সাক্ষ্য বলতে কি বুঝায়ঃ বাংলাদেশে প্রযোজ্য ১৮৭২ সালের ‘সাক্ষ্য’ আইনের ৩ নম্বর ধারায় সাক্ষ্যের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এই ধারা অনুসারে ‘সাক্ষ্য’ বলতে বুঝায় এবং এর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে, কোন অনুসন্ধানহীন বিষয়ে আদালতের অনুমতিক্রমে সাক্ষীর প্রদত্ত বিবৃতি এবং আদালতে উপস্থাপিত সকল দলিল। এই ধারা অনুসারে ‘সাক্ষ্য’ বলতে মূলত মৌখিক ও দলিলী সাক্ষ্য বুঝায় । কিন্তু এই সংজ্ঞাটি পূর্ণাঙ্গ নয়। এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন প্রয়াসগুলি অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে।
মহামতি বেনথামের মতে, ‘সাক্ষ্য’ হচ্ছে কোন ঘটনার বিষয় যার ফলাফল কিংবা অভিপ্রায় অন্য কোন ঘটনার বিষয়ের উপস্থিতি সম্বন্ধে ‘হ্যাঁ সূচক বা না’ সূচক কোন দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি করা।
ক্যালিফোর্নিয়ার কোডে সাক্ষ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, আইন দ্বারা অনুমোদিত যে সকল উপকরণ দ্বারা বিচারিক কার্যক্রমে কোন ঘটনার প্রশ্নে সত্যটিকে সুনিশ্চিত করা যায় তা হচ্ছে সাক্ষ্য।
Taylor, The word Evidence’ includes all the legal means, exclusive of mere argument, which tend to prove or disprove any matter of fact, the truth of which is submitted to judicial investigation’
অর্থাৎ ‘সাক্ষ্য’ শব্দটির অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে, শুধুমাত্র যুক্তিতর্ক ব্যতিরেকে সকল প্রকার আইনগত পন্থা যা কোন ঘটনাকে প্রমাণ বা অপ্রমাণ করার প্রয়াস পায় এবং এর সত্যতা বিচারিক অনুসন্ধানের জন্য নিবেদন করা হয়।
ব্ল্যাকের আইন অভিধানে যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে সে মতে সাক্ষ্য হচ্ছে, আদালত কর্তৃক কোন বিচার কার্য সম্পাদনের সময় পক্ষগণ কর্তৃক তাদের সাক্ষীর মাধ্যমে বা রেকর্ড, দলিল ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের বক্তব্য সম্পর্কে আদালত বা জুরির মনে বিশ্বাস স্থাপনের প্রয়াসে আইন সঙ্গতভাবে উপস্থাপিত প্রমাণের কোন নমুনা ।
‘সাক্ষ্যের’ ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘evidence’ ল্যাটিন শব্দ ‘evidens’ বা ‘evidere’ হতে উদ্ভূত। এর অর্থ হচ্ছে সুস্পষ্টভাবে কোন কিছু প্রদর্শন করা বা দৃষ্টি গোচর করা বা সুস্পষ্টভাবে আবিষ্কার করা।
অতএব বিচারাধীন কোন ঘটনা সম্পর্কে প্রমাণ বা অপ্রমাণের উদ্দেশ্যে উপস্থাপিত কোন বক্তব্য বা বস্তু। যে ব্যক্তি সাক্ষ্য প্রদান করেন তাকে সাক্ষী বলে এবং সাক্ষ্য দ্বারা যে ঘটনা প্রতিষ্ঠিত করা হয় তাকে প্রমাণিত বলে। সাক্ষ্যের শাখা বিশেষ বা অংশকে প্ৰমাণ বলে।
সাক্ষ্যের প্রকারভেদঃ ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনে দু’ধরনের সাক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে। এগুলি হচ্ছে (১) মৌখিক সাক্ষ্য এবং (২) দলিলী সাক্ষ্য। বিচার্য বা অনুসন্ধানাধীন বিষয়ে কোন সাক্ষী আদালতের অনুমতিক্রমে যে বিবৃতি দেন তাকে মৌখিক সাক্ষ্য বলে। যে সকল দলিল আদালত কর্তৃক পরিদর্শনের জন্য উপস্থাপন করা হয় সে সকল দলিলকে দলিলী সাক্ষ্য বলে।
