অথবা, Comparative Administration কি?
অথবা, তুলনামূলক প্রশাসন (Comparative Administration) কাকে বলে? এর প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য এবং গুরুত্ব বর্ণনা কর।
ভূমিকাঃ তুলনামূলক প্রশাসন লোক প্রশাসনে অতি সাম্প্রতিক সংযোজন। এটি একটি জটিল বিষয় এবং এর পদ্ধতিও ততোধিক জটিল। তাই তুলনামূলক প্রশাসনকে অর্থবহ করে তুলতে হলে গভীর অন্তর্দৃষ্টি, ব্যাপক আচরণমূলক দক্ষতা ও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন।
তুলনামূলক প্রশাসনের সংজ্ঞা (Definition of Comparative Administration): তুলনা করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি ও কর্ম। ‘তুলনা’ শব্দের অর্থ হলো দুই বা ততোধিক প্রতিষ্ঠান বা বস্তুর উভয়ের বা সকলের মধ্যে বিরাজমান অভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে পরস্পরের আলোচনা। যে কোন প্রশাসনিক ব্যবস্থা বা প্রতিষ্ঠানের পরিচয় এককভাবে সম্পূর্ণ নয়। কোন বিশেষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা বা প্রতিষ্ঠানের সম্যক পরিচয় জানতে হলে, অন্যান্য প্রশাসনিক ব্যবস্থা বা প্রতিষ্ঠানের সাথে এর তুলনামূলক আলোচনা থাকতে হবে। কোন দুই বা ততোধিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা বা কাঠামোর আলোচনা যখন তাদের উভয়ের বা সকলের মধ্যে বিদ্যমান সাধারণ বৈশিষ্ট্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হবে, কেবল তখনই একে তুলনামূলক আলোচনা বরা যেতে পারে। এভাবে অভিন্ন বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে যখন বিভিন্ন প্রশাসনিক ব্যবস্থা, তাদের বিভিন্ন প্রশাসনিক কাঠামো, প্রশাসনিক সংস্থা ইত্যাদির তুলনামূলক আলোচনা করা হয়ে থাকে, তখন তাকে তুলনামূলক প্রশাসন বলে অভিহিত করা চলে।
তুলনামূলক প্রশাসনের প্রকৃতি (Nature of Comparative Administration): বর্তমানে লোক প্রশাসন বিভিন্ন পর্যায়ের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংগঠন ও তুলনামূলক প্রশাসন নিয়ে আলোচনা করে। তুলনামূলক প্রশাসনে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা আদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপিত প্রশাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। তুলনামূলক প্রশাসনে বিভিন্ন দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পর্কে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য বর্ণনা ও গবেষণামূলক আলোচনা করা হয়। তুলনামূলক প্রশাসন পরিবেশ সৃষ্টিকারী উপাদানের উপর গুরুত্ব আরোপ করে। পরিবেশের সাথে প্রশাসনিক যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন নয়। সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো ও কার্যক্রমে পরিবেশেরও যথেষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। লোক প্রশাসন দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয় বহন করে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর প্রভাবেই পরিপুষ্ট হয়ে উঠে কোন একটি দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা। ১৯৬৩ সালে আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতি তুলনামূলক প্রশাসন, প্রশাসনিক প্রক্রিয়া ও মুল্যবোধকে বাস্তবে রূপদান করার জন্য একটি সামগ্রিক অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে। এভাবে মিশ্র সাংস্কৃতিক ও বিভিন্ন দেশভিত্তিক প্রশাসন ব্যবস্থার উপর পর্যালোচনা ও গবেষণা অনুষ্ঠিত হলে প্রশাসন-জ্ঞানভাণ্ডার নতুন জ্ঞান, তত্ত্ব ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আরো সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠবে।
