প্রশ্নঃ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চণ্ডীদাস একজন না একাধিক? যুক্তিসহ আলোচনা কর।
অথবা, চণ্ডীদাস সমস্যা বলতে কী বুঝ? সমস্যাটির একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান দাও।
অথবা, ‘চণ্ডীদাস সমস্যা’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখ।
অথবা, চণ্ডীদাস সমস্যার স্বরূপ বিশ্লেষণ কর। এ সমস্যার সমাধান নির্দেশ কর।
অথবা, চণ্ডীদাস সমস্যা বলতে কী বুঝ? আলোচনা করে এই সমস্যার মীমাংসা করবার চেষ্টা কর।
অথবা, মধ্যযুগের বাংলা কাব্যে কয়েকজন চণ্ডীদাসের অস্তিত্ব বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সমস্যার সৃষ্টি করেছে। এই সমস্যার স্বরূপ উদ্ঘাটন করে সম্ভাব্য সমাধান নির্দেশ কর।
অথবা, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ পুঁথির আবিষ্কার চণ্ডীদাস সমস্যার উদ্ভব ঘটিয়েছে। এই সমস্যার স্বরূপ বিস্তারিত বুঝিয়ে লেখ।
উত্তরঃ চণ্ডীদাসের নাম মধ্যযুগের বাংলা কবিদের মধ্যে অতি প্রসিদ্ধ। একদিকে তার পদাবলির অনুপম রসৈশ্বর্য, অন্যদিকে শ্রীচৈতন্যদেব কর্তৃক তার পদমাধুর্য আস্বাদন তাঁকে জনপ্রিয় করে তুলেছে।
“সই কেবা শুনাইলে শ্যাম নাম।”
“এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা।”
“ঘরের বাহিরে দণ্ড শতবার”
-এ পদগুলো মধ্যযুগের গণ্ডি পেরিয়ে আজও আমাদের হৃদতন্ত্রীতে অনুরণন সৃষ্টি করে।
জীবনে পিরিতির জ্বালায় জ্বলে পুড়ে চণ্ডীদাস রাধার কণ্ঠে কণ্ঠ রেখে বলেছিলেন- ‘সই আমার মরণ ভাল।’ কিন্তু দুর্ভাগ্য। মরণেও চণ্ডীদাসের রেহাই নেই। জীবনে একাত্ত ঐকান্তিকতায় তিনি আত্মলোপের সাধুনা করেছিলেন। কিন্তু তারই মরণ সমাধির বিপুল অন্ধকার আলোড়িত করে আজ জেগে উঠছে তাঁর আত্মপ্রতিষ্ঠার জ্যোতির্ময় হাহাকার। সমালোচকের, গুণগ্রাহীর, গবেষণাকারীর লাখো কলমের ডগায় জাগছে তার কোটি কল্লোল। “গবেষণার পর গবেষণায় চণ্ডীদাসের রঙ ও রাঙ দুই-ই ঘুচেছে, কাঠামোয় নাড়া দিতে গিয়ে দেখা গেল, জরাসন্ধের মত জোড়ামূর্তি বেশ কয়েক জোড়।” এ জোড়ের গ্রন্থি উন্মোচন তো দূরের কথা বরং দিনের পর দিন তা ক্রমশ হয়ে উঠেছে জটিল ও রহস্যময়। চণ্ডীদাসের একত্ব নিয়ে প্রথম প্রশ্ন উঠে ১৩০৫ সালে। নীলরতন মুখোপাধ্যায় ঐ সময় চণ্ডীদাস ভণিতাযুক্ত কিছু রাসলীলার পদ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় প্রকাশ করেন। পদগুলো রসহীন ও কাব্যগুণহীন। এসব পদ শ্রেষ্ঠ গীতিকবি চণ্ডীদাসের বলে পণ্ডিতেরা