উপরি-উক্ত শ্রেণীবিভাগ ছাড়াও আইন বিশারদগণের মতে, নিম্নোক্ত প্রকারের সাক্ষ্যের অস্তিত্ব রয়েছেঃ
(ক) প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য ও অবস্থাগত সাক্ষ্য;
(খ) প্রাথমিক সাক্ষ্য ও গৌণ সাক্ষ্য;
(গ) মৌলিক সাক্ষ্য ও জনশ্রুতিমূলক সাক্ষ্য;
(ঘ) সমর্থনসূচক সাক্ষ্য।
(ক) প্রত্যক্ষ ও অবস্থাগত সাক্ষ্যঃ কোন একটি দলিল বা সাক্ষীর বিবৃতি কোন একটি বিচার্য বিষয়ের অস্তিত্ব বা অস্তিত্বহীনতা সম্পর্কে সরাসরি সমর্থন যোগায় তাকে প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য বলে। অর্থাৎ যিনি সংশ্লিষ্ট ঘটনাটি নিজে দেখেছেন বা শুনেছেন বা সরাসরি ঘটনার সাথে জড়িত ছিলেন এমন ব্যক্তির সাক্ষ্যকে প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য বলে। যেমন, ক খ-কে খুন করেছে এবং গ নিজ চোখে তা দেখেছে। এক্ষেত্রে গ এর সাক্ষ্যটি প্রত্যক্ষ হিসেরে বিবেচিত হবে।
অপ্রত্যক্ষ বা অবস্থাগত সাক্ষ্য বলতে এমন সাক্ষ্যকে বুঝায় যা সরাসরিভাবে কোন বিচার্য বিষয় প্রমাণ করে না বরং কেবল জনশ্রুতিমূলক বা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনুধাবন করা যায়। এই ধরনের সাক্ষ্য এমন কতকগুলি অবস্থা এবং পারিপার্শ্বিকতার সমন্বয় যেগুলি মূল বিচার্য বিষয়ের সাথে সংযুক্ত। এগুলি সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করলে বিচার্য বিষয়ের সত্যতা বা অসত্যতা সম্পর্কে একটা অকাট্য ইঙ্গিত প্রদর্শন করে।
যেমনঃ ক, খ-কে গুলী করে হত্যা করেছে। এই হত্যাকাণ্ড কেউ দেখে নি। কিন্তু গ নিকটে ছিল। সে গুলীর শব্দ শুনেছে এবং একে দৌড়ায়ে যেতে দেখেছে। ঘটনাস্থলে এসে মৃত খ এর পার্শ্বে একটি বন্দুক পড়ে থাকতে দেখেছে যা পরে অনুসন্ধানে জানা গেল এটা ক এর। এমতাবস্থায় গ এর সাক্ষ্য অবস্থাগত সাক্ষ্য হিসাবে গণ্য হবে। বিচারপতি বেস্ট অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, অবস্থাগত সাক্ষ্য হলো এমন একটি সাক্ষ্য যদ্বারা মূল তথ্য এক বা একাধিক তথ্য থেকে অনুধাবন বা অনুমান করা যায় এবং যা অকাট্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে।
(খ) প্রাথমিক সাক্ষ্য ও গৌণ সাক্ষ্যঃ সাক্ষ্য আইনের ৬২ ধারায় বলা হয়েছে যে, প্রাথমিক সাক্ষ্য বলতে সংশ্লিষ্ট আসল দলিলকে বুঝায় যা আদালতের পরিদর্শনের জন্য উপস্থাপন করা হয়। এই ধারার সঙ্গে সংযুক্ত ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, কোন দলিল কতিপয় খণ্ডে সম্পাদিত হলে প্রত্যেক খণ্ডই এই দলিলের প্রাথমিক সাক্ষ্য বলে গণ্য হবে। এছাড়া যেক্ষেত্রে কিছুসংখ্যক দলিল মুদ্রণ, লিথোগ্রাফি বা ফটোগ্রাফির মাধ্যমে একই পদ্ধতিতে প্রস্তুত হয় সেক্ষেত্রে এদের প্রত্যেকটি অন্যগুলির প্রাথমিক সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য হবে, কিন্তু এগুলি কোন মূল দলিলের নকল হয়ে থাকলে তা মূল দলিলের বিষয়বস্তু সম্পর্কে প্রাথমিক সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য হতে পারে না।