তুলনামূলক প্রশাসনের বৈশিষ্ট্য (Chracteristics of Comparative Administration): তুলনামূলক প্রশাসনের কতিপয় স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। বৈশিষ্ট্যসমূহ নিচে উল্লেখ করা হলো-
প্রথমত, তুলনামূলক প্রশাসন বিভিন্ন প্রশাসনিক ব্যবস্থার তুলনামূলক আলোচনা করে। তুলনামূলক প্রশাসনের লক্ষ্য হলো বিভিন্ন প্রশাসনিক কাঠামোর স্বরূপ বিশ্লেষণ করে তাদের কাঠামোর মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করা।
দ্বিতীয়ত, তুলনামূলক প্রশাসন আধুনিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি প্রাচীন ও গতানুগতিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা, তাদের প্রকারভেদ ও বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রভৃতি আলোচনা করে।
তৃতীয়ত, তুলনামূলক প্রশাসন একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত কার্যপ্রণালী বিশ্লেষণ করে তার প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটন করে।
চতুর্থত, তুলনামূলক প্রশাসন মানুষের প্রশাসনিক জীবন এবং তার সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য উপাদানের বাস্তবভিত্তিক ব্যাখ্যা প্রদান করে বাস্তব অবস্থাকে তুলে ধরতে পারে।
তুলনামূলক প্রশাসনের গুরুত্ব (Importance of Comparative Administration): তুলনামূলক প্রশাসন ব্যবস্থার গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে রবার্ট এ ডাল ( Robert A. Dahl) বলেছেন, “বিভিন্ন রাষ্ট্রে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক আলোচনা ও সমীক্ষা হতে যেমন সুফল লাভ করা যায়, তেমনি বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রশাসন ব্যবস্থার তুলনামূলক আলোচনা ও সমীক্ষা আমাদের জন্য সুফল আনবেই।” সাম্প্রতিককালে জাতিসংঘ বিভিন্ন দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে তাদের প্রশাসনিক সমস্যা লির সম্যক ধারণা লাভ করতে গিয়ে তুলনামূলক লোক প্রশাসনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কাজেই প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাসমূহের সঠিক মূল্যায়নের জন্য সমসাময়িক ও সংস্থাগুলোর তুলনামূলক পর্যবেক্ষণ একান্ত অপরিহার্য। তুলনামূলক প্রশাসনের গবেষকগণ পরিবর্তনশীল সমাজের প্রশাসনগত বিভিন্ন সমস্যার ব্যাখ্যা দান ও তাদের সমাধানের জন্য নতুন নতুন ধারণার অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা প্রশাসনের ক্ষেত্রে পুরাতন পদ্ধতি ও উদাহরণসমুহকে অপর্যাপ্ত বলে বর্ণনা করেছেন। এসব সমাজের সামাজিক পদ্ধতি, কৃষ্টি ও মূল্যবোধ নিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে এবং এ পরিবর্তনশীলতা বা গতিশীলতাই তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। এ পরিবর্তনের কারণে প্রশাসনের মূল কাঠামো, কার্যক্রম ও ষ্টুমিকা ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, তুলনামূলক প্রশাসন পুরাতন প্রশাসনিক চিন্তা-চেতনার বেদিমূলে আঘাত করে আধুনিক লোক প্রশাসনের চিন্তা ধারাকে অনেক তথ্য বহুল ও নব প্রেরণা দান করেছে।
প্রশাসনের তুলনামূলক অধ্যয়ন (Comparative Study of Administration): বর্তমানে প্রশাসনের তুলনামূলক অধ্যয়ন পদ্ধতির উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। তুলনামূলক অধ্যয়ন পদ্ধতির মাধ্যমে তুলনামূলক উপায়ে প্রশাসনিক ক্রিয়াকলাপ প্রক্রিয়া এবং প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনসমূহ সম্পর্কে অনুশীলন করা হয়। এ পদ্ধতিতে অধিক সংখ্যক প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে অধ্যয়নের অন্তর্ভুক্ত করে তুলনার ক্ষেত্রকে অধিকতর সম্প্রসারণ করা চলে।