স্বীকার করতে সম্মত হন নি। অতঃপর ১৩২১ সালে ব্যোমকেশ মুস্তফী “কৃষ্ণের জন্মলীলা” সম্পর্কীয় কিছু সংখ্যক নতুন পদ প্রকাশ করেন। তারপর বসন্তরঞ্জন বিদ্বদ্বল্লভ ১৩১৬ সালে বাঁকুড়ার কাকিন্যা গ্রামের এক গৃহস্থের গোয়ালঘর থেকে রাধাকৃষ্ণের প্রেম সম্পর্কিত এক প্রাচীন পুঁথি আবিষ্কার করেন যার নাম ছিল শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ এবং বসন্তবাবু পুঁথিখানি ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামে সম্পাদনা করেন। তাতে বড়ু চণ্ডীদাসের সাথে সাথে চণ্ডীদাসের ভণিতা আছে। কিন্তু চণ্ডীদাসের প্রচলিত পদ তাতে নেই। ফলে প্রশ্ন উঠল—চণ্ডীদাস কি দু’জন? অতঃপর ১৩৪১ সালে মণীন্দ্রমোহন বসু সম্পাদিত দীন চণ্ডীদাসের পদাবলি প্রকাশিত হলে চণ্ডীদাস সমস্যা প্রকট হল। ১৩৪৫ সালে শ্রীমতি অপর্ণা দেবীর সভাপতিত্বে ‘চণ্ডীদাস সমস্যা’ নিয়ে যে সেমিনার হয় সেখানে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রবন্ধ পাঠ করেন। তার মতে—
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে বড়ু চণ্ডীদাসের ভণিতার কয়েকটি বিশেষত্ব আছে—
১. কোনও স্থানে দ্বিজ চণ্ডীদাস বা দীন চণ্ডীদাস নেই।
২. সর্বত্র গাএ বা গাইল আছে, কোথাও ভণে, কহে প্রভৃতি ক্রিয়াপদ নেই।
৩. ভণিতা কখনো উপান্ত চরণে হয় না ৷
৪. বড় চণ্ডীদাস শ্রীমতি রাধিকার পিতামাতার নাম যথাক্রমে সাগর ও পদুমা বলেছেন।
৫. বড় চণ্ডীদাস রাধার কোন সখী বা শাশুড়ির নাম উল্লেখ করেন নি। তিনি বড়ায়ি ভিন্ন কোন সখীকে সম্বোধনও করেন নি।
৬. শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রাধার নামান্তর চন্দ্রাবলি, প্রতিনায়িকা নয়।
৭. বড়ু চণ্ডীদাস শ্রীকৃষ্ণের কোনও সখার নাম উল্লেখ করেন নি।
৮. বড় চণ্ডীদাস সর্বত্র প্রেম অর্থে নেহ বা নেহা ব্যবহার করেছেন। কেবল চার জায়গায় ‘পিরিতি’ শব্দের প্রয়োগ আছে, যার অর্থ প্রীতি বা সন্তোষ।
৯. বড়ু চণ্ডীদাস কখনো রাধিকার বিশেষণ ‘বিনোদিনী’ এবং শ্রীকৃষ্ণ অর্থে শ্যাম ব্যবহার করেন নি।
১০. শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রাধা গোয়ালিনী মাত্র, রাজকন্যা নয়।
১১. বড়ু চণ্ডীদাসের নিকট ব্রজবুলি অপরিচিত।
১২. বড় চণ্ডীদাস সখীকে সম্বোধন করে কোন পদ রচনা করেন নি।
এসব কষ্টি পরীক্ষায় চণ্ডীদাসের নামে প্রচলিত অনেক পদ যে বড়ু চণ্ডীদাস ভিন্ন অন্য চণ্ডীদাসের তাতে সন্দেহ থাকে না।
বাশুলী আদেশে দ্বিজ চণ্ডীদাসে ভণে।
তোমার বন্ধু তোমার আছে গালি পড়িছ কেনে।
