের মৌল প্রবণতা এবং নানা অনুষদের প্রতি নাট্যকারকে সতর্ক থাকতে হয়। এ ধরনের নাটকে সমাজের দুই পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিরোধ দেখা দেয় পরিণতিতে অশুভ পতন দেখানো হয়। বার্ণার্ড শ’র Heart – break House, দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ, নুরুল মোমেনের ‘রূপান্তর’ প্রভৃতি সামাজিক নাটকের উদাহরণ।
কমেডি নাটক কাকে বলে :-
‘কমেডি’ কথাটির উৎপত্তি ‘কোমাস’ শব্দ থেকে ডাওনিসাস দেবতার উপাসনার জন্য প্রাচীন গ্রীসে যে আনন্দো উন্মত্ত শোভাযাত্রা হত তার নাম ছিল কোমাস। শোভাযাত্রার সময় অনেকে নানারকমের পোশাক পরে হাস্য-পরিহাস করতে করতে নাট্য অভিনয় করত। এই কারণেই হাস্য-রসাত্মক নাটক গুলোকে ‘কমেডি’ নামে আখ্যা করা হত।
“A comedy is an imitation of men worse however, not as regards any and every sort of fault; but only as regards particular kind, the ridiculous, which is a species of the ugly, the ridiculous may be defined as a mistake or deformity not productive of pain or harm to others”
খ্রিঃ ৪র্থ শতকের নাট্যপ্রবক্তা এলিয়াস ডোনেটাস লিখেছেন,
“Comedy is a story treating of various habits and customs of public and private affairs, from which one may learn. What is of use in life, on the other hand and what must he avoided on the other”
কমেডির স্বরূপ ও লক্ষণ-বৈশিষ্ট্য যদি আমরা বিচার করি তাহলে দেখা যায় যে ‘কমেডি’ বলতে কেবল স্থূল হাস্যরস যুক্ত নাটক বুঝায় না, গুরু গম্ভীর ও সমস্যাপূর্ণ জীবনের রূপায়ণ ও তার মিলন অস্ত পরিবেশকে বুঝিয়ে থাকে।
নাটকের উপাদান কয়টি ও কি কি :-
নাটকের ৬ টি উপাদানের কথা এরিস্টটল বলেছেন। যথা-
১ – কাহিনী
২ – চরিত্র
৩ – ভাবনা
৪ – সংলাপ
৫ – দৃশ্য
৬ – সঙ্গীত ৷
আবার অনেকের মতে প্রত্যেক নাটকের মধ্যে প্রধান চারটি উপাদান থাকে। এগুলো হচ্ছে :-
১ – কাহিনী বা বিষয়,
২ – চরিত্র,
৩ – সংলাপ এবং
৪ – ঘটনা-সমাবেশ।
নাটক তৈরির সময় একজন নাটক রচনাকারিকে এই উপাদান ৪ টির প্রতি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে লক্ষ্য রাখতে হবে।
নাট্যকার অভিনেতার জন্য এমন কতকগুলি কথার সৃষ্টি করেন, যার সাহায্যে অভিনেতারা তাদের গৃহীত চরিত্রকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলেন । যখন সেই কথাগুলিকে একত্র করে একটি কাহিনীর মধ্যে দিয়ে দর্শকদের দেখানো হয়, তখন তার মধ্যে বেশ একটা সামঞ্জ্য ফুটিয়ে ওঠে। এই সামঞ্জস্যই নাটকের পক্ষে একটি আকর্ষণীয় বিষয়।
কাহিনী চরিত্র গুলির প্রয়োজনয়ীতা ঘোষণা করে, চরিত্রগুলি কাহিনীকে প্রকাশ করে, উপযুক্ত ঘটনা-সমাবেশে চরিত্র ও কাহিনী মধ্যে মূর্ত হয়ে ওঠে। আবার সংলাপ চরিত্রকে মুখর করে তোলে ।
নাটকের গঠন কৌশল :-
কাহিনী, চরিত্র, ঘটনা-সমাবেশ এবং সংলাপ – এগুলি নাটকের প্রধান উপাদান। কিন্তু এই উপাদানগুলি থাকলেই যে, যে কোন কথোপকথন মূলক রচনা নাটক হয়ে উঠবে, এমন কোন কথা নাই। এই বিচ্ছিন্ন অংশগুলি একত্রে গ্রথিত হয়ে নাট্য অভিনয় কালে যদি তা দর্শকদের মনে এক ভাবরসের সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়, তবেই তাকে নাটক বলা যেতে পারে। এই বিচ্ছিন্ন অংশগুলিকে সমষ্টিগতভাবে রসস্থ করে তোলা নাট্যশাস্ত্রসম্মত কয়েকটি নিয়ম আছে। একেই নাটকের গঠন কৌশল বলে।