আধুনিককালে অনেকেই সমসাময়িক সরকার ও প্রশাসন ব্যবস্থাসমূহকে তুলনামূলক পদ্ধতিতে অধ্যয়ন করেছেন; যেমন- হারম্যান ফাইনার (Herman Finer)-এর ‘The Theory and Practice of Modern Government’, কার্ল জে. ফ্রেডারিক (Carl J. Friedrick) কৃত ‘Constitutional Government and Democracy’, ব্রিয়ান চ্যাপম্যান (Brian Chapman)-এর ‘The Profession of Government’ ইত্যাদি।
বর্তমান সময়ে লোক প্রশাসন সম্পর্কে যারা অধ্যয়ন করছে, তাদের মধ্যে প্রশাসনিক আচরণের ‘বাস্তব তথ্যাদি’ উদঘাটন করা, অর্থাৎ, এর অভিজ্ঞতালব্ধ ভিত্তিসমূহ আবিষ্কার করার প্রচেষ্টা ক্রমবর্ধমানভাবেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষত আচরণ ভিত্তিক অনুশীলন পদ্ধতি ও কেস স্টাডি বা ঘটনা সমীক্ষণ পদ্ধতির বিকাশলাভ ও প্রভাবের ফলে লোক প্রশাসনকে তুলনামূলকভাবে অধ্যয়ন করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সাম্প্রতিককালে তুলনামূলক প্রশাসন এমনি গুরুত্ব অর্জন করে চলেছে যে, লোক প্রশাসনে তুলনামূলক অধ্যয়ন পদ্ধতির নব প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কারণ—
প্রথমত, বর্তমান সময়ে বিভিন্ন প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পর্কে অভিজ্ঞতাভিত্তিক, বর্ণনামূলক তথ্য বিশ্লেষণপূর্ণ ও ব্যাখ্যাবহুল রচনা প্রকাশ লাভ করছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ ডব্লিও. এ. সিফিন ( W. A Siffin) ‘Towards a Comparative Study of Public Administration’ গ্রন্থে এশিয়া ও আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পর্কে তথ্যভিত্তিক আলোচনা করা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, তুলনামূলক প্রশাসনে সম্প্রতিকালে এমন সব বিষয়ের উপর গুরুত্ব ও উৎসাহ আরোপ করা হচ্ছে, যা নিয়মিত আচরণ-রীতি এবং পরিবর্তনশীল বিষয়াদির মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের কথা ব্যক্ত করে। আর গ্যাব্রিয়েল এ. অ্যালমণ্ড (Gabriel A. Almond) এবং জেমস এস. কোলম্যান (James S. Coleman)-এর ‘The Politics of Developing Areas ‘ গ্রন্থখানি তুলনামূলক প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিষয় আধুনিক দৃষ্টিকোণ নিয়ে রচিত হয়।
তৃতীয়ত, লোক প্রশাসন সম্পর্কে তুলনামূলকভাবে অধ্যয়ন করতে গিয়ে বর্তমান সময়ে লোক প্রশাসনের সাথে পারস্পরিক ক্রিয়াকারী পারিপার্শ্বিক উপাদানগুলোর ব্যাপারে অধিকতর উৎসাহ দেখানো হচ্ছে। এ সকল উপাদান সরকারি আচরণকে প্রভাবিত করে এবং এরাও আবার সরকারি আচরণের দ্বারা প্রভাবিত হয় বলে বর্তমানে মনে করা হয়। জন এম. গস (John M. Gaus)-এর ‘Reflection on Public Administration’ এবং ফ্রেড ডব্লিউ. রিজ (Fred. W. Riggs)- এর ‘The Ecology of Public Administration’ গ্রন্থ দুটি এই নব প্রবণতার দৃষ্টান্ত বিশেষ।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, তুলনামূলক প্রশাসন বর্তমান লোক প্রশাসনে এক নতুন ও বিস্তৃত দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যে আধুনিকতা সূচিত হয়েছে, তার প্রভাব লোক প্রশাসনেও ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যায়। আর যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জীবনে যে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়, তাই আবার তুলনামূলক প্রশাসনের গতি-প্রকৃতি ও অধ্যয়ন রীতিকে প্রভাবিত ও নির্ধারিত করেছে। বর্তমানকালে তুলনামূলক প্রশাসন পরিধিগত ও অধ্যয়ন পদ্ধতিগত দিক থেকে ব্যাপকতা লাভ করেছে এবং প্রশাসনের মূলসূত্র ও বাস্তবতা অনুসন্ধানে দ্রুতগতিতে অগ্রসর হচ্ছে।