অথবা, ধ্বন্যাত্মক শব্দগুলো বাংলা ভাষার এক শ্রেষ্ঠ সম্পদ ‘ -উদাহরণসহ উক্তিটির বিশ্লেষণ কর।
ধ্বন্যাত্মক শব্দঃ ধ্বন্যাত্মক শব্দ বাংলা ব্যাকরণের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বাংলা ভাষায় ধ্বনি-সমন্বয়ে সৃষ্ট বর্ণনাসূচক এবং দ্যোতনাসৃষ্টিকারী কতকগুলো শব্দ বিশেষ্য, বিশেষণ, ক্রিয়া ও ক্রিয়া-বিশেষণরূপে ব্যবহার হয়। এগুলো কোনো ব্যক্তি, বস্তু বা প্রাণীর ক্রিয়া বা অনুভূতির স্বাভাবিক বা কাল্পনিক অনুকৃতির শব্দাত্মক রূপায়ণ৷ এগুলোকে ধ্বন্যাত্মক শব্দ বলে।
অথবা কোনো কিছুর স্বাভাবিক বা কাল্পনিক অনুকৃতিবিশিষ্ট শব্দের রূপকে ধ্বন্যাত্মক শব্দ বলে। যেমন- হনহন- তিনি রাগ করে হনহন করে চলে গেলেন । এরকম- ঘচাঘচ (ধান কাটার শব্দ), হু হু (বাতাস প্রবাহের শব্দ) ইত্যাদি। বাংলা ভাষায় ধ্বন্যাত্মক শব্দ দু’প্রকার। যথা-
১. মূল ধ্বন্যাত্মক শব্দঃ যেসব ধ্বন্যাত্মক শব্দ যথার্থই মৌলিক এবং যেগুলো দ্বিত্ব করতে হয় না, তাদের ‘মৌলিক বা মূল ধ্বন্যাত্মক শব্দ’ বলে। যেমন- চট, পট, শাঁ, ভোঁ ইত্যাদি।
২. ধ্বন্যাত্মক শব্দদ্বৈতঃ ধ্বন্যাত্মক শব্দের দ্বিত্বরূপে ব্যবহৃত হলে ধ্বন্যাত্মক শব্দদ্বৈত হয়। যেমন- শোঁ শোঁ, ভোঁ ভোঁ ইত্যাদি।
ধ্বন্যাত্মক শব্দের প্রয়োজনীয়তাঃ
ধ্বন্যাত্মক শব্দগুলো বাংলা ভাষার এক শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এ ধ্বন্যাত্মক শব্দের আলাদা কোনো অর্থ নেই। বাংলা ভাষায় এ ধ্বন্যাত্মক শব্দগুলোর নিজস্ব কোনো অর্থ না থাকলেও বাক্যে ব্যবহৃত হলে এগুলো বেশ তাৎপর্যপূর্ণ অর্থ প্রকাশ করে থাকে। এদের সাহায্যে যেমন স্পষ্টভাবে নানারূপ বিশেষ বিশেষ ভাব প্রকাশ করা যায়, অন্য কোনো শব্দের সাহায্যে তা সম্ভব নয়। অনেক সময় কোনো বিশেষ ভাবকে বা অভিব্যক্তিকে প্রকাশ করার জন্য একমাত্র ধ্বন্যাত্মক শব্দের ওপরই নির্ভর করতে হয়। শারীরিক অনুভূতি, হাসি ও কথার বর্ণনা, রঙ-বৈচিত্র্য, নিঃশব্দতা, শূন্যতা প্রভৃতি বুঝাতে এদের প্রয়োগ হয়। অর্থাৎ যেসব অনুভূতি শ্রুতিগ্রাহ্য নয় সেসব অনুভূতিকে ধ্বনিরূপে বর্ণনা করার জন্য ধ্বন্যাত্মক শব্দের প্রয়োগ হয়। এটি বাংলা ভাষার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তাই বাংলা ভাষায় ধ্বন্যাত্মক শব্দের গুরুত্ব অনেক।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধ্বন্যাত্মক শব্দ সম্পর্কে বলেছেন, “বাংলা ভাষায় বর্ণনাসূচক বিশেষ একশ্রেণির শব্দ বিশেষণ ও ক্রিয়ার বিশেষণরূপে বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হইয়া থাকে, তাহারা অভিধানে স্থান পায় নাই। অথচ সে সকল শব্দ ভাষা হইতে বাদ দিলে বঙ্গভাষার বর্ণনাশক্তি নিতান্তই পঙ্গু হইয়া পড়ে।”
ধ্বনির সঙ্গে যেসব ভাবের দূরসম্পর্কও নেই, তাও বাংলায় ধ্বনির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। যেমন- কনকনে শীত। কনকন ধ্বনির সঙ্গে শীতের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না। শীতে শরীরে যে বেদনা বোধ হয়, আমাদের কল্পনার কোনো অদ্ভূত বিশেষত্ববশত আমরা তাকে ‘কনকন’ ধ্বনির সঙ্গে তুলনা করি। অর্থাৎ আমরা মনে করি, সে বেদনা যদি শ্রুতিগম্য হতো তবে তা কনকন শব্দরূপে প্রকাশ পেত।
“বস্তুত সব ধরনের শূন্যতা, স্তব্ধতা, এমনকি নিঃশব্দতাকেও আমরা ধ্বনির মাধ্যমে প্রকাশ করি। আমাদের ভাষায় শূন্য ঘর খাঁ খাঁ করে, মধ্যাহ্ন রৌদ্রের স্তব্ধতা ঝাঁ ঝাঁ করে, শূন্য মাঠ ধু ধু করে, বৃহৎ জলাশয় থৈ থৈ করে, পোড়োবাড়ি খাঁ খাঁ করে, শূন্য হৃদয় হু হু করে, কোথাও কেউ না থাকলে ভোঁ ভোঁ করতে থাকে- এসব নিঃশব্দতার ধ্বনি অন্যভাষীদের কাছে কীরূপ জানি না, আমাদের কাছে নিরতিশয় স্পষ্ট ভাববহ।”
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, ধ্বন্যাত্মক শব্দগুলো বাংলা ভাষার এক শ্রেষ্ঠ সম্পদ।