কাজী নজরুল ইসলামকে কেন ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়?
‘অগ্নিবীণা কাব্যই নজরুলকে বিদ্রোহী সত্তায় পৌঁছে দিয়েছে’ এ কথার সত্যতা কতটুকু বিশ্লেষণ কর।
ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ কালপ্রবাহের উৎস সলিলে কাজী নজরুল ইসলাম [১৮৯৯-১৯৭৬] অবগাহন করেছিলেন। তাই তাঁর কালের চেতনা তাঁর ব্যক্তিজীবনে এবং সাহিত্যিক জীবনে গভীরভাবে স্পন্দিত। বাংলা সাহিত্য জগতে তাঁর আবির্ভাব বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে। সীজারের মতো বাংলা সাহিত্যে ‘তিনি এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন।’ তাঁর এক-একটি কবিতা প্রকাশিত হতে লাগল ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায়- আর সমগ্র বাঙালি শিহরিত হলো এক নতুন কবির আশ্চর্য কবিতার শক্তিতে। ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর এক হাতে রণতূর্য’ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হলেন বিদ্রোহী কবি এবং প্রেমিক কবি। একদিকে তিনি তাঁর কাব্যে চিরসুন্দরের সাধনা করলেন আরেকদিকে স্বাধীনতাযুদ্ধের অগ্নিসৈনিকরূপে রণতূর্যবাদকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। নর-নারীর হৃদয়লীলা তাঁকে যেমন বিচলিত
করেছিল-অন্যদিকে মানুষের শোষণ-শাসনের নির্মমতা তাঁকে বিক্ষুব্ধ এবং বিদ্রোহী করে তুলেছিল।
কাজী নজরুল ইসলামের অধিকাংশ কবিতা-প্রবন্ধের মূলসুর ঝংকৃত হয়েছে ব্রিটিশবিরোধী শাসনকে কেন্দ্র করে। ‘বিদ্রোহী’
কবিতা ছাড়াও অসংখ্য কবিতায় বিদ্রোহের প্রতিফলন ঘটেছে। তাঁর অসংখ্য গদ্য রচনা, কবিতায়, গানে তাঁর এ বিদ্রোহীভাব প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর এ বিদ্রোহ সত্তা বুঝতে হলে তাঁর কথা এবং রচনা থেকে কিছু ভাব উদ্ধৃত করা যায়। যেমন-
ক. “মহামারী, মারীভয়, ধ্বংস আমাদের উল্লাস, রক্ত আমাদের তিলক, রৌদ্র আমাদের করুণা। এরই মাঝে আমাদের নবসৃষ্টির অভিনব তপস্যা শুরু হবে। এস আমার সূর্যতাপস তরুণের দল। সান্ধ্যা শ্মশান আর গোরস্থান আমাদের সান্ধ্যা সম্মিলনী, আলেয়া আমাদের সান্ধ্যপ্রদীপ, মড়াকান্না আর পেচকশিবাদির রব আমাদের মঙ্গল হুলুধ্বনি। মরীচিকা আমাদের লক্ষ্য, আঘাত আমাদের আদর, মার আমাদের সোহাগ, সর্বনাশ আমাদের স্নেহ, বজ্র-মার আমাদের আলিঙ্গন।”
খ. “আপনাকে চেন। বিদ্রোহের মত বিদ্রোহ যদি করতে পার, প্রলয় যদি আনতে পার তবে নিদ্রিত শিব জাগবেই,
কল্যাণ আসবেই। লাথির মত লাথি যদি মারতে পার, তাহলে ভগবানও তা বুকে করে রাখবে। ভৃগুর মত বিদ্রোহ হও, ভগবানও তোমার পায়ের ধুলো নেবে। কাউকে মেনো না, কোনো ভয়ে ভীত হয়ো না বিদ্রোহী। ছুটাও অশ্ব, চালাও রথ, হানো অগ্নিবাণ, বাজাও দামামা দুন্দভি।… বল, আমিই নতুন করে জগৎ সৃষ্টি করব।”
কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘অগ্নি-বীণা’, ‘বিষের বাঁশী’ ও ‘ভাঙার গান’ কাব্যগুলোকে একত্রে কাব্যত্রয়ী বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে এ কাব্যত্রয়ীর মধ্য দিয়েই বাংলা সাহিত্যের গণযাত্রা আরম্ভ হয়। ব্রিটিশ সরকারের অব্যাহত শোষণ, অত্যাচারের এবং সামাজিক অবক্ষয় ও নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে মানব মুক্তির তীব্র বাসনা জেগে ওঠে নজরুলের মনে। তিনি দেশকালের সীমা-পরিসীমা অতিক্রম করে দুঃশাসন-অপশাসনকে ডিঙিয়ে ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় উচ্চারণ করলেন-
“আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন!”