সাক্ষ্য আইনের ৬৩ ধারা মোতাবেক গৌণ সাক্ষ্য বলতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলিকে বুঝায়ঃ
(ক) ৭৬ ধারায় বর্ণিত বিধান অনুসারে প্রদত্ত কোন মূল দলিলের জাবেদা নকল।
(খ) মূল দলিল হতে এরূপ যান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রস্তুত অবিকল নকল যাতে নকলের নির্ভুলতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় এবং এরূপ নকলের সাথে মিলায়ে নেয়া অবিকল অন্য নকল৷
(গ) মূল দলিল হতে প্রস্তুতকৃত অথবা মূল দলিলের সহিত মিলায়ে নেয়া নকল।
(ঘ) কোন দলিলের মুড়ি যে পক্ষ উক্ত দলিল সম্পাদন করে নি বলে দাবী করে তার বিরুদ্ধে তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে।
(ঙ) যে ব্যক্তি কোন মূল দলিল দেখেছে সেই দলিলের বিষয়বস্তু সম্পর্কে তার দেয়া মৌখিক বিবরণ।
(গ) মৌলিক সাক্ষ্য ও জনশ্রুতিমূলক সাক্ষ্যঃ যে সকল মৌখিক বা দলিলী সাক্ষ্য আদালতে আইনত গ্রহণযোগ্য সেগুলোকে মৌলিক সাক্ষ্য বলে। জনশ্রুতিমূলক সাক্ষ্য বা শোনা কথার উপর ভিত্তি করে সাক্ষ্য প্রদান আদালতে সাধারণত গ্রহণযোগ্য হয় না। তবে এর ব্যতিক্রম রয়েছে যা সাক্ষ্য আইনের ৩২ ও ৩৩ ধারায় লিপিবন্ধ রয়েছে।
(ঘ) সমর্থনসূচক সাক্ষ্যঃ একই বিষয়ে একাধিক ব্যক্তির অভিন্ন সাক্ষ্য গ্রহণ করা হলে এক ব্যক্তির সাক্ষ্য অন্য ব্যক্তির সাক্ষ্যকে সমর্থন করে সাক্ষ্য দিয়ে সাধারণত আদালতের মনে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস সৃষ্টির প্রয়াস চালানো হয়। একজনের সাক্ষ্য যে প্রকার বিশ্বাস সৃষ্টি করতে পারে, অন্যের সাক্ষ্যে সে ধরনের প্রয়াস থাকলে তাকে সমর্থনসূচক সাক্ষ্য বলে। প্রথম সাক্ষীর বক্তব্যের সাথে দ্বিতীয় সাক্ষীর বক্তব্য মিলে গেলে দ্বিতীয় সাক্ষীর সাক্ষ্যকে সমর্থনমূলক সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য করা হয়।
সাক্ষ্যের অগ্রাধিকার নির্ধারণঃ প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য উৎকৃষ্ট মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাই সকল ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। মৌখিক সাক্ষ্য অবশ্য প্রত্যক্ষ হওয়া প্রয়োজন। তবে প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যের মূল্য নির্ভর করে সাক্ষীর বিশ্বাসযোগ্যতার উপর। প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যের অবর্তমানে অপ্রত্যক্ষ বা অবস্থাগত সাক্ষ্যের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রেই অবস্থাগত সাক্ষ্য বিচার্য বিষয়ের সত্যতা বা অসত্যতা সম্পর্কে একটা অকাট্য ইঙ্গিত প্রদর্শন করে। তাই বলা হয় যে, সাক্ষী মিথ্যা বলতে পারে কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থা মিথ্যা বলে না।
দালিলীক সাক্ষ্যের ক্ষেত্রে প্রাথমিক সাক্ষ্যের উপর অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। প্রাথমিক সাক্ষ্যের বর্তমানে গৌণ সাক্ষ্য আদালতে গ্রহণযোগ্য হয় না। তবে বিচার্য বিষয়ে প্রাথমিক সাক্ষ্য উপস্থাপন করতে অপারগ হলে কতিপয় শর্তসাপেক্ষে গৌণ সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।