চুক্তি আইনের প্রয়োজনীয়তা (Importance of the law of contract): অতি প্রাচীনকাল হতেই মানুষ চুক্তির সাথে পরিচিত এবং অনেক লেনদেনই চুক্তির ভিত্তিতে করে আসছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে চুক্তি আইনের প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। পণ্য ক্রয়, সম্পত্তি হস্তান্তর, আর্থিক লেনদেন, বাস- ট্রেনে ভ্রমণ, চাকুরীতে নিয়োগ ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই আমরা চুক্তির প্রয়োগ দেখতে পাই, চুক্তির সবচেয়ে ব্যাপক প্রয়োগ দেখা যায় বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে।
কোন ব্যক্তি ব্যবসায় পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিলে তাকে প্রতিটি পদক্ষেপে চুক্তি করতে হয়। প্রথমে তাকে ব্যবসার অঙ্গণ অর্থাৎ দোকান কিনতে হবে বা ভাড়া নিতে হবে এবং এ কাজে চুক্তির প্রয়োজন। সে ব্যক্তি একক মালিকানাধীনে ব্যবসায় পরিচালনা করতে পারে অথবা অন্যের সাথে অংশীদারী ব্যবসা করতে পারে কিংবা লিমিটেড কোম্পনী গঠন করতে পারে। অংশীদারী ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে অংশীদারগণের মধ্যে চুক্তি হয়ে থাকে এবং কোম্পানীর ক্ষেত্রে শেয়ার হোল্ডারদের সাথে কোম্পানীর চুক্তি হয়ে থাকে। কর্মচারী বা প্রতিনিধি নিয়োগ করলে সেখানেও চুক্তির প্রয়োজন। ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে তাকে পণ্য কিনতে হবে। কেনার পর এই পণ্য পরিবহনের জন্য তাকে চুক্তি করতে হয়। এমন কি পথিমধ্যে দুর্ঘটনা, চুরি বা অন্যভাবে পণ্যের ক্ষতি হতে রক্ষার্থে বীমা করতে হয় যা চুক্তির ভিত্তিতে হয়ে থাকে।
নগদ অর্থ লেনদেনের চাইতে ব্যাংকের মাধ্যমে আদান প্রদান অধিক সুবিধাজনক। তাই ব্যাংকের সাথে চুক্তিগত সম্পর্ক স্থাপন করে তার মাধ্যমেই আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করা হয়। এভাবে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই চুক্তির ব্যবহার দেখা যায়। ব্যবসায়ের সম্প্রসারণের সাথে চুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে থাকে। আধুনিক প্রযুক্তি, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি বাণিজ্যিক ক্ষেত্রকে ক্রমশ সম্প্রসারিত ও জটিলতর করে তুলেছে। সেই সাথে চুক্তি আইনেরও সূক্ষ্ম বিধানাদির প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশৃংখলা ও অনিশ্চয়তা পরিহার করে মানব কল্যাণে চুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য চুক্তি
আইন প্রয়োগ করা হয়। চুক্তি আইন চুক্তিভুক্ত পক্ষগণের ভবিষ্যত আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে এবং এক পক্ষকে অপর `পক্ষের অঙ্গীকারের উপর নির্ভর করতে সাহস জোগায় । কেউ তার অঙ্গীকার পালনে ব্যর্থ হলে চুক্তি আইন তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করে। তাই চুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম শুধু জাতীয় পর্যায়ে নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও চুক্তির গুরুত্ব ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
চুক্তি আইনকে নিঃসন্দেহে একটি মৌলিক আইন বলা যায়। অন্যান্য দেওয়ানী আইনসমূহ মূলতঃ চুক্তি আইনকে ভিত্তি করেই প্রবর্তিত হয়েছে। বিশেষ করে নিম্নোক্ত আইনগুলির সাথে চুক্তি আইনের এক অচ্ছেদ্য সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়ঃ
(ক) ১৮৬৫ সালের পরিবহন আইন ( The Common Carrier Act, JII of 1865);
(খ) ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন (The Specific Relief Act, 1877);
(গ) ১৮৮১ সালের হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন (The Negotiable Instruments Act, 1881);
(ঘ) ১৮৮২ সালের সম্পত্তি হস্তান্তর থাইন (The Transfer of property Act. 1882);
(ঙ) ১৮৯০ সালের রেলওয়ে আইন (The Indian Railways Act, 1890);
(চ) ১৯৩০ সালের পণ্য বিক্রয় আইন (The Sale of Goods Act, 1930);
(ছ) ১৯৩২ সালের অংশীদারী আইন (The Partnership Act, 1932);
চুক্তি আইনের মধ্যে অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক উপাদান ছাড়াও একটা নৈতিক উপাদান পরিলক্ষিত হয়। সমাজ আইন ও নৈতিকতা পাশাপাশি চলে যদিও এদের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। বস্তুতঃ আইনে সমাজের নৈতিক মানদন্ডের প্রতিফলন ঘটে। চুক্তি আইনে মানুষের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত অঙ্গীকার রক্ষা করার নৈতিক তাগিদ লক্ষ্য করা যায়। এই আইনের এটাও প্রত্যাশা যে, কেউ যেনো একটা অসাধু চুক্তির সুবিধা গ্রহণ না করে, যা অর্থনৈতিক বা সামাজিক চাপের মুখে গঠন করা হয়েছে। চুক্তি আইনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের সুখ ও শান্তি। ইহা তখনই সম্ভবপর হতে পারে যখন মানুষ তার আশা আকাঙ্খা বহুলাংশে চরিতার্থ করতে পারে এবং স্বার্থ সংঘাতের ক্ষেত্রে ন্যায় বিচার পেতে পারে। চুক্তি আইনে এগুলি যুক্তিসঙ্গত মাত্রায় বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা রয়েছে।