এই ভণিতা বড়ু চণ্ডীদাসের হতে পারে না। কারণ-
>১. দ্বিজ শব্দের প্রয়োগ, ২. বড় চণ্ডীদাস কখনও ভণিতায় বাশুলী আদেশে বা ভণে ব্যবহার করেন নি। তাছাড়া এই ভণিতা উপান্ত চরণে যা বড় চণ্ডীদাসের প্রয়োগ বিরুদ্ধ। ফলে একথা স্পষ্ট যে, পদটি দ্বিজ চণ্ডীদাসের। তাছাড়া ভণিতায় কেবল চণ্ডীদাস থেকেও যদি ‘বাশুলী আদেশে’ কথাটি থাকে তাতেই বুঝবো যে, পদটি দ্বিজ চণ্ডীদাসের। যেমন—
কহে চণ্ডীদাসে বাশুলী আদেশে
শুন হে নাগর চান্দা।
সে যে বৃষভাণু রাজার নন্দিনী
নাম বিনোদিনী রাধা।
রাজার নন্দিনী, বিনোদিনী রাধা– এই প্রয়োগগুলো দেখে সুনিশ্চিত বলা যায় যে, এ পদ কিছুতেই বড়ু চণ্ডীদাসের নয়।
উদাহরণে পদসংখ্যা না বাড়িয়ে বলা যায় যে, অনেক পদে বৃষভাণু সূতা, বিশাখা সখির উল্লেখ, রাধিকাকে রাজার ঝি বলা, রাধার ননদ কুটিলা, শাশুড়ি জটিলা, কৃষ্ণকে শ্যাম বলা সবই বড়ু চণ্ডীদাস বিরুদ্ধ। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বাইরেও বড়ু চণ্ডীদাস ভণিতা থাকলেও কষ্টি পাথরে তাকে পরীক্ষা করে দেখতে হবে যে, তা মূল বড়ু চণ্ডীদাসের স্বভাবসিদ্ধ কিনা। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সাত স্থানে আমরা বড়ু চণ্ডীদাসের এক বিশেষ ভণিতা অনন্ত (বা আনন্ত বড়ু চণ্ডীদাস দেখতে পাই। এ থেকে অনন্ত চণ্ডীদাস বলে আলাদা চণ্ডীদাসের অস্তিত্ব খোঁজার কোন কারণ নেই। বড়ু চণ্ডীদাসের প্রকৃত নাম অনন্ত। তার কৌলিক উপাধি বড়ু। চণ্ডীদাস তাঁর দীক্ষা গ্রহণাত্তর গুরুদত্ত নাম। অতএব, অনন্ত চণ্ডীদাস মূলত বড়ু চণ্ডীদাসই। এছাড়াও ১৩২৩ সালে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় হরকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় দ্বিতীয় চণ্ডীদাসকে স্বীকৃতি দেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় মণীন্দ্রমোহন বসু ‘দীন চণ্ডীদাস’ নামক একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। তাতে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত পুঁথির মধ্য থেকে দীন চণ্ডীদাসের দু’খানা পুঁথির নিদর্শন স্বরূপ একুশটি পাতা উদ্ধারের খবর দেন। অতঃপর রমণীমোহন মল্লিক বেশ ক’টি পালাগানের পুঁথি থেকে সংগৃহীত, পূর্বে অপ্রকাশিত প্রায় পাঁচশ নতুন পদযুক্ত যে নতুন ‘চণ্ডীদাস পদাবলী’ প্রকাশ করেন, তার মধ্যে দ্বীজ চণ্ডীদাস ভণিতায় কিছু সংখ্যক পদ ছিল। ১৩৩৩ সালে দু’হাজার পদপূর্ণ ‘দীন চণ্ডীদাস’ ভণিতাযুক্ত পালাগানের অপর এক বৃহৎ পুঁথি