কিংবা,
“মহা বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হবো শান্ত।”
ঝাকড়া চুলের বাবরি দুলিয়ে কণ্ঠে ভৈরবী গীত নিয়ে প্রথম ‘অগ্নি-বীণা’ হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলেন এবং ‘অগ্নি-বীণা’ [১৯২২] কাব্যের মধ্য দিয়েই প্রথম বিদ্রোহ এবং বিক্ষোভ মানসের পরিচয় দিলেন। কবি ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্য প্রকাশের মাধ্যমে বিদ্রোহী সত্তাকে নিজের অস্থিসত্তায় ধারণ করে একটি জাগরণ বা পরিমণ্ডল তৈরি করলেন। এ কারণেই নজরুলকে বিদ্রোহী কবি বলা হয়।
প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তিনি উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ করে গেছেন। আশার বাণী নিয়ে তিনি সবার সামনে হাজির হয়েছেন মানব মুক্তির জন্য। যেমন-
“আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু
এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!” (ধূমকেতু)
‘অগ্নি-বীণা’র অগ্নিগর্ভ বাণীর ঝঙ্কার মিলিয়ে যেতে না যেতেই কবি ‘বিপ্লব বাঁশিতে’ সুর সংযোজন করলেন। ‘চিরতিক্ত প্রাণের’ গভীর থেকে উদগত ‘কণ্ঠছেড়া বিষ অভিশাপ তিক্ত’ গান রচনার সংকল্প থেকেই ‘বিশের বাঁশীর” সুর লহরীর উদ্ভব। কাব্যের ভূমিকায় এ সম্পর্কে কবি জানিয়েছেন: “বিষের বাঁশীর বিষ যুগিয়েছেন আমার নিপীড়িতা দেশমাতা আর আমার ওপর বিধাতার সকল রকম আঘাতের অত্যাচার।”
‘বিষের বাঁশীর’ অধিকাংশ কবিতা ও গান বিদ্রোহের উত্তেজনায় উদ্দীপ্ত ও অস্থির। এ কবিতা ও গানগুলোর উদ্দীপন ভাব যুগিয়েছে পরাধীনতার জ্বালাবোধ, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও স্বদেশের দুঃখ-বেদনার প্রতি গভীর সমবেদনাবোধ। পরাধীনতার অভিশাপের বিরুদ্ধে স্বদেশ প্রেমের নিজস্ব মূর্তি নির্মাণেই ‘বিষের বাঁশীর’ বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। ‘বিদ্রোহীর বাণী’ শীর্ষক কবিতায় নজরুল সে বিদ্রোহের স্বরূপ নির্ণয় করেই যেন বলেছেন, “যেথায় মিথ্যা, ভণ্ডামি ভাই করব সেথায় বিদ্রোহ।”
কবির বিদ্রোহের লক্ষ্য কি তা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, “আমরা জানি সোজা কথা, পূর্ণ স্বাধীন করব দেশ।” এ স্বাধীনতার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষাই প্রবল উত্তাল হয়ে উঠেছে বিভিন্ন কবিতা ও গানে। ‘বিদ্রোহীর বাণী’ কবিতাটি ছাড়া ‘সেবক’, ‘জাগৃতি’, ‘অভিশাপ’, ‘মুক্ত পিঞ্জর’ কবিতায় কবি বিদ্রোহীর অন্তর্লোকের সন্ধান পাওয়া যায়।
মূলত কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহ শোষিত, নির্যাতিত, বঞ্চিত অবহেলিত সর্বোপরি দারিদ্রক্লিষ্ট মানুষের জয়গানে উচ্চকিত। তাঁর চিন্তা-চেতনায় বিদ্রোহের স্বরূপ-সূচনা ও সূতিকাগারে ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্য থেকে শুরু এবং পরবর্তী রচনাতেও এ ভাব বিদ্যমান ছিল । সব মিলিয়ে সবখানেই তাঁর বিদ্রোহের ভাবটি স্পষ্ট ছিল- তাই কাজী নজরুল ইসলামকে বিদ্রোহী কবি বলা হয়।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।