মণীন্দ্রমোহন বসু ১৩৪১ সালে সম্পাদনা করে দীন চণ্ডীদাসের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করলেন। তাছাড়া বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে আমরা মাত্র কয়েকটি আরবি ফারসি শব্দ পাই। কিন্তু দ্বীজ চণ্ডীদাসের পদে অনেক আরবি ফারসির প্রয়োগ দেখা যায়। তাছাড়া স্বয়ং মণীন্দ্রবাবু স্বীকার করেন যে, দীন চণ্ডীদাসের প্রামাণিক ভণিতাতে বাশুলীর কোন উল্লেখ নেই। তাছাড়া অনেক পদ আছে যাতে বাশুলী, রামা বা নানুর উল্লেখ আছে, অথচ এই পদগুলো বড়ু চণ্ডীদাসের নয়। তাহলে স্বীকার করতে হয় যে, বডু ও দীন চণ্ডীদাসের অতিরিক্ত আর এক পদকর্তা ছিলেন, যিনি মূলত দ্বিজ চণ্ডীদাস। এতক্ষণে আমরা (১) বড়ু চণ্ডীদাস, (২) দীন চণ্ডীদাস, (৩) দ্বিজ চণ্ডীদাস— মোট তিনজন চণ্ডীদাসের অস্তিত্বের সন্ধান পেলাম।
“জয়দেব বিদ্যাপতি আর চণ্ডীদাস
শ্রীকৃষ্ণ চরিত তারা করিল প্রকাশ।”
এ পদে জয়দেব বিদ্যাপতির সমসাময়িক এক চণ্ডীদাসের উল্লেখ রয়েছে। তাছাড়া চণ্ডীদাসের সঙ্গে জড়িয়ে রামা বা রজকিনীর নামে কিংবদন্তীর উল্লেখ রয়েছে— পুকুর পাড়ে নীরব প্রেমিক চণ্ডীদাস বর্শী বাইতেন। ‘রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম’– বিখ্যাত পদ হিসেবে আমাদের মনে দাগ কাটে। তাছাড়া পদাবলির ললিত কলাবিতানে চণ্ডীদাসের বীণার সুর আমাদের শ্রুতিকে স্পন্দিত করে। যে সুর লহরী কোমলকান্ত ভাব যমুনায় ঢেউ তোলে । বৈষ্ণবের হৃদয় ফুলবনের মধুচন্দন, সেই ভাব যমুনার প্রেম নীরে সুচর্চিত। বৈষ্ণব পদাবলি সর্বকালের বাংলা সাহিত্যের সার্বজনীন সহজ ঐতিহ্য, আর কবি চণ্ডীদাস এই চিরবহমান রসধারার আদি গঙ্গা হরিদ্বার। সেদিক দিয়ে মধ্যযুগের গীতিকবিতার চণ্ডীদাস অনস্বীকার্য।
উপসংহারে বলা যায়, সর্বৈব যুক্তি প্রদানে আমরা ‘চারজন চণ্ডীদাসের অস্তিত্ব পাই-
১. শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের লেখক— বড়ু চণ্ডীদাস
২. মণীন্দ্রমোহনের সম্পাদনায় প্রমাণিত— দীন চণ্ডীদাস
৩. শহীদুল্লাহ সাহেব কর্তৃক প্রমাণিত— দ্বিজ চণ্ডীদাস
8. সর্বজননন্দিত বৈষ্ণব পদাবলীর— চণ্ডীদাস।
চণ্ডীদাস বিষয়ক সমস্যা এই সাক্ষ্য দেয় যে, খ্যাতনামা বাঙালি কবি চণ্ডীদাসকে বাঙালিরা ভোলে নি কখনো। হয়ত চণ্ডীদাসের অনেক পদ কালের কপোলতলে বিলীন হয়েছে। কিন্তু সেগুলো গীতিকারে, কীর্তনীয়াদের মুখে মুখে বীণার তারে বেঁচে আছে। যা সেকালের হাত থেকে এ কালের হাতে বাড়িয়ে দেয়া এক অত্যুজ্জ্বল প্রেমহার।